ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

মণিপুরীদের রাসলীলা

তমাল ফেরদৌস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১০
মণিপুরীদের রাসলীলা

রস থেকে ‘রাস’ শব্দের উৎপত্তি। ‘রাস’ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সর্বোত্তম মধুর রস।

অতএব ‘রাসলীলা’ বলতে শ্রীকৃষ্ণ তার হাদিনী শক্তি শ্রীরাধা ও অন্যান্য গোপীদের সঙ্গে যে লীলা করেছেন তাকেই বোঝায়। মণিপুরী সমাজে প্রচলিত রাজনৃত্যকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে : ১. শারদীয় মহারাস, ২. বসন্তরাস, ৩. নিত্যরাস, ৪. কুঞ্জরাস, ৫. গোপীরাস ও ৬. উদখুলরাস। এর মধ্যে শারদীয় মহারাস হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-ন্ডিত। শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা সংঘটিত লীলাসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলেই একে মহারাস লীলা বলা হয়ে থাকে।

প্রতি বছর শারদীয় পূর্ণিমাতিথিতে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরের জোড়ামন্ডপে এই মহারাস লীলানুকরণের আয়োজন হয়ে থাকে। মাধবপুরের এই রাসলীলা অনুষ্ঠান প্রায় দেড়শ বছর ধরে চলছে।

মহারাস লীলা মণিপুরী সম্প্রদায়ের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের অন্যতম। মণিপুরী সম্প্রদায়ের মূল বাসস্থান মণিপুরের বাইরে একমাত্র মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুরের জোড়াম-পেই সর্বপ্রথম মণিপুরী রাসলীলার প্রচলন ঘটে। এখানে ১২৪৯ বঙ্গাব্দে (১৮৪২ সাল) প্রথম রাস লীলানুষ্ঠানের আয়োজন হলেও এটি এর বহু আগে থেকেই প্রচলিত।

বাংলাদেশে মণিপুরী নৃত্যচর্চার ইতিহাসে বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে ১৯৫৫ সালে। এ ঘটনার নায়ক বাংলাদেশের মণিপুরী সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের উজ্জ্বল পুরুষ ওস্তাদ ব্রজধন সিংহ। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ৯ সদস্যের নৃত্যদল নিয়ে অংশ নেন ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসবে। ওস্তাদ ব্রজধন সিংহ প্রথম এ নৃত্যকে মন্দির চত্বর থেকে নিয়ে আসেন আধুনিক মঞ্চে। সেই অনুষ্ঠানে ওস্তাদ ব্রজধন সিংহের সাথে ছিলেন ওস্তাদ কামেশ্বর সিংহ। এই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। ১৯৫৬ সালে ব্রজধন সিংহ ঢাকার বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে যোগদান করেন একজন মণিপুরী শিক হিসেবে। পরে ১৯৬৫ সালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কর্তৃক আয়োজিত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে অংশ নেন।

জনশ্রুতি রয়েছে, ১৭৬৯ সালে জোড়াম-পে রাসলীলার সূত্রপাত ঘটে। হাজার হাজার বছর আগে শ্রী বৃন্দাবনে রাসলীলার আবির্ভাব হলেও মণিপুরে এর প্রচলন প্রায় ২৫৬ বছর আগে শুরু হয়েছে। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রর (জয়সিংহ) শাসনামলে মণিপুরে এ লীলার বীজ বপন হয়। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র বৈষ্ণব ধর্মের আচরণীয় শ্রীমদভগবতের রাস পঞ্চাধ্যায় পঠন সেবায় ব্রতী হন। কিন্তু ভগবৎকৃত রাসলীলা, গোপী, সখি ও মঞ্জুরীসহ বিরাজমান দৃশ্য চাক্ষুষ দর্শনে অপারগ হয়ে নিজে শ্রী গোবিন্দ জিউর চরণে প্রাণপ্রাত শয়নে গেলেন। তন্দ্রাবস্থায় তিনি দেখতে পান, শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধা ও গোপীসহ দিব্য রাসলীলা করছেন। সে আলোকেই তিনি রামের চার প্রকার তাল তৈরি করেন। এগুলো হলো : চালী পারেং, ভঙি পারেং, খোবাক পারেং ও বৃন্দাবনী পারেং। এরপর মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র কয়েকজন কুমারী মেয়ে দিয়ে স্বপ্নে দেখা অনুযায়ী রাসলীলা করলেন। এতে নিজ কন্যা কুমারী বিশ্বাবতীকে শ্রীরাধা এবং মন্দিরের শ্রী গোবিন্দকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাসলীলা করেন এবং তিনি নিজেই উক্ত রাসে মৃদঙ্গ বাদক ছিলেন। তাতে তিনি নিজস্ব তাল ব্যবহার করেন। উল্লেখ্য, এটি আজ অবধি মণিপুরী রাসলীলার অন্তর্ভুক্ত। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র কেবল রাসলীলা, তাল প্রবর্তন করেই ান্ত হননি। রাসলীলায় বিভিন্ন আঙ্গিক পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়েও গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। রাজা ভাগ্যচন্দ্র প্রথম রাস শুরু করেছিলেন। তাই মণিপুরী রাসলীলা শুরু করার সময় ‘রাস আরম্ভিল ভাগ্যচন্দ্র মনোহর’ বলে ধ্বনি করা হয়। ভাগ্যচন্দ্র রচিত গোবিন্দ সঙ্গীত রাসলীলা ছাড়াও জয়দেব, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবিদের পদাবলিকে আশ্রয় করে মণিপুরী সমাজে রাসনৃত্যের রূপায়ণ দেখা যায়। এসবের অনুকরণেই মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র তার গ্রন্থ রচনা করেন। এখানে তার কাব্যের কিছুটা নমুনা দেওয়া হলো :

‘বরজ কামিনী নবিনা বালা
চলিল রঙ্গিলা চন্দ্রকি মালা।
কুন্ডল লম্বিত লম্বিত হার
চারু দলিত বেণী মনোহর।
বিকশিত কুসুম বন ছায়ে
আমার বন্ধুগণ গায়ে গায়ে
চমকি চমকি নয়ন চায়
গহন কামন গমন তায়।
কুঞ্জর সদনে পছিয়া রঙে
পাইলু শ্রীরাধা গোবিন্দ সঙে।
সখির অনুগা লালিন মানস
নরপতি ভাগ্যচন্দ্র এই আশ’।

উপরোক্ত কাব্যাংশে শ্রী রাধিকার যে সৌন্দর্য বর্ণনা করা হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। শ্রীকৃষ্ণকে রস বৈচিত্র্য আস্বাদনে সমর্থন করতে না পারলে শ্রীরাধিকার সমস্ত সাজগোজ বৃথা হতো। শ্রীকৃষ্ণের মনোরঞ্জনের জন্য রাধিকাকে যেভাবে চিত্রিত করা প্রয়োজন, তার কোনও অভাব দেখা যায় না আলোচ্য কাব্যাংশে। ভাগ্যচন্দ্র নিজে ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। নৃত্যের বিভিন্ন ভঙ্গি এবং মুদ্রার তালে যখন এ গান রাসলীলায় গীত হয় তখন কৃষ্ণভক্তরা মোহাবিষ্ট না হয়ে পারেন না। প্রত্যেক রাসেই শ্রীকৃষ্ণের জীবন বৈচিত্রের বিভিন্ন দিক অভিনীত হয়।

উল্লেখ্য আছে, শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে ব্রজ গোপীরা যেখানে যে অবস্থায় থাকতেন সে অবস্থায়ই ছুটে আসতেন। শ্রীকৃষ্ণ ব্রজগোপীদের নিয়ে বিমুগ্ধ বিহার করতেন এবং ব্রজগোপীরাও প্রেমে আপ্লুত হয়ে নিমজ্জিত হতেন। শ্রীকৃষ্ণ তাদের স্পর্শ থেকে যখন অন্তর্নিহিত হতেন, তখন গোপীরা হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ বলে রোদন করতে করতে বনে প্রবেশ করে তাকে খুঁজে বেড়াতেন। বনের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্নসহ অপরিচিত কোনও গোপবধূর পদচিহ্ন চিনে তারা বুঝতে পারত শ্রীকৃষ্ণ তাদের ত্যাগ করে অন্য বধূর সঙ্গে বিহারে গেছেন। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ওই বধূরা একাকী কাঁদত। তারা ভাবত শ্রীকৃষ্ণ উধাও হয়ে গেছেন। এ কথা শুনে সবাই সমবেতভাবে ১১টি শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতিগান গেয়ে সমাপ্ত করত। এভাবে বিরহকাতর প্রেমমুগ্ধ গোপিনীরা সমবেতভাবে যে বন্দনা রচনা করে তাই শ্রীকৃষ্ণের ‘রাসম-প’ হিসেবে পরিচিত হয়। শ্রীকৃষ্ণ রাসম-পে প্রবেশ করলে গোপিনীরা প্রত্যেকেই ভাবতে থাকত শ্রীকৃষ্ণ তারই একান্ত কাছে আছেন। আর এর ফলেই ‘রাসম-প’ রচনা করে নৃত্যগীত উৎসব হতো। রাসম-পে নৃত্য রচনার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ যে প্রত্যেকের সাথে আছেন তার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন মূর্তিতে অদ্ভুত শক্তির বহুল প্রকাশ ঘটাতেন। শ্রীকৃষ্ণের বিচিত্র মহিমা ও শক্তির প্রকাশ মণিপুরী রাসলীলায় পরিস্ফুটিত হয়ে বিশেষত্ব সহকারে উৎসবের আকারে রূপ নিয়েছে। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা ও গোপীদের যে অপ্রাকৃত পোশাক-পরিচ্ছেদে দর্শন করেছিলেন তা তিনি অনুরূপভাবে নিজ কন্যার রাসলীলায় ব্যবহার করেছিলেন। এখন পর্যন্ত রাসলীলানুষ্ঠানে এ ধরনের অপ্রাকৃত পোশাক পরিচ্ছেদ ব্যবহার করা হয়।

মণিপুরী নৃত্য মূলত রাসলীলারই প্রতিফলন। রাসলীলার বিভিন্ন আঙ্গিক ও মুদ্রা সমন্বয়ে নৃত্যে ব্যাপকতা ও সাবলীলতা থাকে। এ নৃত্যে পোশাকের মধ্যে তেমন কোনও বাহুল্য থাকে না। গোপীরাও শ্রীরাধার পোশাক, মাথায় চূড়ার ওপর ‘ককনাম’ মুখে পাতলা সাদা কাপড়ের ঢাকনা ‘মেইকুম’, গায়ে রেশমি ব্লাউজের ওপর জড়ানো সাদা লংকথ ‘থারেং’ ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া ছোটখাট বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার বিশেষ করে চন্দন, ধূতিসহ পায়ে নুপুর ব্যবহার নৃত্যকে কমনীয়, আকৃষ্ট ও মোহাবিষ্ট করে তোলে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাঝে মাঝে স্বর্ণালংকারও ব্যবহার করা হয়।

শ্রীমদভগবত থেকে জানা যায়, রাধা-কৃষ্ণের রাসলীলা ১০টি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
যেমন :
বংশী সংজল্পিত মনরতং রাধয়ান্তদ্ধি কেলিঃ
প্রাদুর্ভয়া সনমধিপটং প্রশ্নকুটোত্তরঞ্চ।
নৃত্তোল্লাসঃ পুনরপরিহঃ ক্রীড়নং বাড়িখেলা,
কৃষ্ণারন্যে বিরহনমিতি শ্রীমতি রাসলীলা।

রাসলীলার ১০টি অঙ্গ :
১. বংশীধ্বনি, ২. সংজল্পন, ৩. রমণখেলা, ৪. অন্তর্ধান, ৫. আবির্ভূত আসনে বসন, ৬. প্রশ্ন কুটোত্তর, ৭. নৃত্যল্লাস, ৮. কুঞ্জেরহ, ৯. বাড়িখেলা ও ১০. বনবিহরনম।

রাধাগোবিন্দের লীলার ৪ প্রকার বিরহ এবং ৪ প্রকার মিলন হয় :
বিরহ : ১. পূর্বরাগ, ২. প্রেমবৈরিত্য, ৩. মান ও ৪. মাথুর।
মিলন : ১. সংপ্তি, ২. সম্পন্ন, ৩. সম্পূর্ণ ও ৪. সমৃদ্ধিমান।

এক প্রকার বিরহের এক প্রকার মিলন হয়ে থাকে। বিরহে যত তীব্রতা, মিলনের তত গভীরতা হয়। লীলানুকরণের কালে শ্রীরাধা ও গোপীদের বিরহের সমবেদনায় অনেক শ্রোতা কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

মৌলভীবাজারের মাধবপুরের রাসলীলা

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামন্ডপে যেতে হলে কমলগঞ্জ সদর থানার সম্মুখ থেকে ভানুগাছ/পাত্রখোলা সড়ক ধরে ৩/৪ কিলোমিটার অগ্রসর হলেই হাতের বামে দেখা যাবে ললিতকলা একাডেমী। একাডেমীর পাশেই শিববাজার নামে একটি বাজার রয়েছে। এ বছর ২১ নভেম্বর রোববার এই জোড়ামন্ডপে রাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে। রাসলীলার ভক্ত পুণ্যার্থীদের সাথে একটু সামনে গেলেই দেখতে পাবেন পর পর তিনটি মন্ডপ। এই তিনটি মন্ডপের নামই জোড়ামন্ডপ।

রাসলীলা দুই ভাগে বিভক্ত : গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলা। গোষ্ঠলীলায় কৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চড়াবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখোয়াল’ বলা হয়ে থাকে। রাসলীলায় অভিনীত হয় ‘গোপীনৃত্য’। গোপীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলাকেই এই পর্বে অভিনয় করে দেখানো হয়। রাসলীলাকে ‘পূর্ণিমারাস’ও বলা হয়ে থাকে। স্থানীয়ভাবে এখানে বেলা ১১টায় একযোগে ৩টি গোষ্ঠলীলা অনুষ্ঠিত হয়। রাত ১০টা থেকে শুরু হয় জোড়ামন্ডপের তিনটি রাস।

ঐতিহ্যবাহী রাসলীলাকরণই মণিপুরীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। মহারাসলীলানুকরণ জোড়ামন্ডপের বাইরের মাঠে কলাগাছে সুসজ্জিত তিনটি মঞ্চে তিনটি গোষ্ঠলীলা অনুষ্ঠিত হয়। বালকেরা রাখাল সেজে নৃত্য ভঙিমায় শ্রীকৃষ্ণের বাল্যজীবনের বহু ঘটনাই এই নৃত্যানুষ্ঠানে ফুটিয়ে তোলে। গোষ্ঠলীলায় অংশগ্রহণকারী বালক রাখালদের মাথায় বেশভূষা থাকে অপূর্ব সুন্দর। মাথায় কারুখচিত ময়ূরপুচ্ছে সুশোভিত কৃষ্ণচূড়া, হাতে কারুকার্য্যময় বাঁশি থাকে। রাসলীলায় পোশাক থাকে শ্রীকৃষ্ণের মতোই। খোল-মৃদঙ্গের তাল আর রাখাল বালকদের ললিত নৃত্যে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভরা দুপুরের টকটকে সূর্য। রাসলীলায় তিনটি মন্ডপ তৈরি করা হয়, বাঁশ এবং বিভিন্ন রঙের কাটা কাগজের নকশা দিয়ে। এই নকশাখচিত মন্ডপে যুবতী গোপীনীদের নৃত্যে প্রাণময় হয়ে ওঠে সারা রাত। ভক্ত-পুণ্যার্থীরা গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে বাতাসা, টাকা-পয়সা ‘পুষ্পবৃষ্টি’ বা হরিলুট করতে থাকেন নৃত্যরত রাখাল ও শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধা এবং গোপিনীদের ওপর। এই গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলাকে কেন্দ্র করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় অর্ধ-লাধিক মানুষ সমবেত হন। তাদের পদচারণায় দিনরাত অপূর্ব এক মিলনমেলায় পরিণত হয় মাধবপুরের জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গণ এবং গোটা শিববাজার এলাকা। মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলে পুরনো সেই তালপাতার বাঁশি, ঝমঝমি, চূড়ি ও নানারকম মাটি এবং বেতের খেলনা-আসবাবপত্র। এখানে রাসলীলা দেখে মাধবপুর চা বাগানে যেতে পারেন। মাত্র দু কিলোমিটার পথ এবং চা বাগানের ভেতর দিয়ে এঁকেবেকে যাওয়া এক সুদীর্ঘ লেকও দেখতে পারেন। যে কেউ রাসলীলা, মাধবপুর চা বাগান ও লেক দেখে রথ দেখা ও কলা বেচা সম্পন্ন করতে পারেন।
 
মণিপুরীদের অনেকের সাথে আলাপকালে জানা যায়, প্রায় এক যুগ আগে মণিপুরীদের মধ্যে জাতিগত অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে এক পর্যায়ে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ও মৈতৈ মণিপুরী’ এই দু ধারায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মৈতৈ মণিপুরীরা আলাদাভাবে আদমপুরে অবস্থিত শানা ঠাকুরের মন্ডপে ১০-১১ বছর ধরে রাসলীলা অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। তবে ঐতিহাসিকতা ও লোকসমাগম এবং ব্যাপক পরিচিতির কারণে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যুষিত এলাকা মাধবপুরের মহারাসলীলানুকরণ প্রতি বছর জনসমুদ্রে পরিণত হয়। স্থানীয় মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন অনুষ্ঠানকে সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য মাসাধিককাল নিরলস সাধনায় নৃত্য-গীত সাধনা করে থাকেন।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০১০, নভেম্বর ১৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।