ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

সুন্দরবনের গল্প

বাঘ আইসে কইলে হালুম!

এমএকে জিলানী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১০
বাঘ আইসে কইলে হালুম!

‘মোরা গাছ কাটতে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকছিলাম। বছর ৪-৫ আগে হইবে।

বাঘ আইসে কইলে হালুম। আর পেছনে চাইয়া দেহি শাজাহানের ভাই নাই। বাঘে তারে ধইরা দিচে দৌড়। আমরা তাড়াতাড়ি কোনো রকমে আগুন ধরাইয়া জোরে চিল্লাচিল্লি শুরু করলাম। বাঘের পিছন পিছন গেলাম শাজাহানের ভাইরে ছুডাইয়া আনতে। বাঘ আমাগো টের পাইয়া কেওড়া বন দিয়া গেছে। পরে শাজাহানের ভাইরে আর পাওয়া যায় নাই। অনেক খুইজজা তার লুঙ্গি পাইছি, হেইডাতে রক্ত আর রক্ত। আর একটা ঠ্যাং পাইছি। বাঘে ঠ্যাংডার মাংস খাইয়া ঠ্যাং থুইয়া বাকি লাশ লইয়া গেছে। ‘

সুন্দরবনের বাঘের ভয়াবহতার চাক্ষুষ বর্ণনা এভাবেই দিলেন শরণখোলার জাফর মাঝি।

আমরা বাউন্ডুলে ১১ বন্ধু গত রোজার ঈদের পরদিন সুন্দরবন ভ্রমণে বেড়িয়েছিলাম। ছিলাম আটদিন। আমাদের বিটিইএফ (বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপানশন ফোরাম) নামে একটি সংগঠন আছে। পকেটে কিছু টাকা জমলে আর যে কোনো বাহানায় ছুটি জোগাড় করতে পারলেই আমরা দেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লেগে যাই।

সুন্দরবরে আমাদের এগারোজনের সঙ্গে চৌদ্দজন গাইড ছিল। এদের মধ্যে চারজন বন বিভাগের। আর বাকিরা সুন্দরবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এদের মধ্যে কাঠুরিয়া, মৌয়াল, জেলে, শিকারি, মাঝি ছিল। তাদের সুন্দরনের নাড়ি-নক্ষত্র মুখস্থ।

সুন্দরনের পূর্বপ্রান্ত শরণখোলা রেঞ্জের প্রায় ৬০ শতাংশ জঙ্গল এবার ঘুরেছি। শরণখোলার ধাবুরি খাল, মরাভোলা খাল, ভোলা নদী, সুপতি বন অফিস, আড়–য়াবিন্দি খাল, বাদামতলা খাল, আড়াইবানি খাল, কালার খাল, ডোরা খাল, বড় সুন্দরী খাল, বেতসার গাঙ, চাপড়া খাল, টিয়ার চর, চানমিয়া ভারানী, কস্তুরী ভারানী, খাজুরিয়া ভারানী, পাতাকাটা খাল, বড় কেচুয়ার খাল, নলবুনিয়া খাল, পাথুরিয়া নদী, দুধমুখী গাঙ এবং আড়াবাঁকি খালে গিয়েছি। এছাড়া ডিমের চর, কটকা ও কচিখালীও ফিরতি পথে ঘুরেছি।

শরণখোলার সুপতি বন অফিস, ধাবুরি খাল, মরাভোলা খাল, ভোলা নদী ও আড়াইবানি খাল হয়ে যাত্রার দ্বিতীয় দিন বিকেলে আমরা টিয়ার চরে নামি। টিয়ার চরে নামার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল প্রচন্ড বৃষ্টি। টিয়ার চরে নেমেই আমরা বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পাই। সবাই তো হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছাপ দেখার জন্য। ছাপ দেখার সঙ্গে সঙ্গে সবাই যেন ভয়ে কেমন হয়ে গেল। বাঘ যে পথে গেছে সবার অলক্ষ্যে মৌয়াল ইব্রাহিম ভাই সেদিকে যে কখন চলে গেছে কেউ টেরও পাইনি। হঠাৎ বন বিভাগের গার্ডরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাকে ওই দিক থেকে ডেকে নিয়ে এল। আর বাঘ যেদিকে গেছে আমাদের কায়দা করে উল্টোদিকে নিয়ে গেল।

আমরা টিয়ার চর থেকে ফিরে এসে রাতে বুঝতে পারলাম যে ওইখানে নামার পর বাঘের পায়ের ছাপ দেখে এতটাই এলোমেলো হয়ে যাই যে, বাঘ যেদিকে গেছে ওইদিকে না গিয়ে সবাই উল্টোদিকে গিয়েছি।

পরদিন সারাদিন বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই চাপড়া খাল গেলাম। সঙ্গে থাকা ছোট ডিঙ্গি নিয়ে ভারানির (খুব চিকন ও সরু খাল) ভেতর ঢোকার চেষ্টা করলাম। কিছুদূর গিয়ে আর এগোনো সম্ভব হলো না। ভারানির বিভিন্ন জায়গায় গাছ পড়ে আছে, যা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

পাহাড়ে, বান্দরবানে, মধুপুরে, টেকনাফে, মাতামুহুরিতে অনেক অনেক বনজঙ্গল ঘুরেছি। কিন্তু সুন্দরবনের মতো অন্য কোথাও জঙ্গলের স্বাদ পাইনি। সুন্দরবনে ঢুকতেই গা কেমন ছমছম করে উঠে। থেতালের বন, তেওড়া বন, গোলপাতার ঝোপের পাশাপাশি সুন্দরী আর গেওয়া গাছ। এগুলো ভেদ করে জঙ্গলের গভীরে ঢোকা এককথায় অসম্ভব।

ভারানিতে ঢোকার সময় কতগুলো বানর দেখলাম। একটি বানর লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিল। আমরা তাকে দেখে ফেলতেই বানরটি মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে দিল দৌড়।

চাপড়া খালে বিকেল পর্যন্ত ঘুরে কোথায় কোথায় আমাদের মাচা বানাব ঠিক করে নৌকায় (বড় আকারের ট্রলার বা একতলা লঞ্চ বলা চলে, তার সঙ্গে দু দিকে দুটো ছোট ডিঙ্গি ছিল) চলে এলাম। সারাদিন টানা বৃষ্টির পর সন্ধ্যা থেকে আকাশ পরিষ্কার। নৌকার ছাদে গল্প শুরু হলো।

পরদিন আমরা মাচায় থাকব। মাচায় কীভাবে থাকতে হবে, জঙ্গলে নামলে কী করতে হবে এগুলো সঙ্গে থাকা শিকারি সাতক্ষীরার তোফাজ্জল ভাই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

তোফাজ্জল ভাই বললেন, জঙ্গল এত ঘন যে বিড়াল বা ছোট প্রাণী চলাচল করতে পারে। মানুষ পারে না। কিন্তু আমরা শিকারিরা আবার পারি। আমরা শিকারিরা নিঃশব্দে আবার শব্দ করেও জঙ্গল দিয়া যাইতে পারি। আপনারা পান্ডটা যে ফেলবেন, এরও একটা নিয়ম আছে। কায়দা করে না ফেললে কাদার শব্দ হবে।

সবাই নিঃশব্দে শিকারি তোফাজ্জলের কথা শুনছি : আপনারা যে মাচায় থাকবেন, ওইখানে হরিণ, বাঘ বা যে কোনো জন্তু আসুক, নিশ্বাস বন্ধ রাখতে হবে, যাতে শব্দ না হয়। সিগারেট কিন্তু খাওয়া যাবে না, জঙ্গলের গন্ধ নষ্ট হয় এমন কিচ্ছু করা যাবে না। শব্দ করলে, ওরা যদি টের পায় যে এইখানে অন্য কিছু (মানুষ) আছে তাইলে কিন্তু চলে যাবে আবার আক্রমণও করতে পারে।

মূল গাইড শাজাহান বললেন, সিগারেট আর মানুষের গন্ধ পাইলে আসবে না। বাতাস যেদিক থেকে আসে সেদিকে মুখ করে থাকতে হবে। বাতাসের উল্টা দিক থেকে হরিণ আসে না। নড়াচড়া করা যাবে না। কিছু ঘটলে বা কথা বলার প্রয়োজন হলে নিঃশব্দে আকার-ইঙ্গিতে বা শিস দিয়ে জানাতে হবে।

সঙ্গে থাকা আরেক শিকারি নুরু ভাই এ সময় বললেন, চান্দেশ্বরের নামায় দরজার খালে একজন দরবেশ ছিল। সবসময় ল্যাংটা থাকত। ওইখানে একটা তালগাছ আছে। ওইখানে বাঘও থাকত। ওই দরবেশ কথা কম কইত। তারে একবার জিগাইছিলাম, এইখানে বাঘের লগে থাকতে আপনের ভয় লাগে না। সে কিছুই কয় না। এখন আর তারে দেখি না। ৫-৬ বছর আগেও তারে দেখছি। তিনি যে কোথায় গেছেন কেউ জানে না।

তোফাজ্জল ভাই বললেন, একবার চরখালীতে শিকারে নামছি। শিকারে গেলে বড় বড় গাছের ডালে বইসা থাকি। আমাদের সাথের একজন পেশাব করতে নিচে নামছে। আগেই টের পেয়ে পাশের বড় ঝোঁপে বাঘ আমাদের দিকে খেয়াল রাখছিল। আমরা কিন্তু টের পাইনি। যেই না সে নিচে নামতে যাচ্ছে ওমনি বাঘ ভননন করে ঘুইরা আইসা একটার কচার ওপর বসল (সুন্দরী গাছ)। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে আর ঘোঁতঘোঁত আ আ আ আ করতেছে। আমরা পাইন গাছের আরও ওপরে উঠে গেলাম। গাছে উঠে গুলি করি, কিন্তু মামা তো যায় না। সারারাত গাছেই বইসা ছিলাম। বাঘও সারারাত বইসা ছিল। রাত পোহালে বেলা উঠল। ১০-১২ জন লোক হাঁকডাক দিয়া কাঠ কাটতে যাচ্ছিল। খুব কষ্টে ওদের সহায়তা নিয়া আমরা ওইবার ওইখান থেকে মুক্তি পাইলাম।

নুরু শিকারি বললেন, আগে স্বরূপকাঠিতে জ্বালানি কাটতাম। তখন ওইখানে ১০ জন নামলে তার মইধ্যে একজনরে বাঘে নিয়া যাইত। আমরা রাত্রিতে গাছে টঙ বানাইয়া থাকতাম। হঠাৎ টঙ থেইকা একজনের ঘাড় ধইরা বাঘ লাফ মারল। খালে তখন পেরি (কাদা) ছিল। লাফ দিয়া পেরিতে পড়লে ওর মইধ্যে গাইরা (গেঁথে) গেল। কিন্তু এর মধ্যেই বাঘ ওই লোকটারে টাইননা নিয়া চইলা গেল। আমরা কিছুই করতে পারলাম না।

বনবিভাগের এক রক্ষী বললেন, ২০০৭ সালে ক্যাম্প অফিসের অল্প বয়সের একটা ছেলে (১৮-২০ বছর) কাঁকড়া ধরতে সকালবেলা একা একা গেছে। বিকেলে যখন আসতেছে না তখন অনেক খোঁজাখুঁজির পর ছেলেটার এক পা আর শরীরের একদিকের অংশ পাওয়া গেল।

নুরু শিকারি জানালেন, বাঘ ধরলে পুরুষাঙ্গটা আর তলপেট আগে খায়। যত লাশ দেখছি সব এমনই দেখছি। বাঘ যখন কামড় দেয় তখন ওইটা নড়ে। নড়লে বাঘ মনে করে জ্যন্ত আছে। তখন ওইটারে আগে খায়।

এই সময় জিপিএস দেখে রিপন বলল, বন্ধুরা প্রেসার বেড়ে গেছে। যে কোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে। কিন্তু কিসের বৃষ্টির ভয়। আমরা তখন সুন্দরবনের গল্পে বিভোর।

জাফর ভাই বললেন, চরখালীতে একবার বাঘ পানি খাইতে নামলে কুমির পায়ে কামড় দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধরে রাখতে পারেনি। বাঘ ছুটে চলে যায়। রিপন বলল, এজন্যই বলে জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। রিফাত ভাই খোঁচা মেরে বললেন, জিলানী চানটান দেইখা কইছিল, আজ রাতটা ভালো আছে, বৃষ্টি-টৃষ্টি নাই, এমন রাত আর আইবো না। মামা তোমার কথামতো আজ রাতে মাচায় গেলে এহন কী অবস্থা হইত বুঝছো।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাগর, কিশোর, মুন, দুজন বনরক্ষী, শিকারিসহ আটজন জঙ্গলের সুধা পান আর বাঘ দর্শনে মাচায় গেল। বাকিরা দ্বিতীয় মাচা বানানোর জন্য চাপড়াখালী খালের শুরুতে সাভানাঘেষা অঞ্চল ঘুড়ে বেড়াচ্ছি। সাভানা অঞ্চলে কাশবন দেখে সবাই এত মুগ্ধ যে, বাঘের ভয় ভুলে সবাই এলোপাথাড়ি বনের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছি।

সবুজের মাঝে রুপালি আলোর ঝিলিক। গ্রীষ্মের বাতাসে কাশবনে ঢেউয়ের তাল উঠেছিল (তখন উপকূলীয় অঞ্চলে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত চলছিল)। পাশেই হেতাল বন। হেতাল আর কাশবনের মধ্যিখানে সামনে সাভানা অঞ্চল রেখে দ্বিতীয় মাচা বানানোর সিদ্ধান্ত হলো।

হেতালের বনের সামনে গোলপাতার ঝোঁপ। আমাদের গোলপাতার ফল খাওয়ালেন জাফর ভাই। গাঢ় লাল রঙের জমিদারি ভাবের ফলটি তালকোসের মতো। খেতে নরম এবং সুমিষ্ট। জেলেরা মাছ ধরার সময় গভীর জঙ্গলে ঢুকলে অনেক সময় খাবার ফুরিয়ে যায়। তখন এই ফল খেয়ে দিন পার করে। কিছু ফল আমরা সাথে নিয়ে নিলাম পরে খাওয়ার জন্য।

চতুর্থ দিন বিকেলে আমি, গনি ভাই, রিফাত ভাই, শাহিন ভাই, রবিন ভাই, শিকারি তোফাজ্জল ভাই, দুজন বনরক্ষীসহ মোট ১০ জন মাচায় উঠলাম। রিফাত ভাই বলল, মামা সারারাত থাকতে হইব, আগে থাইকা বুইঝা লও। বিকেল থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত সবাই মাচায় ছিলাম।

সুন্দরবনের যে অপরূপ রূপ তা বলে বোঝানো যাবে না। বুঝতে হলে ওইখানে গিয়ে থাকতে হবে। বিকেল থেকে সময় যত গড়াচ্ছিল ততই গা ছমছম করছিল। অজানা ভয় আর অজানা স্বাদ আস্বাদনে সবাই তখন উত্তেজিত থাকলেও দৃশ্যত শান্ত, নিঃশব্দ এবং এমনভাবে ছিল, যাতে একটি পাখিও টের না পায়।

মাচায় উঠার ত্রিশ মিনিটের মধ্যে দেখলাম ছোট একটি হরিণের দল আসছে। সামনে একটি বাচ্চা হরিণ। পেছনে কয়েকটি মেয়ে হরিণ এবং তার পেছনে কয়েকটি শিঙওয়ালা ছেলে হরিণ। হরিণগুলো কেওড়া পাতা খেতে খেতে সামনের দিকে আসছিল আর আনন্দে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এরকম দৃশ্য কখনো দেখিনি কিন্তু পরিস্থিতি এমন প্রাণ খুলে তখন কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাচ্ছিল না। কারণ শব্দ হলেই যে ওরা চলে যাবে। সামনের বাচ্চা হরিণটা কান দুটো খাড়া করে কিছুক্ষণ সামনে তাকিয়ে পেছনের লেজটা নেড়ে অনেক সাবধানে সামনের দিকে পা বাড়াচ্ছিল। পেছনের মেয়ে হরিণগুলো কিছুটা সতর্ক থেকে কেওড়া পাতা খেতে খেতে বাচ্চা হরিণের পেছন পেছন আসছিল। আর ছেলে হরিণগুলো উদাস এবং ভাবনাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কাছে আসতে আসতে হরিণের দল যখন একেবারে মাচার কাছে চলে এল, তখন বাচ্চা হরিণটা আমাদের টের পেয়ে কানটা খাড়া করে লেজটা শক্ত করে উঁচিয়ে দৌড় দিল। পেছন পেছন বাকিরাও দৌড়।

সারারাত মাচায় বসে আছি বাঘ দেখব বলে। কিন্তু জঙ্গল এমন অন্ধকার ছিল যে মাচা থেকে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এতে গা আরও ছমছম করে উঠল। সারারাত জঙ্গলের ঝিঁঝি শব্দ আর মাঝেমধ্যে হরিণের ডাক। ফাঁকে ফাঁকে কিছু শব্দ কিন্তু অন্ধকার থাকায় শব্দগুলো কিসের তা বোঝা যায়নি।

মাঝরাতে হঠাৎ একটি হরিণ শাবক চেঁচিয়ে উঠল। টানা প্রায় আধ ঘণ্টা গলা ছেড়ে চেঁচাল। চিৎকার শুনে মনে হলো শাবকটা হয় কোথাও আটকা পড়েছে, নয় পথ ভুলে একা হয়েছে, আবার এমন মনে হলো যে বাঘে ধরেছে। হরিণের চিৎকার শুনে মাঝরাতে সবাই নড়েচড়ে বসলাম। অন্ধকারে একজন আরেকজনকে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস হলো না। মনে হচ্ছিল আশপাশেই বাঘ আছে। শব্দ করলেই ঘাড় মটকে দেবে।

সকালে মাচা থেকে নামার সময় বৃষ্টি শুরু হলো। রাতের অভিজ্ঞতায় সবাই যেন বাকহীন। কারো মুখে কোনও কথা নেই। বৃষ্টিতে ভিজে নৌকা দিয়ে ভারানির ভেতর থেকে বের হওয়ার পথে কয়েকটি জেলে নৌকা পাওয়া গেল। জেলেদের থেকে শুধু মরিচ আর লবণ দিয়ে রান্না করা ইলিশ খেলাম। শুধু মরিচ-লবণের ইলিশও যে এত মজার হতে পারে তা কখনো কল্পনাতেও ভাবিনি।

ফেরার আগের দিন রাতে কটকার ওয়াচ টাওয়ারে আমি, রবিন আর রিফাত ভাই সারারাত ছিলাম। বাকিরা সবাই নৌকায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারি বর্ষণ। আমাদের সঙ্গে পলিথিন ছিল। শীতের রাতে গায়ে যেভাবে লেপমুড়ি দিয়ে শোওয়া হয়, আমরা তিনজন পলিথিন মুড়ি দিয়ে বৃষ্টি ঠেকাই। রাত শেষে দেখলাম আলো ফোটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হরিণের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন দিকে হরিণের পাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘাস খাচ্ছে।

কটকা থেকে বিচ পথে ১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা কচিখালী গেলাম। যাওয়ার পথে সিডরের তান্ডব চোখে পড়ল। বন বিভাগের কংক্রিটের স্থাপনা সিডরের আঘাতে নিঃশেষ হওয়ার চিহ্ন এখনো রয়েছে। শুধু কটকা বা কচিখালী নয় চাপড়া খাল, টিয়ারচরসহ যেখানেই গেছি সিডরের আঘাত চোখে পড়েছে।

ফেরার আগের দিন গেলাম ডিমের চরে। ডিমের চরে নেমে মনে হলো এটা জঙ্গল না, ওখানে রীতিমতো জেলেদের মেলা। সুন্দরবনের পূর্বপ্রান্তের বেশিরভাগ জেলেদের আস্তানা হল ডিমের চর। ওখানে আবার নৌকার মধ্যে ভ্রাম্যমাণ দোকানও আছে। ওই দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিস পাওয়া যায়। আমরা ওই দোকানিকে দিয়ে গুলগুল্লা বানিয়ে তৃপ্তিভরে খেলাম। শুধু তাই নয়, রাতের বেলা জঙ্গলের ওই দোকান থেকে ফিজআপ এনেও খাওয়া হলো!

ফেরার পথে আমরা প্রচন্ড রোলিংয়ে (নিম্নচাপ) পড়েছিলাম। আমাদের নৌকাটি দোলনার মতো দুলছিল। তখন মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম, যে কোনো সময় প্রাণভোমরাটি উড়াল দিতে পারে। লাইফ জ্যাকেট নিয়ে এমনভাবে প্রস্তুত ছিলাম যাতে যে কোনও মুহূর্তে নিজেকে বাঁচাতে ঝাঁপ দিতে পারি।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫০৫, নভেম্বর ১৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।