ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

রিকশার চাকা ও জীবনের চাকা

সোহেল রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১০
রিকশার চাকা ও জীবনের চাকা

আকাশের ঠিক মাঝামাঝি স্থান থেকে প্রখর রোদ্দুর ছড়াচ্ছিল সূর্যটা। টাটকা ঝাঁঝালো রোদ।

সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে যাত্রীর আশায় একঠাঁই দাঁড়িয়ে সালাম। তার কচি কোমল হাত দুটো রিকশার হাতলে। চোখেমুখে রাজ্যের উৎকন্ঠা। দেড়শ টাকা হবে তো দুপুরের মধ্যে! নইলে মায়ের চিকিৎসার ওষুধ যে জুটবে না! সকালে দু মুঠো পানতা খেয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিল ১১ বছরের সালাম।

একটু পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী  এসে চেপে বসল সালামের রিকশায়। সালাম রিকশার প্যাডেলে পা রেখে টানতে লাগল ওদের। ছোট্ট তুলতুলে সালামের মত দশ বছরের সালমান, কামাল, নয় বছরের আলাল, লালন, বারো বছরের তাজুসহ এমন আরো প্রায় পঁচিশ জন শিশু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাদিন রিকশার চাকা ঘুরিয়ে সচল রাখে তাদের জীবনের চাকা। রিকশার চাকা না ঘুরালে ভাত জুটে না ওদের কারোরই।

আট বছরের রফিক খুব চেষ্টা করেছিল রিকশা চালাতে। পারেনি। তার পা কোনওমতেই রিকশার প্যাডেলের নাগাল পায় না। শেষমেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রহলের ক্যান্টিনে মাসিক তিন শ টাকা হারে চেয়ার-টেবিল মোছার  কাজ নেয় রফিক। ক্যান্টিনে গিয়ে দেখা যায় রফিকের সঙ্গে কাজ করছে তার সমবয়সী শোয়েব, পিয়ার, খালেদসহ আরো এগারোজন শিশু।

সালাম-রফিকরা সবাই মিলে প্রায় একশজন। ওরা সবাই সুবিধাবঞ্চিত শিশু। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ ওরা  রিকশা চালায়, কেউ ক্যান্টিনে কাজ করে, কেউ চায়ের টংয়ে চা বানায়, কেউবা পান-সিগারেট বিক্রি করে। একেকজন এসেছে একেক জায়গা থেকে। কারো বাবা নেই, কারো বাবা আছে তো মা নেই। কারো দুজনের কেউই নেই। অভাব-অনটন জীবনের নিত্য ছবি। কাজ করলে ভাত জুটে নতুবা উপোস কাটাতে হয়। অনেকে একাই পুরো সংসার চালায়, অনেকে সংসারে টুকটাক সহযোগিতা করে। আর এভাবেই প্রতিদিন তাদের জীবনে নতুন দিনের সূর্য ওঠে। সকাল হয়। সন্ধ্যা গড়ায়। রাত নামে। মধুর কোনও স্বপ্ন তাদের জীবনকে আচ্ছন্ন করে না। জীবন মানে তাদের কাছে মাস শেষে তিন শ টাকা বেতন, রিকশাযাত্রীর ভাড়া, ক্যান্টিনে খেতে আসা শিকক্ষ-শিক্ষার্থীদের দু-চার টাকার বখশিস।

শিশুগুলোর নিষ্পাপ চেহারায় স্বর্গীয় দ্যুতি। সারা দিনের অকান্ত পরিশ্রমে ভারী হয়ে ওঠে তাদের নিঃশ্বাস। দেখলে মনে হয় মায়ের দুধের গন্ধ যেন এখনো লেগে আছে ওদের ঠোঁটে-মুখে। ক্যান্টিনের কাজে একটু উনিশ-বিশ হলেই নরম মুখে পড়ে সজোরে থাপ্পড়। চলে শারীরিক নির্যাতন।

‘কিতা করি আর? পেটে তো খানিওনি কিছু দিতে হয়। ঘরে খানি নাই। ক্যান্টিনে কাজ কাম কইরা খানিও পাই, ট্যাহাও পাই। কষ্ট কইরা তাই কাজ কররাম। ’ ক্যান্টিনের চেয়ার টেবিল মুছতে মুছতে কথাগুলো বলল রফিক। মোছামুছির কাজ শেষ হলে এক ফাঁকে গিয়ে সে  দাঁড়ায় টিভির সামনে। হলের কিছু শিক্ষার্থী তখন খেলা দেখছিল টিভিতে। তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টিভি দেখে রফিক। হঠাৎ ডাক পড়ে ক্যান্টিন ম্যানেজারের। রফিক বুঝতে পারে এটি তার শখ মেটানোর সময় নয়। তড়িঘড়ি করে দৌড় দেয় কাজে।

শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির ভেতর এদের জীবন কাটে। কাজের ফাঁকে একটু উঁকিঝুকি দিয়ে দেখে সুন্দর জামাকাপড় পড়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পড়াশোনা নিয়ে বিভোর তারা। অথচ এসব শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই তাদের জীবন কেটে যাচ্ছে শিক্ষাহীন, ভবিষ্যৎহীন।

মনের আড়ে তাদের সুপ্ত বাসনা। যদি একটু অন্তরঙ্গ হওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ভাইয়া বা আপুর সঙ্গে! কেউই এরা দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর বেশি পড়তে পারেনি। তবু এদের বুকে নাড়া দেয় স্কুলে পড়ার প্রবল ইচ্ছা।   অগোচরে তাদের ভেতর তাড়া করে ফেরে বড় হওয়ার ব্যাকুলতা।

‘স্কুলে পড়তে হইলে তো টাকা দরকার। টাকার অভাবে যেখানে সংসারই চলে না, সেখানে স্কুলের খরচ চালাব কীভাবে? ইচ্ছে থাকলেও তাই স্কুলে যেতে পারি না। এখন বাধ্য হয়ে রিকশা চালাই। ‘ রিকশা চালাতে চালাতে বলল সালাম।

ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে আসা সালাম তার মা, দুই ভাই, এক বোন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ধামালিপাড়ার ছোট্ট একটি ভাড়া ঘরে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সারাদিন রিকশা টেনে পায় একশ থেকে একশ বিশ টাকার মতো। এর মধ্য থেকে ত্রিশ টাকা দিয়ে দিতে হয় রিকশা মালিককে। বাকি টাকা নিয়ে ধুলোমলিন চেহারায় ঘরে ফেরে সালাম।

‘সন্ধ্যার পরে যদি আশপাশের কোনও স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা থাকত তাহলে কাজ করার পর পড়তে পারতাম। কিন্তু সে ব্যবস্থা না থাকায় ইচ্ছা থাকলেও আর পড়তে পারছি না। ’ বলল বারো বছরের রিকশাচালক রাব্বি ও তাজুল।

ক্যান্টিনের পঞ্চাশোর্ধ বাবুর্চি সুজন বলেন, এই কচি বয়সে তাদের বাপ-মারা সংসারের অভাবে এখানে কাজ করতে দিয়ে দেয়। কত কষ্ট করে যে এদের এখানে কাজ করতে হয়, ভাবলে খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই তো করা যায় না। কাজ না করলে ঠিকমতো এদের ভাত জোটে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাশ বলেন, এই বাচ্চাগুলোর অমানবিক শ্রম কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। সরকারের উচিত এদের পরিবারের আয়বর্ধনমূলক কোনও ব্যবস্থা করা বা এই বাচ্চাগুলোকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভেতরে এনে উপার্জনম কোনও প্রশিক্ষণ দেওয়া।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২১৫০, নভেম্বর ১৩, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।