ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

পাহাড়ছোঁয়ার গল্প

তানিন মেহেদি, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১০
পাহাড়ছোঁয়ার গল্প

‘কবে যাবো পাহাড়ে ? আহারে আহারে’। পাহাড় ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিলো সেই ছোটবেলা থেকেই।

চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানে যাওয়ার পথে সেই স্বপ্ন ছোঁয়ার জন্য দূর থেকে পাহাড়গুলো হাত ছানি দিয়ে যেন ডাকে। সারা রাত মেইল ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসায় বাসে বসে সবাই ঘুমে ঢুলু-ঢুলু করছিলাম।

আমরা বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পলাশ, রাজিব, গালিব, মনির, নোমান, মাসুম, সাব্বির, কামরুল, সাদ্দাম এবং আমি। ঢুলু-ঢুলু চোখ নিয়ে বারবার বাইরে তাকাচ্ছিলাম, যাতে প্রকৃতির সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত না হতে হয়। আমাদের গাড়ি কেরানীরহাট অতিক্রম করার পর হঠাৎ ‘পাহাড়’ ‘পাহাড়’ বলে আমার চিৎকারে সবার তন্দ্রা টুটে গেল। সবাই হকচকিয়ে উঠে পাহাড় দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো।

আমাদের গাড়ি দুপুর নাগাদ বান্দরবানে পৌঁছলে আমরা মুরগির মাংস আর সবজি দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে কাইক্ষংছড়ির গাড়িতে উঠলাম। উঠলাম বললে ভুল হবে, ঠিক সময়ে গাড়ির টিকিট না পাওয়ায় সবাই গাড়ির ছাদে চড়লাম। ছাদে বসায় বুঝতে পারলাম ভিতরে সিট না পাওয়ায় পোয়া বারো হয়েছে। ছাদে বসে প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে চলছিলো মিনি ফটোসেশন। প্রত্যেকটি মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দি করতে বারবার ঝলসে উঠছিলো ক্যামেরা।

হাজার ফুট উঁচুতে উঠছি আবার নামছি, প্রতিটি মুহূর্ত চরম উত্তেজনার। দীর্ঘ ২ ঘণ্টা ভ্রমণের পর আমরা কাইক্ষংছড়ি এসে নামলাম। এবার নৌকায় চড়ার পালা, গন্তব্য রুমা বাজার।

ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে আমরা সাঙ্গু নদীর বুক চিরে যাচ্ছিলাম। সূয্যি মামা তখন মাথায় লাল টিপ হয়ে আকাশকে রাঙিয়ে তুলছিল। একটু পড়ে সন্ধ্যা নামতেই মাথার উপরে আকাশ, নদীর দুই ধারে পাহাড় শিরায় শিরায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। মনে পড়ে জাফর ইকবালের সেই বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস ‘টি-রেক্সের সন্ধানে’। নৌকার ছাদে বসে শিল্পী মনির, রাজিব, সামির, গালিব, পলাশ, সাব্বির আর আমি গানের সুরে টান দিতেই নৌকার অন্য সব যাত্রীরাও সুর মেলাতে লাগলেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় আমরা রুমা বাজারের ঘাটে এসে পৌঁছলাম। রুমা বাজারে পৌঁছেই হোটেলের সন্ধানে লেগে গেলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে আমরা ‘কেওক্রাডং’ হোটেলে উঠলাম ।

দশ জনের জন্য তিন রুম নিয়েছিলাম, কিন্তু ঢাকা থেকে আসা সাদ ভাইয়েরা কোথাও রুম না পাওয়ায় আমরা দশজন গাদাগাদি করে দুই রুমে থাকলাম। রাতে সবাই মিলে হোটেলে খেলাম। ওখানকার বাজারে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে আর প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে সবার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গল, ঝটপট প্রস্তুত হয়ে রুম থেকে বের হলাম। সঙ্গে গাইড নিয়ে আমরা চাঁদের গাড়িতে চেপে রওয়ানা হলাম বগা লেকের উদ্দেশ্যে। এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম, দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় হেলে-দুলে চলছে চাঁদের গাড়ি। ড্রাইভারের দক্ষ হাতে উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে খাদের কিনারা বেয়ে যেন এগিয়ে চলছি চাঁদের দেশে। দীর্ঘ পথচলা শেষে আমরা এগারো মাইল এসে নামলাম। এখান থেকে হেঁটে যেতে হয় বগা লেক। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার চললাম বগা লেকের উদ্দেশ্যে।

চলার পথে সবার মনে অ্যাডভেঞ্চারের শিহরণ সব কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছিল। বগা লেকের পথে অনেক পর্যটকের সাথে দেখা হলো। তাদেরকে দেখে আমাদের উৎসাহ আরো বেড়ে গেলো।

পাহাড়ি পথে না গিয়ে আমরা ঝিড়ি পথ [ছোট ছোট জলপ্রপাত তার মধ্য দিয়ে রাস্তা] দিয়ে যেতে যেতে দারূণ উপভোগ করলাম প্রকৃতির বিশাল নিসর্গ। দীর্ঘ পথচলা শেষে দুপুরে আমরা বগা লেকে পৌঁছলাম, এক রাশ অবসাদ নিয়ে উঠলাম লারাম গেস্ট হাউসে। এখানে একটু বলে রাখা দরকার, বগা লেক দারুণ পর্যটন স্পট হওয়া সত্ত্বেও এখানে সরকারী উদ্যোগে কোন গেস্ট হাউস গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘ পথ ভ্রমণের পর আমরা বগা লেকে গোসল করে আতপ চালের ভাত, সবজি আর ডিম ভাজি দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। একটু পরেই বৃষ্টি নামলো, পাহাড়ি বৃষ্টির সৌন্দর্যটাই যেন একটু ব্যতিক্রম।

বিকেলে বৃষ্টি থামার পরে আমরা চিংড়ী ঝরনায় গেলাম। চিংড়ী ঝরণা দেখে মুগ্ধ হলাম। সেখানে মজা করে অনেক ছবি তুললাম, তারপর ফিরে এলাম রেস্ট হাউসে। পর দিন সূর্য ওঠার সাথে সাথে রওয়ানা হলাম কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশ্যে।

এবার সঙ্গী হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের চার জন- রিয়াদ, হেলাল, শাফি এবং সজীব। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা পথচলার পর দার্জিলিং পাড়ায় এসে চা খেলাম। পাহাড়ে ওঠার বাকে বাকে আমরা যেন মেঘের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।
সকাল দশটায় আমরা উঠে পড়লাম কেওক্রাডং-এর চূড়ায়। সবার চোখে মুখে তখন আনন্দের ঝিলিক। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে সবাই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। কেওক্রাডংয়ের উপরে বসে সবাই এই স্মরনীয় মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দি করতে দেরি করলাম না।

পাহাড় থেকে ফরার সময় একটি গান শুধু বারবার মনে পড়ছিলো, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’।

বাংলাদেশ সময়:১৮১৯ ঘন্টা, নভেম্বর ৭,২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।