ঢাকা, শনিবার, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৪ মে ২০২৫, ২৬ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

কলম্বাসের আগে মুসলমানরা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল: সামিরা বেনতুরকি

মূল: খালিদ সাদ জগলুল, ভাষান্তর: মহিউদ্দীন মোহাম্মদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৮, মে ২৪, ২০২৫
কলম্বাসের আগে মুসলমানরা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল: সামিরা বেনতুরকি

সামিরা বেনতুরকি সাইদি একজন অসাধারণ আলজেরিয়ান বুদ্ধিজীবী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ক্যামেরাওম্যান, সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে স্বাধীন গবেষক। তিনি পাবলিশিং হাউস এবং অডিওভিজ্যুয়াল প্রোডাকশন কোম্পানি WWW&I (ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়ার্ডস অ্যান্ড ইলাস্ট্রেশনস) এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

তিনি বহু বই ও নিবন্ধ লিখেছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি টেলিভিশন প্রোগ্রাম তৈরি করেছেন। তার আগ্রহের মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক ইতিহাস, শিল্প, ফটোগ্রাফি, বইয়ের চিত্রায়ন ও যোগাযোগ।

তিনি আরব ও মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস, সেইসাথে কালো আফ্রিকান এবং নেটিভ আমেরিকান সভ্যতার পুনর্গঠনের জন্য নিবেদিত। তার গবেষণার ক্ষেত্র সমগ্র বিশ্বে আরব ও মুসলিম সভ্যতার অবদানের সাথে সম্পর্কিত। তবে প্রধানত সামুদ্রিক ক্ষেত্রে, সেইসাথে ইসলামের আগে ও পরে আরবদের দ্বারা পাঁচটি মহাদেশে মানব সমাজে প্রেরণ করা জ্ঞান প্রসঙ্গে।

সামিরা বেনতুরকি সাইদি আরব-মুসলিম নেভিগেটরদের ওপর কাজের একটি সংকলন প্রস্তুত করছেন। এটা আজকের ও আগামী প্রজন্মকে সামুদ্রিক বিনিময় এবং বিশেষ করে সমুদ্র ও মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে একটি অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করার অনুমতি দেবে। উদ্দেশ্য মুসলমানদের সাংস্কৃতিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা।

অন্যদিকে, তাঁর আরবি, ইংরেজি, হিস্পানি এবং ফরাসি ভাষায় সাবলীল ও বহুসাংস্কৃতিক পরিবেশে দীর্ঘ পেশাদার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই ভদ্রমহিলা আরবি ম্যাগাজিন আল মাজাল্লাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন খালিদ সাদ জগলুল। সাক্ষাৎকারে সামিরা বেনতুরকি দাবি করেন কলম্বাসের আগে মুসলমানরা আমেরিকা আবিষ্কার করে। এই দাবি অনেক ঐতিহাসিকই করেছেন। কিন্তু সামুদ্রিক ইতিহাস জানা এমন একজন পণ্ডিতের মুখ থেকে এই প্রথম তা শোনা গেল। ২০২১ সালের নভেম্বরে আল মাজাল্লায় প্রকাশিত বেনতুরকির সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন মহিউদ্দীন মোহাম্মদ। আসুন সাক্ষাৎকারটিতে প্রবেশ করি।

প্রশ্ন: আপনি এই সামুদ্রিক গবেষণায় কীভাবে এলেন?

সামিরা বেনতুরকি সাইদি: আমেরিকার জনগণ বাকি বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বা তাদের সভ্যসমাজে প্রবেশের সুযোগ নেই বলে যে মত, তা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। তদুপরি, আমি খুব তাড়াতাড়ি লক্ষ্য করি, আরব ও মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভুল তথ্য রয়েছে। তাই উপস্থাপিত সংস্করণগুলি বিবেচনায় নেওয়া ও ডেটা তুলনা করার সময় আমি আমার নিজের গবেষণার ওপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নিই। কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অর্থগুলো বুঝতে শিখে আমি তাদের মধ্যে পার্থক্য করতে পেরেছিলাম। তখন আমার জন্য বুঝে নিতে খুব সহজ হয়েছিল যে, সবকিছুই আসলে ইতিহাসচর্চা বা ইতিহাস রচনার পদ্ধতির বিষয়। যেই মুহূর্তে আমরা অন্যান্য ঐতিহাসিক উৎস নির্বাচন করি, তখনই আমরা এমন একটি ইতিহাসের নাগাল পাই, যা অপরিহার্যভাবে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে।

প্রশ্ন: আপনার সামুদ্রিক গবেষণা কেন?

উত্তর: সামুদ্রিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমি আরবদের গৃহীত রুটগুলিকে পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলাম, কারণ হাজার হাজার বছর ধরে এটাই ছিল মানবজাতির পরিবহনব্যবস্থা। সুতরাং বিশ্লেষণ করার জন্য এমন কিছু উপাদান ছিল, যা ইতিহাসবিদদের দ্বারা অগত্যা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, কারণ তারা একে অপরকে কপি করেছিল। তাছাড়া তাদের সর্বদা সরকারি সংস্করণ নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস ছিল না। তাই আমি নেভিগেশনের পুরো ইতিহাসে ফিরে গিয়েছিলাম আর বিপরীতভাবে, সমস্ত কিছু এমন অঞ্চলে একত্রিত হয়েছিল, যেগুলি সর্বদা আরব অধ্যুষিত ছিল। এটি আমাকে প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ও আমেরিকার জনগণসহ ধর্মের তুলনামূলক অধ্যয়নের মতো অন্যান্য বিষয়গুলি অন্বেষণ করতে প্ররোচিত করেছিল। আমি আমার আবিষ্কারে বিস্মিত হয়েছিলাম, হিজরি প্রথম শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে ইসলাম ও আরব-মুসলিমদের আবির্ভাবের প্রাক্কালে আমি অবশ্যই আমেরিকা মহাদেশে আরবদের খুঁজে পাওয়ার আশা করিনি।

প্রশ্ন: আপনি মহান আরব-মুসলিম নেভিগেটরদের ওপর একটি সিরিজ গ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যাদের মধ্যে রয়েছে—সেলের কোরসাইরস, আলজিয়ার্সের রিজেন্সি, মার্কিন নৌবাহিনীর ভিত্তি এবং চীনা নৌবহরের অধিনায়ক মুসলিম অ্যাডমিরাল ঝেং। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে অনেক বই আছে, কেন আপনি আরও লেখার সিদ্ধান্ত নেন? 

উত্তর: আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে সামুদ্রিক ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করছি এবং জনপ্রিয় বিশ্বাসের বিপরীতে অনেক কিছু লেখার বাকি আছে। অন্যদিকে একটি নতুন ইতিহাস রচনার প্রস্তাব না দিয়ে বিদ্যমান ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব নয়, যা আমি করেছি। ইউরোপীয় সম্প্রসারণ এমনভাবে সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল, যা ইউরোপীয়দের আগমনের আগেই অর্জিত হয়েছিল। তাদের ইতিহাসের সংস্করণ পক্ষপাতদুষ্ট হতে বাধ্য।

প্রশ্ন: আমরা জানি, অ্যাডমিরাল শব্দটি আরবি উপাধি আমির-আল বাহর (أمير البحر) দ্বারা গঠিত—এর মানে কি এই যে, আমরা এক সময় সমুদ্রের মালিক বা রাজা ছিলাম?

উত্তর: আরবি শব্দ আমির-আল বাহর, যেটি নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তাকে বোঝায়, এই সহজ রেফারেন্স দিয়ে বিষয়টির মূলে যাওয়া যেতে পারে। আমি যখন আমার গবেষণার অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন নৌবাহিনীর জাদুঘর পরিদর্শনে যাই, আমি আলজিয়ার্সের রিজেন্সি এবং এটিকে উৎসর্গীকৃত জাদুঘরের অংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, তখন ডেস্কের ব্যক্তিটি বুঝতেই পারেননি আমি কাকে উল্লেখ করছি। অবশেষে লোকটি যখন বুঝতে পারলেন, তখন তার উত্তর অবাক করে দিয়েছিল, “আহ, আপনি জলদস্যু বলতে চাচ্ছেন?” তিনি আমার উত্তরে সমানভাবে অবাক হয়েছিলেন, কারণ আমি অনতিবিলম্বে উত্তর দিয়েছিলাম, “নিজের ব্যাপারে কথা বলুন। আপনি যখন আপনার নাবিকদের কথা বলেন তখন আপনি একটি আরবি শব্দ ‘অ্যাডমিরাল’ ব্যবহার করেন এবং আমাদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আপনি তাদের জলদস্যু হিসেবে উল্লেখ করেন—আমি এ মন্তব্য মানতে রাজি নই। তারা ছিলেন মহান নাবিক আর আমাদের নৌবাহিনী অফিসার। ” তিনি হাসেন এবং যোগ করেন যে, তাদের এভাবেই শেখানো হয়েছে।

একটি জাতিকে বা তার নৌবাহিনীকে অসম্মানিত করা হয় যখন সেই সময়ের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এমন কিছু সত্যকে তুলে ধরে, যা অধিকাংশ ইতিহাসবিদ উপেক্ষা করার ভান করেন—যেমন ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকে শুরু করে উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত আরবদের সামুদ্রিক শক্তি, কারণ আমরা সমুদ্রের অধিপতি ছিলাম। আমাদের নেভিগেটররা পৃথিবী অন্বেষণ করেছিলেন এবং আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন—যা প্রত্নতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বসহ অন্তত দুটি শাস্ত্রের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এই সামুদ্রিক জ্ঞান বহু প্রাচীন এবং এর প্রমাণ মেলে অটোমান অ্যাডমিরাল ও ভূগোলবিদ পিরি রেইসের অঙ্কিত মানচিত্রে, যা তিনি ১৬ শতকের গোড়ার দিকে অঙ্কন করেছিলেন। তিনি সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টকে একটি মানচিত্র দিয়েছিলেন, এবং এতে এমনকি অ্যান্টার্কটিকার অস্তিত্বও চিহ্নিত ছিল—যা ইঙ্গিত করে আরব-মুসলিমদের কাছে এই মহাদেশটিও পরিচিত ছিল।

প্রশ্ন: এটা কি সত্য যে, কলম্বাসের আগে আরব-মুসলিমরা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল? এর কোনো প্রমাণ আছে?

উত্তর: এটি সত্য যে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস কখনোই এই মহাদেশ আবিষ্কার করেননি। দক্ষিণ স্পেনের লা রাবিদার মনাস্ট্রি, যেখানে তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে বসবাস করেছিলেন—সেখানে লাইব্রেরিতে আমেরিকা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। আমেরিকা মহাদেশের তথাকথিত আবিষ্কারের ১৫০ বছর আগে, একজন ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসী মরক্কোর আরবদের সঙ্গে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে বেশ কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপে ভ্রমণ করেছিলেন। স্পেনে ফিরে আসার পর তিনি “এল লিব্রো দেল ডেসকুব্রিমিয়েন্টো” (আবিষ্কারের বই) নামে একটি বই লেখেন, যাতে তিনি তার যাত্রার বর্ণনা দেন।

দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকের চীনা নথিপত্রগুলিতে উল্লেখ রয়েছে যে, আরব-মুসলিমরা সেই সময়েই আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিলেন, আর তারা এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা করতেন বিশাল আকারের জাহাজে। আমার গবেষণার সময়, আমি একজন ফরাসি ঐতিহাসিকের লেখা একটি পুরনো পাঠ্য পেয়েছি, যেখানে বলা হয়েছে—আরবদের জাহাজ ছিল এতটাই বড় যে, সেগুলো ফ্রান্সের আটলান্টিক উপকূল ধরে নির্বিঘ্নে চলাচল করত।

বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আরবদের সাগর পাড়ি দেওয়ার উপায় ছিল এবং তারা বিভিন্ন আকারের নৌকায় পারাপার করতো। উপরোন্তু, এটা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, অনেক ইতিহাস বইয়ে যেমনটি প্রচার করা হয়, বাস্তবে তারা গভীর সমুদ্রে পাড়ি দিতে ভয় পেত না, বরং উপকূলবর্তী জলে সীমাবদ্ধ থেকেও তারা সন্তুষ্ট ছিল না। ক্যারাভেল নামের নৌযানের আবিষ্কারক ও নির্মাতা ছিল আরবরাই, যার আরবি উৎস শব্দ হলো “আল কারিব”। তারা কম্পাসসহ বেশিরভাগ নেভিগেশন যন্ত্রের উদ্ভাবকও ছিল, যা কোনভাবেই চীনা আবিষ্কার নয়। আসলে, চীনারা নিজেরাই স্বীকার করেছিল যে, তারা আবিষ্কারক ছিল না।

প্রশ্ন: আপনার একটি অস্বাভাবিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আপনি অডিওভিজ্যুয়াল —এর পাশাপাশি প্রকাশনা নিয়েও কাজ করেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

উত্তর: প্রকৃতপক্ষে, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিতে আমার একটি পটভূমি রয়েছে, তবে আরব-মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস আমাকে সবসময় এতটাই আকৃষ্ট করেছে যে, আমি এটিকেই আমার প্রিয় দুটি ক্ষেত্রের কাজে মৌলিক ভিত্তি বানিয়েছি। এটি একটি আবেগ যা আমি অনুসরণ করি। এ ছাড়াও, আমার চলচ্চিত্রশিল্পে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, কারণ আমি শিল্পকে ভালোবাসি, বিশেষ করে সপ্তম শিল্পকে (চলচ্চিত্র)। ‘অ্যান্থনি কুইন’ এবং ‘ওয়ার্দা এল-জাজাইরিয়া’র মতো সিনেমা আর গানের মতো বড় নামগুলোর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আমেরিকান এই অভিনেতাই একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে কাজ করে আমি সত্যিই উপভোগ করেছি। তিনি তার কিংবদন্তির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন, অথচ ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী।

চলচ্চিত্র জগত বাস্তবিক অর্থে সেই চিত্রটি প্রতিফলিত করে না, যা এটি পর্দায় দেখায় এবং সময়ের সাথে সাথে আমি নিজেকে এটি থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছি। আমি আমার প্রযোজনা এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি জ্ঞান সঞ্চার করার জন্য—এই শিল্পকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে।

প্রশ্ন: ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে কী আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল?

উত্তর: দশ বছর বয়স থেকেই আমি ইতিহাসের আরব-মুসলিম সংস্করণে আগ্রহী হয়ে উঠি, কারণ স্কুলে আমাদের যা শেখানো হয় তা পক্ষপাতদুষ্ট। আমাদের “বর্বর” বলা হয়, “ফ্রান্স ও ইউরোপে নতুন আগন্তুক” হিসেবে, আমাদের পশ্চাৎপদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, মুসলিম নারীকে পুরুষের দাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়, ধর্মের দ্বারা নিপীড়িত হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু এই সমস্ত বর্ণনা একজন আরব-মুসলিম নারী হিসেবে আমার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, একজন আরব-মুসলিম নারী হিসেবে, যিনি এই বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিম—উভয়েরই অংশ। আমি আলজেরিয়ান আর আমি ফ্রান্সে থাকি, আমি ইউরোপীয় হওয়ার সময় আফ্রিকান এবং এশিয়ান কারণ “ইউরোপ” শব্দটি রাজা এজেনরের কন্যা প্রিন্সেস ইউরোপার নাম থেকে এসেছে। ইউরোপা “উরুবা” ছাড়া আর কেউ নয়। উরুবার আরবিতে অর্থ “একজন প্রেমময়ী আরব মহিলা”। প্রকৃতপক্ষে, যখন কিছু লোক তাদের ইউরোপীয় উৎসের ওপর জোর দেয় আর বলে “আমরা ইউরোপীয়”, তারা জানে না যে, তারা একই সাথে তাদের আরবত্বকে জাহির করছে, যা আমাকে সবসময় হাসায়...

প্রশ্ন: আমাদের সাংস্কৃতিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করার যে লক্ষ্য আপনার, সে সম্পর্কে বলুন। কীভাবে এটা অর্জন করা যেতে পারে?

উত্তর: এটি বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্য জনপ্রিয় কাজ প্রকাশের মাধ্যমে করা হবে। যাইহোক, বহু বছর আগে আমি আরব-মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসের ওপর কয়েক হাজার প্রশ্নের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গেম তৈরি করেছি। গেমটি ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে এর ফরাসি সংস্করণে উপলব্ধ হবে, কারণ এটি অবশেষে জাকারিয়া নানা, Nana 1807 হাউসের প্রতিষ্ঠাতা, মিন্ট টি ফর পিস-এর একজন বিনিয়োগকারীকে খুঁজে পেয়েছে, যিনি আমাদের ইতিহাসের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী। আর যারা আমাদের ঐতিহ্য তুলে ধরার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগের অংশীদার হবেন।

এর মধ্যে রয়েছে ‘ইতিহাসের ক্যারাভেল’ এবং ‘আরব-মুসলিম ও আফ্রিকান ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার দিবস’—যা একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ। ঘটনাক্রমে, “পুনরুদ্ধার” শব্দটি ডক্টর রবার্ট ডিকসন ক্রেন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল, যিনি রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা, যার সঙ্গে আমি ২০১৯ সাল থেকে কাজ করছি বিকল্প ইতিহাসচর্চা সাধারণ জনগণ ও গবেষকদের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে। ড. ক্রেন চেরোকি জাতির একজন শেষ পুরোহিত ফ্র্যাঙ্কলিন জোসেফ বেভারের নাতি, যিনি ১৪৯২ সালের সেই ভাগ্যনির্ধারক ঘটনার আগেও কিছু নেটিভ আমেরিকানদের মতো মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

এই ঐতিহ্য প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ ইতোমধ্যেই কিছুটা শুরু হয়েছে—বিভিন্ন প্রকল্প ভাগাভাগি করে পরবর্তী প্রজন্মকে প্রস্তুত করার মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন প্রজন্মের লেখিকা আমিরা বেনবেতকা রেকাল এক হাজার এক রাত্রি (আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা) বা কালিলা ওয়া দিমনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তরুণদের জন্য আমাদের ঐতিহ্য উন্মোচন করতে কাজ করছেন, যখন আমরা উপেক্ষা করেছি এই সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে বই লেখার সময়। আমি আশা করি তার বইগুলো বড় পর্দায় উপযোগী হবে। এই আরব-মুসলিম ঐতিহ্যকে শিশুদের নাগালের মধ্যে আনার জন্য আমাদের তরুণদের কাছে সঞ্চারিত করার ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করতে হবে—যা আজ পর্যন্ত সব আমেরিকান স্টুডিও কাজে লাগালেও আমরা নিজেরা তা করিনি। আমরা আমাদের ঐতিহ্য নতুন করে নিজের করে নিচ্ছি, যেন তা তাদের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যেতে পারি।


এটা অবশ্যই জোর দিয়ে বলা উচিত যে, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বিষয়ক গবেষণার লক্ষ্য হলো সংযোগ স্থাপন করা, বিরোধ সৃষ্টি করা নয়। জাকারিয়া নানার সঙ্গে আমরা Mint Tea For Peace উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন মহাদেশকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করছি—সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে, যার পেছনে থাকে একটি গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। এর মাধ্যমে আমরা দেখাতে চাই যে মহাদেশগুলো ও জাতিগুলো কখনোই আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ছিল না, যেমনটা অতীতে বহুবার দাবি করা হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত খ্রিস্টীয় মনোভাবজাত এবং ইউরোপীয়দের সীমিত ভূগোল জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। যতক্ষণ না আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, ইতিহাসের এই প্রচলিত সংস্করণ আমাদের স্মৃতিকে দখল করে রেখেছে এবং কেবল ইউরোপীয় সম্প্রসারণবাদকে গুরুত্ব দেয়, ততক্ষণ আমরা ইতিহাস নয়, বরং ঐতিহাসিক ভ্রান্তি ছড়িয়ে যাব। ‘History’ (বড় ‘H’ দিয়ে লেখা) মানে হচ্ছে সেই ইতিহাস, যা আরব-মুসলিমদের উচ্চতর সমুদ্রজ্ঞানকে তুলে ধরে—যেটা প্রচলিত ইতিহাস বইগুলো উপেক্ষা করে এসেছে। আর যতদিন সিংহের নিজস্ব ইতিহাসবিদ থাকবে না, ততদিন তার ইতিহাস শিকারীরাই লিখবে।

প্রশ্ন: আরব-মুসলিম সভ্যতার অতীতের এই বিকল্প ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আমাদের কি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয়?

উত্তর: আমাদের কাছে ইতিহাসের যে সংস্করণটি পরিবেশন করা হয়েছে, তার বহু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, কারণ এটি এমন একটি মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে তৈরি—যেটিকে অনেকেই প্রশ্নাতীত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। অথচ প্রকৃত গবেষণা হলো এমন একটি ওষুধ, যার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এটি দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে—যদি আমরা এর সভ্যতাগত মূলনীতি বুঝতে পারি এবং একজন বিজ্ঞানী হিসেবে জ্ঞান প্রেরণের দায়িত্ব পালন করতে প্রতিশ্রুত থাকি। প্রত্যেক ইতিহাসবিদেরই একটি শপথ নেওয়া উচিত—শুধু উৎস যাচাইয়ের জন্য নয়, বরং লেখার সময় যেসব মানদণ্ড অনুসরণ করা উচিত, সেগুলোর প্রতিও দায়বদ্ধ থাকার জন্য। একজন ইতিহাসবিদেরও উচিত একজন চিকিৎসকের মতো তার পেশার মূলনীতির প্রতি আনুগত্য রেখে তার কাজ করা।

প্রশ্ন: আপনি আমার সঙ্গে আরব-মুসলিম সমাজে দাসপ্রথার কথা বলেছেন এবং আপনি এমন একটি বিষয় তুলে ধরেছেন, যা আমি আগে কখনো শুনিনি, আপনি কি আমাদের এটি সম্পর্কে বলতে পারেন?

উত্তর: আমি মনে করি ইতিহাসে ফিরে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, ইতিহাসের আসল সংস্করণ এবং তারপরে আমরা বুঝতে পারব যে, আরব-মুসলিম বিশ্বে বর্ণবাদ এতটা বিস্তৃত ছিল না, যতটা এটি তৈরি করা হয়েছে। উত্তর আফ্রিকার কথাই ধরুন, যেখানে ইতিহাস আমাদের বলে যে, স্লাভিক পরিবারগুলি তাদের সন্তানদের আরবদের দাসত্বের স্বপ্ন দেখেছিল, কারণ তারা একটি উন্নত জীবনের আশ্বাস পেয়েছিল। অন্যদিকে, উত্তর আফ্রিকার অনেক বাসিন্দা ইসলাম বেছে নেওয়ার জন্য তাদের খ্রিস্টান জীবন ছেড়ে পালিয়েছিল, কারণ তারা উত্তর আফ্রিকার সমাজে উন্নত জীবনযাপনের আশ্বাস পেয়েছিল। অনেক ক্রীতদাস জোর দিয়েছিল যে, তাদের সাথে খ্রিস্টানদের চেয়ে মুসলমানরা ভালো আচরণ করেছে।

একই শিরায়, কোরআন পাঠের ওপর গবেষণার বিষয়ে ড. সাফি কাসকাসের উদাহরণ রয়েছে, একজন লেবানিজ-আমেরিকান যিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে IQRA (আন্তর্জাতিক কোরআনিক গবেষণা সংস্থা) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিদিনের ভিত্তিতে এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির আলোকে পবিত্র কোরআনের আমাদের পাঠ বা ব্যাখ্যা আপডেট করা। এই অ্যাসোসিয়েশনের লক্ষ্য হলো, সারা বিশ্বের আরব-মুসলিম গবেষকদের একত্রিত করা, আজকের এবং আগামীকালের পাঠকদের কাছে একটি অনন্য “অনুবাদ” দেওয়ার জন্য, যার ওপর এই বিশেষজ্ঞরা ভাষাতত্ত্ব, বিভিন্ন বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস এবং একেশ্বরবাদী ধর্মের তুলনামূলক গবেষণা কাজ করবে। ড. কাসকাস তার নাতি-নাতনিদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কোরআন সম্পর্কে এমন একটি জ্ঞান দিতে চান যে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি ক্রমাগত আপডেট হচ্ছে এবং সেইজন্য একটি ডিজিটাল পাঠ্য, যা একটি আবিষ্কারের সাথে সাথেই পরিবর্তন করা যেতে পারে, যা অতীত বা পূর্বের ব্যাখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

প্রশ্ন: ইউরোপে, বিশেষ করে হাঙ্গেরি এবং ফ্রান্সে ইসলামোফোবিয়া কেন বেড়েছে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: আমি বহুদিন ধরেই বলে আসছি যে, ইতিহাসের জ্ঞানের অভাব অনেক অসুস্থতার মূলে। যার অতীত নেই তার বর্তমান নেই এবং ভবিষ্যৎও নেই। তার কোনো ঘোষণা দেওয়ার অধিকার নেই। যদি আমরা আমাদের ঐতিহ্যের গুরুত্বকে উপেক্ষা করি, তবে এটি শিশুর ব্যক্তিত্বের ওপর এবং তারপরে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর একটি ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে যারা আজকের বহুসাংস্কৃতিক সমাজের অংশ হবে। ফ্রান্সের উদাহরণ টেনে ব্যাখ্যা করি। ফরাসি জনসংখ্যার অধিকাংশই জানে না যে, আরবরা ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে উপস্থিত ছিল এবং তারা এমনকি মার্সেই, যার অর্থ ঈশ্বরের বন্দর, মার্কা-এলের মতো শহরগুলিও প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা এই সত্যকে উপেক্ষা করে যে, আরব-মুসলিমরা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে এর অধিবাসীদের অংশ ছিল এবং তারা ফ্রাঙ্কিশ রাজ্যের গোড়াপত্তনের আগেও সেখানে উপস্থিত ছিল।

প্রশ্ন: আপনার ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলো কী কী?

উত্তর: A. ATHAR ফাউন্ডেশন, যার উদ্দেশ্য হলো আরব-মুসলিম সভ্যতার সৃষ্টি ও প্রসারের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা, যা জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতু তৈরিকে উৎসাহিত করবে, যা পারস্পরিক জ্ঞানের উন্নতিতে অবদান রাখবে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।