ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

চায়ের দেশ, চা কন্যার ভাস্কর্য

তমাল ফেরদৌস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১০
চায়ের দেশ, চা কন্যার ভাস্কর্য

চায়ের পাতার ওপর পড়ন্ত বৃষ্টির ফোঁটা টলমল করার দৃশ্য। গাঢ় সবুজ পাতা থেকে আসা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাওয়া।

যেদিকে চোখ বুলাবেন সারি সারি চা গাছ আর পাতা। তারই ফাঁকে ফাঁকে হেঁটে যাওয়ার জন্য আঁকাবাকা পাহাড়ি পথ। চিন্তা করলেই দেখবেন শরীর-মন চাঙা হয়ে উঠেছে। আর এ দৃশ্য চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলে গেলে তবেই দেখতে পাবেন। আর তার সাথে যদি চা বাগানের সবুজের ভেতরে একটু বিশ্রামের জন্য মনের মতো কোনও সাজানো পরিবেশ পেয়ে যান, তাহলে তো আপনি স্বপ্নের ঘোরে কাটাবেন সারাটা সময়।

অনেকেই হয়তো শ্রমিকের চা পাতা তোলার দৃশ্য দেখেছেন, চা বাগান দেখেছেন কিন্তু চা কন্যার ভাস্কর্য দেখেননি। তাদের আমন্ত্রণ ও অভিনন্দন জানাতে পাহাড়ের ওপর নিজের অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চা কন্যার একটি বিশাল সাদারঙের ভাস্কর্য।    

১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় দেশে প্রথম চায়ের চাষ শুরু হয়। ব্রিটিশ কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্স চা চাষ শুরু করে। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় চা উৎপাদনে রয়েছে অনেক ইতিহাস- ঐতিহ্য। ব্রিটিশ কোম্পানি এ দেশে চা চাষে শ্রমিক এনেছিল দণি ভারত, বিহার, উড়িষ্যাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। নানা লোভ দেখিয়ে তারা চা শ্রমিকদের এ দেশে নিয়ে এসেছিল। অনেকটা আমেরিকায় আফ্রিকার কালো মানুষদের নিয়ে কাজ করানোর মতোই ঘটনা। এই শ্রমিকরা উঁচু-নিচু পাহাড়ি এলাকায় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পরিশ্রম করে যেভাবে চা উৎপাদন করে থাকে তা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের লোকজন করতে পারবে না। চা শ্রমিকদের কষ্টে উৎপাদিত চা দেশের বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হলেও চা শ্রমিকরা তাদের উৎপাদিত চায়ের স্বাদ খুব কমই গ্রহণ করতে পারে।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে চা উৎপাদনকারী সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের সদর দপ্তর (আইটিএ)’ মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর চা বাগানে নির্মাণ করা হয়েছিলো। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান টি অ্যাসোসিয়েশনের সদর দপ্তর ছিলও শমশেরনগরে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে সংস্থার নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ চা সংসদ’ হলে সদর দপ্তরও শমসেরনগর থেকে পরিবর্তন করে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের (আইটিএ) সদর দপ্তরের সেই ভবনটি আজও কালের সাী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যা ডানকান ব্রাদার্সের ‘লংলা হাউস’ নামে পরিচিত। এই লংলা হাউসের ভেতরের আঙিনা ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে রয়েছে ব্রিটিশ শাসনামলের মূল্যবান বেশ কিছু ভাস্কর্য।
এরই পথ ধরে একবিংশ শতাব্দীতে চায়ের রাজধানী নামে পরিচিত শ্রীমঙ্গল সীমান্তের প্রবেশমুখে নির্মিত হয় একটি চমৎকার চা কন্যার ভাস্কর্য। বৃহত্তর সিলেটেই দেশের ৯৮ ভাগ চা বাগান। আর শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অবস্থিত সবচেয়ে বেশি চা বাগান। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল হয়ে মৌলভীবাজার প্রবেশপথে হবিগঞ্জের মুছাই অতিক্রম করে সাতগাঁও চা বাগানের প্রবেশমুখে আলিয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির সড়কের পাশে সাতগাঁও চা বাগান কর্তৃপ নির্মাণ করেছেন চা কন্যার ভাস্কর্যটি। এখানে সগৌরবে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানায় এই চা কন্যার ভাস্কর্য। সাতগাঁও চা বাগানের সৌজন্যে শিল্পী সঞ্জীত রায় নির্মাণ করেছেন এ ভাস্কর্য। এ বছরে জানুয়ারিতে  মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উদ্বোধন করেন এটি। পেছনে পাহাড়, পাশে চা বাগান আর শিল্পীর নির্মাণশৈলী সব মিলিয়ে এর আবহ সত্যিই অনেক সুন্দর।

চা শিল্পের প্রাণ চা শ্রমিক। আর চা শ্রমিকদের প্রাণ হলো নারী চা শ্রমিক। মাথার ওপর থেকে বেতের দড়ি দিয়ে ঝুড়িটি পিঠের সাথে বেঁধে রেখে দু হাতের আঙুল দিয়ে চা গাছ থেকে পাতা তোলা নারী চা শ্রমিকদের দৃশ্য দেখতে অপরুপ লাগে। ঘন সবুজের মাঝে নানা রঙের শাড়ি পরে নানা বর্ণের নারী চা শ্রমিকরা চা উত্তোলন করেন। আর  সেই বাস্তব দৃশ্যটির প্রতিফলনই ঘটিয়েছেন শিল্পী সঞ্জীত রায় তার শিল্পকর্মে।

দূর-দূরান্তে যাতায়াতকালেও অনেকেই চা কন্যার ভাস্কর্যের পাশে থামতে, এর পাশে কিছু সময়ের জন্য নীরবে বসে কাটাতে পছন্দ করেন। অনেক বনভোজনপ্রেমী দলকেও চা কন্যার ভাস্কর্যস্থলে এসে বনভোজন করে যেতে দেখা যায়। এর দু পাশেই আছে সারি সারি চা বাগান, বন, পাহাড় আর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। কাছে এলে বোঝা যায় সঠিক স্থানেই সাতগাঁও চা বাগান কর্র্তৃপ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন। এ বাগানের স্বত্বাধিকারী মরহুম আহমেদুল কবির। আপনাকে চা কন্যার দেশে স্বাগতম।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০১০, অক্টোবর ২৭, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।