ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

মৌলভীবাজারের লাল দুর্গা

তমাল ফেরদৌস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১০
মৌলভীবাজারের লাল দুর্গা

কেউ অঞ্জলি দিচ্ছে, কেউ বা মানত করে পাঁঠা বলি দিচ্ছে, কেউ আবার পুকুরের জলে স্নান করে পবিত্র হচ্ছে। হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগীদের পদভারে মুখর পুজোম-পের আশপাশ এলাকা।

দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামময় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। দুর্গাম-পকে ঘিরে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে এখন মেলা বসেছে। কয়েক শ দোকানে বেচাকেনা হচ্ছে খৈ, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, জিলাপি, মিষ্টি, বাঁশি, বেলুন, ঝুমঝুমিসহ নানা কিছু।

এ দৃশ্যটি প্রতি বছরের দুর্গা পুজোর সময়ের। প্রায় তিনশ বছর ধরে ব্যতিক্রমী লাল বর্ণের জাগ্রত দেবীর দুর্গা পুজো হচ্ছে। দেশের আর কোথাও দেবী দুর্গার রঙ লাল বর্ণের নয়। তাই দুর্গাম-পে লাল বর্ণের এই দেবী দর্শনে প্রতি বছরের মতো এবারও হাজার হাজার ভক্তের ঢল নেমেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের পদচারণায় নিভৃত গ্রামটি এখন কোলাহল মুখর। ১৩ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে এখানে শুরু হয়েছে দুর্গা পুজো।

মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে পাঁচগাঁও গ্রামে স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাসের বাড়িতে বংশপরম্পরায় পালিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপুজো। সিলেট বিভাগ, মতান্তরে দেশের একমাত্র ‘লাল দুর্গা’ ম-প এটি। প্রতি বছর ভারতসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তরা এখানে ছুটে আসেন শুধু একবার দেবী দর্শন ও মানত পালনের জন্য। তাদের বিশ্বাস, এখানে যে কোনও কিছুর জন্য মানত করলে তা পূরণ হয়ে যায় এবং এই ‘লাল দুর্গা’ দর্শন করামাত্র মনে তৃপ্তি আসে।
 
পূজা উদযাপন কমিটির পরিচালক সঞ্জয় দাস জানান, পূজা পরিচালনাকারীদের মধ্যে তিনি এখন ষষ্ঠ পুরুষ। তার পূর্বপুরুষ স্বগীয় সর্বানন্দ দাস ধ্যানে বসে কুমারী পূজার মাধ্যমে ‘লাল দুর্গা’র দর্শন পাওয়ার পর প্রতি বছর এখানে লাল দুর্গার পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

তিনি জানান, প্রায় তিনশ বছর ধরে তাদের বাড়ির মণ্ডপে ‘লাল দুর্গা’র পূজা হচ্ছে। এখানে পূজা শুরুর পর থেকে একবারও ছেদ পড়েনি। শুধু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মূর্তি নির্মাণ করে পূজা সম্ভব হয়নি। সেবার ঘটে পূজা হয়েছিল। সঞ্জয় দাস জানান, তাদের এক পূর্বপুরুষ সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সি পদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধকপুরুষ। একবার আসামের কামরূপ-কামাখ্যায় গিয়ে পূজার জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চাইলে স্থানীয় লোকজন তাকে একটি মেয়ে দেন। সর্বানন্দ দাস সেই মেয়েকে পূজা দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে মেয়েটির রঙ বদলে লাল হয়ে ওঠে। মেয়েটির মধ্যে স্বয়ং দেবী ভর করেন। মেয়েটি তখন সর্বানন্দ দাসকে বলে, ‘তুমি আমার কাছে বর চাও। আমি তোমাকে বর দেব। ’ সর্বানন্দ বর চাইলেন প্রতি বছর শারদীয় দুর্গা পূজার সময় স্বয়ং দেবীকে পাঁচগাঁও দুর্গাম-পে আসতে হবে। দেবী তখন নির্দেশ দিলেন পাঁচগাঁওয়ের প্রতিমার রঙ হবে লাল। সেই থেকে এখানে লাল বর্ণের মূর্তির পূজা হয়ে আসছে। ভক্তদের বিশ্বাস পাঁচগাঁও দুর্গাবাড়িতে স্বয়ং দেবী অধিষ্ঠান করেন। এটি জাগ্রত প্রতিমা। ভক্তরা জানান, আসাম ও কামরূপ-কামাখ্যা ছাড়া দেশের আর কোথাও প্রতিমার রঙ লাল নেই। এই দেবীর কাছে বর চাইলে বর পাওয়া যায়। দেবী দর্শনার্থী অজয় দেবরায় বলেন, ‘অন্য প্রতিমা থেকে এ প্রতিমা সম্পূর্ণ আলাদা। লাল বর্ণের দেবীমূর্তি দেশের আর কোথাও নেই। এ কারণে এই প্রতিমার কাছে মানুষের অনেক মানত। এই প্রতিমা দর্শনে ভক্তদের অন্যরকম অনুভূতি হয়। ’

স্থানীয়রা জানান, সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হাজারো ভক্ত দেবী-দর্শনে আসছেন। তৈরি হচ্ছে গাড়ির দীর্ঘ সারি। কোনও মনোকষ্ট না নিয়েই দুই থেকে তিন কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌছছেন সবাই। তাদের পথের কান্তি মুছে যায় দেবী-দর্শনের আনন্দে।

এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আসেন ভক্তি আর মানত নিয়ে। কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষেরও কমতি নেই। শারদীয় পূজার এই কদিন স্থানটি হয়ে উঠে ধর্ম-বর্ণ সবার মিলনভূমি। প্রতি বছরই দেবী দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন ত্রিশ-চল্লিশ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করছেন।

সঞ্জয় দাস জানান, মূলত এটি তাদের পারিবারিক পূজা। তবে দেবীর জাগ্রত উপস্থিতির কারণে প্রতি বছরই এখানে লোকসমাগম বাড়ছে। তাই পূজার এই কদিন তাদের হিমশিম খেতে হয়। তবে স্থানীয় প্রশাসন সার্বিক সহযোগিতা করে থাকে।

তিনি আরও জানান, এখানে হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাদের নানা মানত নিয়ে ছুটে আসছেন। কেউ হোমযজ্ঞ দিচ্ছেন, কেউ প্রদীপ ও আগরববাতি জ্বালাচ্ছেন। কেউবা পশু বলি দিচ্ছেন। এবার পূজাতে প্রায় সাড়ে ৫০০ পাঁঠা, ৬টি মহিষ ও প্রায় ৭০০ জোড়া কবুতর দেবীর নামে বলি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এখানে রয়েছে দুর্গাম-প, নাটমন্দির, যজ্ঞমন্দির, যাত্রীনিবাস, ভোগমন্দির, ফুল  ও নৈবেদ্য রাখার ঘর, শিবমন্দির এবং পাকা ঘাটসহ বড় পুকুর।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৯৪৫, অক্টোবর ১৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।