ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

দুর্গাপূজা : বাঙালির উৎসব

বিপ্লব কুমার পাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১০
দুর্গাপূজা : বাঙালির উৎসব

শরতের সাদা কাশফুলে মুখর বাংলার মাঠ। ফুলগুলো মৃদু বাতাসে দোল খায়।

এই দোল যে উৎসবের সুর। শারদীয় দুর্গাপূজার আগমনী গান। উমা (দুর্গার আরেক নাম) আসবেন পৃথিবীতে বাবার বাড়িতে। তাই তো প্রকৃতির এ আয়োজন।

বাঙালি হিন্দুরা আবেগ, উচ্ছ্বাস আর ধর্মীয় রীতিতে পূজা করেন তাদের এই প্রাণের দেবীকে। তাই শারদীয় দুর্গোৎসবে মেতেছে বাঙালি হিন্দুরা। উৎসবের এই আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে।

প্রাচীনকালে রাজা সুরথ স্ত্রী, পুত্র ও অমাত্যবর্গের নির্যাতনে রাজ্যচ্যুত হয়ে গভীর বনে আশ্রয় নেন। একইভাবে অমাত্যবর্গের হাতে নিগৃহীত হয়ে রাজা বৈশ্যও বিতাড়িত হন। উভয়ে মেধস মুনির শরণাপন্ন হন। তার পরামর্শে উভয়েই দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। কোথাও কোথাও এ পূজা বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে একে বাসন্তী পূজাও বলা হয়।

প্রাচীনকাল থেকেই সনাতন ধর্মের দুটি ধারা প্রচলিত রয়েছে। একটি বৈদিক, অন্যটি তান্ত্রিক। বৈদিক ধারার ভিত্তি বেদান্তদর্শন, যার মূলে রয়েছে ব্রহ্মবাদ। আর তন্ত্রশাস্ত্রের মূল ভিত্তি শক্তিবাদ, যার রূপায়ণ ঘটেছে শ্রীশ্রীচন্ডী গ্রন্থে। উভয়ের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে পার্থক্য পরিলতি হলেও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উভয়েই এক ও অভিন্ন।

শাস্ত্রে বলা আছে, ব্রহ্মই আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা। বিশ্বব্রহ্মান্ড রা এবং নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত জীবের দুর্গতি হরণ করার জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব হয়। দেবতাদের সম্মিলিত তপস্যা ও জ্যোতি থেকে সৃষ্ট আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা নাম ধারণ করে মর্ত্যলোকে আগমন করেন। তান্ত্রিক সাধকরা দেবী দুর্গাকে মাতৃজাতির প্রতীক করুণাময়ী বলে তাকে নারীমূর্তিতে কল্পনা করেছেন।

আদ্যাশক্তি মহামায়া জগজ্জননী দেবী দুর্গা কখনও ত্রিভুজা, কখনও অষ্টভুজা, আবার কখনও দশভুজা হিসেবে আবির্ভূত হন। সনাতন ধর্ম মতে, বস্তুত যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। তিনিই দেবী দুর্গা। দুর্গাপূজা মূলত শক্তির আরাধনা। এর দর্শনটি হলো, দুর্বলের কোনো আত্মজ্ঞান হয় না, জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য চাই শক্তির সাধনা। আর ব্রহ্ম পরিপূর্ণতা লাভ করেন শক্তিতে। শক্তির পরিপূর্ণতার রূপায়ণ ঘটে জগৎসৃষ্টিতে।

ঈশ্বর এক, অদ্বিতীয় ও নিরাকার। বিভিন্ন দেব-দেবীও এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিচিত্র শক্তির প্রকাশ মাত্র। ভক্ত ঈশ্বরের প্রতীক। মূর্তিতে তার হৃদয়ের অর্ঘ্য দেবতার পাদপদ্মে নিবেদন করে করুণা লাভের চেষ্টাই পূজা বা উপাসনা। তাই পূজারী আরাধ্য দেবতার মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে চিন্ময়ী জ্ঞানে অর্চনা করেন। ভক্তের হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাভক্তিতে মৃন্ময়ী মূর্তি তার মানসলোকে চিন্ময়ী হয়ে ওঠে।

মাতৃসাধক শ্রীশ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘তোমরা যাকে ব্রহ্ম বলো, আমি তাকে মা বা ব্রহ্মময়ী বলি। ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ী এক ও অভিন্ন।

বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বলেছেন, ‘ব্রহ্মময়ী মহাশক্তিকে আমরা জড় বলতে পারি না। তিনি স্বয়ম্ভু, স্বপ্রকাশ ও চৈতন্যময়ী। তাকেই তো ধর্মাচার্যগণ পরমেশ্বর বলে উপাসনা করেন। ঈশ্বর ও ঐশীশক্তির মধ্যে কোনো তফাত নেই। ’

ভারতের নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরসূরি ভবানন্দ ১৬০৬ সালে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। সে সময় পূজা হতো রাজবাড়ির অভিজাত ঠাকুরদালানে, রাজার ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সাড়ম্বরে পূজা হলেও তা দেখার দরজা সাধারণ মানুষদের জন্য খোলা থাকত না।

হুগলীর গুপ্তিপাড়ার এক ধনী গৃহস্থের বাড়ির দুর্গাপূজায় অংশ নিতে না পারার জন্য বারো জন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে তারা ঠিক করেন, তারা নিজেরাই মিলেমিশে চাঁদা তুলে নতুন করে পূজা করবেন। বারো জনের উদ্যোগে দুর্গাপূজার এই নতুন ধরনের সূচনা, তাই এর নাম হয় ‘বারোয়ারি’।

বারোয়ারি পূজা প্রথম হয়েছিল ১৭৬১ সালে। যদিও সাল নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে মতভেদ আছে। তবে বারোয়ারি পূজাই  ক্রমশ রূপ নেয় সার্বজনীন উৎসবে। ১৯১০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কলকাতায় প্রথম সার্বজনীন দুর্গোৎসব করে। এরপর থেকে এ রূপেই এ পূজা পালিত হয়ে আসছে বাঙালি সমাজে।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গচ্যুত দেবতারা ব্রহ্মার স্মরণ করেন। ব্রহ্মা, শিব ও অন্য দেবতারা বিষ্ণুর কাছে আসেন। তাদের দুর্দশার কথা জানিয়ে ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করেন, এর থেকে মুক্তির পথ কী? কারণ ব্রহ্মার দেওয়া বরেই মহিষাসুরকে বধ করতে পারবে না কোনও পুরুষ। বিষ্ণু উত্তরে বলেন, এই পরাক্রমশালী অসুরকে বধ করতে হলে নিজ তেজের কাছে প্রার্থনা করতে হবে। তাদের মিলিত তেজ থেকে যেন এক নারীমূর্তির আবির্ভাব হয়।

বিষ্ণুর কথামতো কাজ শুরু করেন দেবতারা। দেবতাদের দেহ থেকে তেজ নির্গত হয়ে সৃষ্টি হয় এক অপরূপা দেবীর। যে দেবতাদের দেহ থেকে তেজ নির্গত হয়েছিল, তার মধ্যে ছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু ও ইন্দ্র। দেবতারা তাদের নিজেদের অস্ত্র এ দেবীকে দান করেন।

পুরুষদের ‘অবধ্য’ মহিষাসুরকে তিন বার বধ করেন এই দেবী। প্রথম বার অষ্টদশভুজা উগ্রচন্ডী রূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার দশভুজা দুর্গারূপে।

রাতে স্বপ্নে ভদ্রকালীর মূর্তি দেখে মহিষাসুর বলেন, ‘আপনার হাতে বধ হতে আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু আমিও যেন আপনার সঙ্গে পূজিত হই, তারই ব্যবস্থা করুন। ’

দেবীর উত্তর, ‘উগ্রচন্ডী, ভদ্রকালী ও দুর্গা এই তিন মূর্তিতে তুমি সবসময় আমার পদতলে থেকে দেবতা, মানুষ ও রাসদের পূজ্য হবে। ’ (দেবী ভাগবত, মার্ক-ক্ষেয় চন্ডী ও কালিকা-পুরাণ)

সত্যযুগে সুরথ রাজা ও সমিধ বৈশ্য দুর্গা মূর্তি তৈরি করে তিন বছর পূজা করেছিলেন। ত্রেতাযুগে রাবণ চৈত্রমাসে পূজা করতেন। রাবণবধের জন্য রামচন্দ্র এই দেবীর শারদীয়া পূজা করেন। বাল্মীকির রামায়ণে এর উল্লেখ না থাকলেও পুরাণে এর উল্লেখ আছে।

বৈদিক সাহিত্যেও দুর্গার উল্লেখ রয়েছে। তন্ত্র ও পুরাণে বিশেষ আলোচনা বিধি ও পূজাবিধি আছে। দুর্গা, মহিষাসুরমর্দিনী, শুলিনী, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা ইত্যাদি বহু নামে এই দেবীর পূজা হয়। আশ্বিনে শুকপে শারদীয়া এবং চৈত্রে বাসন্তী নামে এই দেবীর পূজা হয়।

দুর্গাপূজা যদিও হিন্দু সমাজের ধর্মীয় উৎসব কিন্তু এটি ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির উৎসবে। এর ধর্মীয় তাৎপর্যও সর্বজননীন। কেননা, এই দেবী সকল অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সব মানুষের কল্যাণেই পৃথিবীতে আবির্ভূত হন।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১২৫০, অক্টোবর ১১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।