ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

‘পৃথিবীর সর্বাধিক সুখী ব্যক্তির বাস বাংলাদেশে’ : ডা. মোহিত কামাল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১০
‘পৃথিবীর সর্বাধিক সুখী ব্যক্তির বাস বাংলাদেশে’ :  ডা. মোহিত কামাল

১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে : ‘মানসিক স্বাস্থ্য ও দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতা : প্রয়োজন অব্যাহত ও সমন্বিত সেবা।

’ বাংলাদেশে ১৮ বছরের ওপরের জনসংখ্যার ১৬.৫ শতাংশ মানুষ মৃদু থেকে গুরুতর মানসিক সমস্যায় ভুগছে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় দুই লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। এই মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী বলতে বোঝাচ্ছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোচিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, নার্স, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার, অকুপেশনাল থেরাপিস্টসহ অন্যরা। দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র ১৩০জন। দিবসটিকে সামনে রেখে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক মোহিত কামালের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বাংলানিউজের জন্য এটি তৈরি করেছেন মারুফ রায়হান

এবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসকে সামনে রেখে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণে কোন বিষয়টি অধিক গুরুত্ব বহন করছে?

মোহিত কামাল : প্রথমেই বলব দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে অবজ্ঞা করার একটি প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সবার আগে। দেহ-মন এক সুতোয় বাঁধা বলেই দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগের সঙ্গে প্রায়শ যুক্ত হয় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। আবার দেখা গেছে, জটিল মানসিক রোগী কিংবা মাদকাসক্তদের দেহেও বাসা বাঁধতে পারে দৈহিক সমস্যা। মানসিক রোগীদের দৈহিক সমস্যা যেমন থাকে গুরুত্বহীন, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য জটিলতাও থেকে যায় লোকচুর আড়ালে। শনাক্ত করা সম্ভব হয় না উভয় সমস্যাই। চিকিৎসাসেবায় অন্তর্ভুক্ত হয় না সচেতনতার ঘাটতির কারণে। অসচেতনতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কুসংস্কার ও মিথ। স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে প্রথমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হাজির হন জেনারেল ফিজিশিয়ান (জিপি) কিংবা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নিয়োজিত চিকিৎসকের চেম্বারে। এ কারণে দেহ-মনের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে, সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, মানসিক স্বাস্থসেবা খাতকে সম্পৃক্ত করতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্চায়। বাড়াতে হবে উভয় স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সমন্বয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও শ্বাসযন্ত্রের রোগের কারণে বিশ্বে মৃত্যুহার ৬০ শতাংশ। এই মৃত্যুর ৮০ শতাংশ ঘটে থাকে দরিদ্র দেশগুলোতে। গত দুই দশকে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ ও মানসিক রোগের পারস্পরিক যোগসূত্রের বিষয়ে বিস্ময়কর তথ্য বেরিয়ে আসছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর চেয়ে লাগাতার দৈহিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অধিক হারে বিষন্নতা ও উদ্বেগ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মেজর ডিপ্রেশনের কারণে দৈহিক স্বাস্থ্যের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে শারীরিক উপসর্গের, বাড়ছে অকর্মণ্যের বোঝা; বাড়ছে চিকিৎসাব্যয়। মানসিক রোগের কারণে শারীরিক অসুস্থ রোগীরা নিজের যত্ন নিতে পারেন না, চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে বেড়ে যাচ্ছে মৃত্যুঝুঁকি, মৃত্যুহার। এই হার কমানোর জন্য লাগসই মানসিক চিকিৎসাসেবা রয়েছে আমাদের দেশেই। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা, প্রয়োজন সেবা দানকারীদের উন্নততর দৃষ্টিভঙ্গি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা। এই কাজে গাফিলত ঘটলে আগামী ১০ বছরে বিশ্বের ৩৮ কোটি ৮০ লাখ জনগোষ্ঠীর মৃত্যু ঘটবে অসহায়ভাবে। এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ কমিটি।

বিশ্ব মানদন্ড বাংলাদেশের গড়পরতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থান কেমন?

মোহিত কামাল : সত্যি বলতে কী, ইউরোপীয় স্টাডি বলছে, বিশ্বে বাংলাদেশের মানুষই সবচেয়ে বেশি সুখী। এর বিশ্লেষণ করতে গিয়েস তারা জানাচ্ছে, বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রত্যাশা বা চাহিদার মাত্রাটা যেহেতু খুব উঁচু নয়, তাই তারা তুলনামূলকভাবে বেশি সুখী। এটা অবশ্য দেশের গ্রামীণ সমাজের হিসাব, যে সমাজে মোট জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ রয়েছে। গ্রামের মানুষের চাওয়া তার সামর্থ্যরে সঙ্গে সম্পর্কিত। দু বেলা আহারের ব্যবস্থা করতে পারলে গ্রামের মানুষ নিশ্চিন্ত মনে রাতের শয্যা গ্রহণ করে এবং সুখনিদ্রা যায়। এই বৃহত্তর সংখ্যক মানুষের মানসিক জীবন ভারসাম্যপূর্ণ। তাদের দাম্পত্য জীবনও দীর্ঘস্থায়ী। বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রীই দাম্পত্যজীবন পরিবর্তন করছে না। তার মানে হলো তালাক বা পুনর্বিবাহের হার আশঙ্কাজনক নয়। একজন পুরুষ বা নারী একবারই বিয়ে করছেন এবং আমৃত্যু ওই দাম্পত্য জীবন বহাল রাখছেন। উন্নত বিশ্বের দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্বের তুলনায় যা অনেক অনেক বেশি স্থায়ী। দাম্পত্য সম্পর্ক টিকে থাকা, পারিবারিক বন্ধন মজবুত থাকা- এসব সুখের একেকটি অনুষঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি সুখী। বা কথাটা এভাবেও বলতে পারি, পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক সুখী ব্যক্তির বাস বাংলাদেশে। তাহলে বলতেই পারি বাংলাদেশের গড়পরতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো। আমরা মানসিক স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ জাতি।

কিন্তু শহরাঞ্চলের বা শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষের ভেতর ব্যাপকভাবে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। তাদের সংস্কৃতির ভেতর অপসংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা প্রবীণ এবং নবীন দুটি প্রজন্মের ভেতর সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এক ধরনের অশান্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এখানেই রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের অসুস্থতার দিক।

দেশে মানসিক চিকিৎসার পরিবেশ সম্পর্কে বলুন। আমাদের কী কী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে?

মোহিত কামাল : পরিবেশ আগের তুলনায় উন্নত হচ্ছে। এখনও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হলে শতকরা আশি ভাগেরও বেশি মানুষ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। তারা কবিরাজ থেকে শুরু করে পীরফকিরদের শরণাপন্ন হয়। ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নেয়। এখনও দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের শিকার। অথচ আমাদের দেশেই সব মানসিক রোগের চিকিৎসা যথাযথভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। মানসিক রোগ সারানোর জন্য বিদেশ যাওয়ার কোনো দরকার নেই। এটা বড় অর্জন। এখন প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে মানসিক বিভাগ চালু করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ চালু করা হয়েছে, সেখানে শিক্ষাদান চলছে। তবে লাগসই চিকিৎসা সুবিধার জন্য আরও কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। এখানেই নিহিত আসল চ্যালেঞ্জ। আমাদের দেশে একটি মাত্র মানসিক হাসপাতাল রয়েছে পাবনায়। এখন বিশ্বে মানসিক হাসপাতালের ধারণাই পুরনো হয়ে গেছে। ঘরে বা পরিবারে রেখেই মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করার ওপর জোর দিচ্ছেন আধুনিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। এতে মানসিক রোগীদের পরিবারবিচ্ছিন্নতার অনুভূতি পীড়া দেয় না। নিকটজনের আদর-স্নেহ-মমতার ভেতর তার নিরাময় ও শুশ্রষা গতি লাভ করে।
আত্মহত্যার কারণে প্রতি বছর মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক চাপ বহন করছে পরিবার, সমাজ, দেশ। মুখোমুখি হচ্ছে ভয়াবহ তি ও বিপর্যয়ের। ইদানীং দেখা যাচ্ছে দলবদ্ধ আত্মহত্যার প্রবণতা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী?

মোহিত কামাল : বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি বছর প্রতি লাখে ৮-১০ জন। পান্তরে বিশ্বজনীন এই হার প্রতি বছর প্রতি লাখে ১৪.৫। এখানেও কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। বাংলাদেশে ঝিনাইদহ ও যশোর জেলাকে আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে এই হার গড়ে ২৯-৩৩ জন। ঝিনাইদহে আত্মহত্যাকারীদের ৬৭.২৮% ছিল গৃহবধূ, ৭৩.৪৫% নারী, ৬৯.৫৬% অশিতি, ৭৪.৬১% শতাংশের বয়স ছিল ১১-২৫ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিতে রিভিউ আর্টিকেল হিসেবে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্র থেকে আরও দেখা যায়, ৩৭-৫৯% আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পারিবারিক সমস্যার কারণে (আলম এম এফ’০৪)।

যারা আত্মহত্যার ইচ্ছা, আগ্রহ কিংবা চিন্তার জালে জড়িয়ে আছে, তাদের জন্য এখনই সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৬৪ লাখ ৮০ হাজার (ন্যাশনাল সার্ভে, ২০০৫)। এখন সব চেয়ে বড় প্রয়োজন তাদের শনাক্ত করা এবং সর্বোচ্চ মানসিক চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা। মনে রাখতে হবে, বায়োক্যামিকেল থিওরি অনুযায়ী, এদের মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক পদার্থ, বিশেষ করে সেরোটোনিনের মাত্রায় ধস নামে। এ কারণে মনে আত্মহননের অপ্রতিরোধ্য স্রোত জেগে ওঠে বেগবান গতিতে। যথাযথ মানসিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই স্রোত ঠেকানো সম্ভব। আত্মহত্যা হচ্ছে সর্বোচ্চ সাইকিয়াট্রিক ইমার্জেন্সি, আমাদের এটা মনে রাখতে হবে।

গভীর পারিবারিক বন্ধন, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং নৈতিকমূল্যবোধ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনক। ‘আত্মহত্যার নীরব মহামারী চলছে বাংলাদেশে’ এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে জার্নালে। চারপাশের সবার সহযোগিতা পেলে আত্মহত্যা ঠেকানো সম্ভব। মনের দাবি অবহেলা করার সুযোগ নেই আর। এই দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী অবশ্যই প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্চায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য সেক্টরকে।

নিপীড়িত, নির্যাতিত, সুবিচার বঞ্চিত মতাহীন নারীরা একসময় মানসিকভাবে নিঃস্ব হয়ে নিজের সন্তানকেই একমাত্র পজেশন বা অধিকৃত ধন হিসেবে গণ্য করে, তাকেও খুন করে কিংবা আত্মহত্যার জন্য উদ্বুদ্ধ করে নিজের সঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ঘটেছে এমন অন্তত তিনটি অবিশ্বাস্য নির্মম ঘটনা, যেগুলো গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছে। বেঁচে থাকা অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ এসব নারীকে মনে রাখতে হবে, জোড়া খুনের দায় মাথায় নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে তাদের। এক্ষেত্রে পৃথিবীতেই সে হবে নিন্দনীয়, ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী পরকালেও তাকে ভোগ করতে হবে নরকযন্ত্রণা। বেঁচে থাকা অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের উচিত নির্যাতিত নারীকে সহায়তাদানকারী সংস্থার সাহায্য নেওয়া; মনোচিকিৎসকের কাছে কিংবা দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগে হাজির হওয়া। নিকটস্থ কাউন্সেলরের সাহায্য নিতেও দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া চলবে না। কেন মাথা উঁচিয়ে লড়াই করার শক্তিকে উজ্জীবিত হবে না বঞ্চিত, জখমপ্রাপ্ত নারী? কেন পরাজয় বরণ করবে জীবন সংসারে? কেন আলিঙ্গন করবে মৃত্যু? এমন জিজ্ঞাসায় আমি নিত্য আলোড়িত হই।

বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে যথাযথ ডাটা সংগ্রহ করে, আত্মহত্যা প্রতিরোধে কর্মনির্দেশনামূলক জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন। মানসিক চিকিৎসা গ্রহণের ব্যাপারে বাড়াতে হবে সচেতনতা। শিশুদের শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে দেখাতে হবে নমনীয় মনোভাব, গ্রহণ করতে হবে সহজ কৌশল। কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ-তরুণীদের আবেগের সম্পর্কের ব্যাপারেও নমনীয় হতে হবে বাবা-মাকে। বৃদ্ধদের দেখভাল করার দায়িত্ব রাখতে হবে। পারিবারিক বন্ধন উন্নত রাখার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। যৌতুকপ্রথা প্রতিরোধে আইনগত দিকের জোরালো বাস্তবায়ন প্রয়োজন। নারী শিক্ষা ও কর্মজীবী নারীদের সম্মানের সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর আর্থিক উন্নয়ন পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। শিতি-অশিতি সব পরিবারেই নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে পারিবারিক সহিংসতা।

দেশে ক্রমশ হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই রোগের সঙ্গে উদ্বেগের ও উৎকণ্ঠার সম্পর্ক কতখানি?

মোহিত কামাল : টিলবার্গ ইউনিভার্সিটি অব নেদারল্যান্ড-এর গবেষক দলের প্রধান এলিজাবেথ জে মারটেনস-এর মতে, অ্যাংজাইটি রোগের কারণে হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত রোগীর বেড়ে যেতে পারে। এর মধ্যে আছে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর এবং মৃত্যুঝুঁকি। নিয়ন্ত্রিত করোনারি হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত এক হাজার রোগীকে প্রাথমিক অবস্থায় অ্যাংজাইটি রোগ অ্যাসেসমেন্টের পর দীর্ঘ পাঁচ বছর ৬ মাস ফলোআপ করে নিচের ফ্যাক্টরগুলোকে ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে বিশেষজ্ঞ দল:
‘ফাইট অথবা ফাইট রেসপন্স’ ঘটে উদ্বেগের সময়। তখনই ঘটে ক্যাটিকোলামিনস জৈবরাসায়নিক পদার্থের ছলকে ওঠা নিঃসরণ। এই পদার্থ বাড়িয়ে দেয় হার্টের ঝুঁকি।
উদ্বেগের কারণে করোনারি হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত রোগীর মনে তৈরি হয়ে থাকে পলায়নপর ইচ্ছা, মনোবৃত্তি (avoidant coping strategy)। এ ধরনের রোগীরা মেডিকেল চিকিৎসা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে, পালিয়ে বেড়ায়। এই সুযোগে বেড়ে যায় হার্টের ঝুঁকি।

উল্টো চিত্রও রয়েছে। উদ্বেগের কারণে হৃদরোগের সামান্য উপসর্গেও ভীত হয়ে বার বার তারা মেডিকেল চেকআপের জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। এর কারণে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ খুঁজে পাননি গবেষকরা। সাধারণ উদ্বেগ রোগ বা জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের কারণে কার্ডিওভাসকুলার রোগের জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায় ৭৪ শতাংশ। সহজে চিকিৎসা করা যায় সাধারণ উদ্বেগ রোগ। করোনারি হার্ট ডিজিজের রোগী এ ধরনের উদ্বেগে ভুগলে চিকিৎসার মাধ্যমে বিরাট ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব, এ কথা মনে রাখতে হবে অভিভাবক, রোগী ও চিকিৎসকদের।

বিষন্নতা নামক মানসিক সমস্যায় ভোগেন প্রচুর মানুষ। এর সঙ্গে দৈহিক কোনো ব্যাধির সম্পর্ক রয়েছে কী?

মোহিত কামাল : অবশ্যই রয়েছে। কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের পর শ্বাসযন্ত্রের রোগ যেমন হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)-ই গ্লোবাল কিলার হিসেবে পরিচিত ব্যাধি। প্রায় ৪০ ধরনের শ্বাসযন্ত্রের রোগ ক্রমান্বয়ে খারাপ অবস্থার দিকে ধাবিত হয়, জীবনযন্ত্রণা বাড়িয়ে তোলে। তখন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যায় মানসিক ও আবেগীয় সমস্যা। এ ধরনের রোগগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে বিষন্নতা ও উদ্বেগের। মানসিক এ সমস্যার কারণে শ্বাসযন্ত্রের রোগীদের বারবার ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। এজন্য বলা হয়েছে, অ্যাজমা ও সিওপিডি রোগীদের উন্নতির জন্য অবশ্যই বিষন্নতা ও অ্যাংজাইটির চিকিৎসা করাতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁপানি ও সিওপিডি রোগীদের ২০ শতাংশ বিষন্নতা এবং অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে (জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, প্যানিক ডিসঅর্ডার ও ফোবিয়া) ভোগে।
 
ক্যান্সারের সঙ্গেও মানসিক রোগের সম্পর্ক রয়েছে। বয়স্ক, শিশু-কিশোর সবার ক্ষেত্রে ক্যান্সার ডায়াগনোসিস হলে জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রতি ৪ জনে ১ জন বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। ক্যান্সার-আক্রান্ত যেসব রোগী বিষন্নতা অনুভব করেন তাদের মৃত্যুহার ২৫  শতাংশ বেড়ে যায়, যাদের ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে তাদের এ হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৯ শতাংশে। সামগ্রিকভাবে দেখা গেছে, ক্যান্সারের রোগীদের বিষন্নতারোগে ভোগার হার ১৫-২৫ শতাংশ। গুরুতর মানসিক রোগ, সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ স্তন ও ফুসফুসের ক্যান্সার। সাধারণ জনগোষ্ঠী অপো সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর হার দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। ক্যান্সারের রোগীদের মানসিক সমস্যা চিকিৎসার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ডিপ্রেশনে ভুগলে ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধির হার বেড়ে যায় দ্রুতগতিতে। দ্রুতগতি রোধ করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে চিকিৎসকদের। একইভাবে বলা যায়, সিজোফ্রেনিয়া রোগীর ক্ষেত্রে ফুসফুস ও স্তনের ক্যান্সার চিকিৎসার গুরুত্ব দিতে হবে।

জাতীয়ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে হলে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে?

মোহিত কামাল : অবশ্যই বিজ্ঞানচর্চা বাড়াতে হবে। বাঙালির বদনামই আছে বিজ্ঞানবিমুখতা নিয়ে। এই দুর্নাম ঘোচাতে হবে। এরপর মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য খাতে লোকবল বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সঙ্গে সুযোগ-সুবিধাও বাড়াতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি হাসপাতালগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। মেডিক্যাল শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা করতে হবে। অনেক কিছুই করতে হবে।

দেশের ব্যাপকসংখ্যক মানুষ হিন্দি সিরিয়াল ও অনুষ্ঠানে আসক্ত, বিশেষ করে নারীদের ভেতর এই প্রবণতা বেশি। এর নেপথ্য কারণ কী বলে মনে হয়?

মোহিত কামাল : নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। ভারতীয় টেলিভিশনের হিন্দি সিরিয়ালে পরকীয়া প্রেম, বিশেষ করে পরিবারে অসম সম্পর্কের নারী-পুরুষের ভেতর প্রেমাবেগের ব্যাপারটিই মূল পুঁজি। ওই সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আমাদের সমাজে অচল। অথচ এসবই আমাদের দেশের বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা উপভোগ করছেন। তাদের ব্রেনে প্লেজার প্রোগ্রামড হয়ে যাচ্ছে। আর তাই তারা হিন্দি সিরিয়ালে আসক্ত হয়ে পড়ছেন, যা সংগোপনে এক সূক্ষ্ম ক্ষতিকর পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে সমাজে। স্ত্রীরা এখন অকারণেও স্বামীদের সন্দেহ করছেন। এতে পারিবারিক সৌন্দর্য ও বন্ধন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। অবশ্যই এর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। টেলিভিশন হচ্ছে ফ্যামিলি মিডিয়া। আমাদের দেশের মূল্যবোধের বিবেচনায় টিভিতে যা খুশি তা প্রদর্শনের সুযোগ থাকা সমীচীন নয়। এর একটা সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যা নেতিবাচক।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০১০, অক্টোবর ০৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।