ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

হারিয়ে যাচ্ছে পুতুল নাচ

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২৩
হারিয়ে যাচ্ছে পুতুল নাচ রংবেরঙের বাহারি পুতুল।

বরিশাল: হাট-বাজার কিংবা খোলা মাঠের মঞ্চে এখন আর চোখে পড়ে না পুতুল নাচের আসর। যেখানে রংবেরঙের বাহারি পুতুল সাজিয়ে তার সঙ্গে সুতা বেঁধে হাতের কারুকাজের পাশাপাশি বাদ্য, গান, নাচ ও অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হতো ‘এক ফুল দুই মালি’, ‘কাশেম মালার প্রেম’, বেহুলা সুন্দরী, নৌকা বাইচ, সাগরভাসাসহ বিভিন্ন পালা।



পুতুল নাচের এই পালা দেখতে ১০ থেকে ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভিড় করতেন দর্শনার্থীরা। এখন আর চোখে পড়ে না সেই দৃশ্য। এক কথায় সময়ের সঙ্গে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার এক সময়ের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ। কিছু কিছু বড় ধরনের মেলায় পুতুল নাচের দেখা মিললেও এই নাচের আড়ালে অসাধুদের অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শনের অভিযোগে এখন এসবের অনুমতিও দিতে দেখা যায় না প্রশাসনকে।

সবমিলিয়ে পুতুল নাচ বন্ধে অর্থকষ্টে দিন পার করছেন বরিশালের বরিশালের আগৈলঝাড়ার ঐহিত্যবাহী দি তিশা পুতুল নাচ, দি গ্রাম-বাংলা পুতুল নাচ, দি থ্রি-স্টার অপেরা, মনফুল পুতুল নাচ, দি আল্পনা পুতুল নাচসহ অন্তত পাঁচটি পুতুল নাচের দলের মালিক ও শিল্পীরা। এখন অর্থের অভাবে তারা করছেন মানবেতর জীবনযাপন।

পুতুল নাচের দলের সঙ্গে জড়িত মানিক বিশ্বাস নামের এক শিল্পী জানান, এক সময় পুতুল নাচের আসর নিয়ে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সময় পার করত। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে পুতুল নাচের আসর না পাওয়ায় আয় রোজগার না থাকায় পেশা বদল করে এখন দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন অনেকেই।

সুদিনের স্মৃতি হাতরে সজল বালা নামের এক শিল্পী বলেন, আগৈলঝাড়া উপজেলার কদমবাড়ি মেলায় একরাতে সর্বাধিক আড়াই লাখ টাকার পুতুল নাচের টিকিট বিক্রি হয়েছিল। যে পুতুল নাচের প্যান্ডেলে ৩ হাজার দর্শক বসার ব্যবস্থা ছিল।

পপি ভাকুক নামে অপর শিল্পী জানান, তখন এক-একটি পুতুল নাচের দলে ২০-২৫ জন লোক কাজ করতেন। প্রতি রাতে তিনটি করে পুতুল নাচের শো প্রদর্শন করা হতো। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে বেশ ভালো টাকাই লাভ হতো জানিয়ে দি গ্রাম-বাংলা পুতুল নাচ দলের সাবেক ম্যানেজার জয়ন্ত বিশ্বাস তখন এতই রমরমা অবস্থা ছিল যে বিভিন্ন পুতুল নাচের দলের মালিক দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুতুলসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ভাড়া করে এনে নিজের দেওয়া নামে পুতুল নাচের দল চালাতো।

আগৈলঝাড়ার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচের দল দি তিশা পুতুল নাচ এর মালিক ননী সরকার বলেন, আমার পুতুল নাচের দলে শিল্পীসহ ২৫ জন লোক ছিল। প্রত্যেককে প্রতিদিন ৫/৭শ ও এক হাজার টাকা করে বেতন দিতাম। আগে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় পুতুল নাচের শো দেখিয়ে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় হতো। তবে কিছু কিছু অসাধু লোকজন এই পুতুল নাচের নামে অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শন করানোর কারণে এই পুতুল নাচ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এখন আর কেউ পুতুল নাচের আসরের জন্য তাদেরকে ডাকে না। যে কারণে বর্তমানে ঘরে বসে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৫ লাখ টাকার পুতুল নাচের সরঞ্জামসহ বিভিন্ন ধরনের পুতুল।

তিনি জানান, ২০১১ সালে আমার পুতুল নাচের দলের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়। তখন তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে বরিশালের জেলা প্রশাসকের অফিসে লাইসেন্স নবায়ন করতে গেলে, তা নবায়ন হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।  আর বর্তমানে পুতুল নাচ বন্ধ থাকায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। কেউ কেউ আবার পৃথিবীর মায়াও ত্যাগ করে গেছেন। তাইতো এই আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐহিত্যবাহী পুতুল নাচ প্রদর্শনের অনুমতির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।

আগৈলঝাড়া গ্রিন থিয়েটার এবং ‘ব্যান্ড মাতৃভূমি’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক স্বপন দাস বলেন, পুতুল নাচের মাধ্যমে আমাদের আবহমান গ্রাম-বাংলার লোকজ সংস্কৃতির নানা দিক ফুঠে উঠতো। এক সময় পুতুল নাচ গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে দীর্ঘদিন ধরে পুতুল নাচ প্রদর্শন বন্ধ থাকায় নতুন প্রজন্মের কাছে এর পরিচিত কমে গেছে।

যদিও কিছু কিছু অসাধু লোকজন বাড়তি লাভের আশায় পুতুল নাচের নামে অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শন করানোর মাধ্যমে যুব সমাজকে বিপদগামী করতো। এ কারণেই হয়তো সরকার পুতুল নাচ প্রদর্শনে অনুমতি দিচ্ছে না। তবে  সরকারের উচিৎ সঠিক তদারকির পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুতুল নাচ প্রদর্শনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে এর প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা।

আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, পুতুল নাচ প্রদর্শনের অনুমতির বিষয়টি আমার ভালো জানা নেই। লাইসেন্স নবায়নের জন্য আমার কাছে কেউ এলে আমি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগাযোগ করার জন্য বলব।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২৩
এমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।