ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

বনভূমি নষ্ট আর খাদ্যাভাব

লোকালয়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে মধুপুরের বন্যপ্রাণী

এসএম শহীদুল্লাহ, মধুপুর প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১২
লোকালয়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে মধুপুরের বন্যপ্রাণী

মধুপুর(টাঙ্গাইল): খাদ্যাভাব ও আবাসস্থল সংকটের দরুন দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল মধুপুর গড়ের বন্যপ্রাণীরা কাঁচার প্রয়োজনে নিজেদের আবাস ছেড়ে লোকালয়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।

প্রায় প্রতিদিনই বনাঞ্চলের আশপাশের গ্রামে এ মর্মান্তিক এসব ঘটনা ঘটছে।

স্থানীয় বন বিভাগ বিলুপ্ত প্রায় এসব প্রাণী সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখছেনা বলে এলাকাবাসির অভিযোগ।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ও ফুলবাড়িয়া এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার সাড়ে ৬২ হাজার একর বনভূমি মধুপুর বনাঞ্চল নামে পরিচিত। সরকার রাবার চাষের জন্য ১৯৮৭ সালে এ বনাঞ্চলের সাড়ে সাত হাজার একর বনভূমি বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থাকে হস্তান্তর করে। এছাড়া প্রায় এক হাজার একর বনভূমি নিয়ে তৈরি করা হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর রসুলপুর ফায়ারিং রেঞ্জ।

‌রে সমান্তরালে মুক্তাগাছা ও ফুলবাড়িয়া উপজেলার সাড়ে ১৭ হাজার একর বনাঞ্চলের প্রায় পুরোটাই বিরান ও বেদখল হয়ে গেছে। শুধুমাত্র মধুপুর উপজেলায় ১২ হাজার একর বনাঞ্চল কোনোভাবে টিকে রয়েছে। ওই ১২ হাজার একরের মধ্যে ৫ হাজার একর হলো আবার কৃত্রিম বন। বিদেশি প্রজাতির বৃক্ষে কমার্শিয়াল প্ল্যানটেশন করা এ কৃত্রিম বনের গাছপালার ফুল, ফল ও লতাপাতা পশুপাখির খাবার অনুপযোগী।

এজন্য এ মনোকালচার বা একক বৃক্ষের বনে পশুপাখি বাসা বাঁধেনা, নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে বেছে নিতে পারে না। এমনকি নিবিভঘ্নে প্রজণন কার্যক্রমও ঘটাতে পারেনা। এ বাস্তবতায় জাতীয় সদর উদ্যান রেঞ্জ, দোখলা রেঞ্জ ও চাড়ালজানি বিট কোনোভাবে টিকে থাকা সাত হাজার একর বহুস্তর বিশিষ্ট প্রাকৃতিক জঙ্গলই হলো বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল। এ বনে এখনো হরিণ, বাগডাসা, বানর, হনুমান, বনমোরগ, খরগোশ ও কচ্ছপসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি দেখা যায়।

কিন্তু প্রাকৃতিক বনের চিরায়ত গাছপালা যেমন আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, সিধা, কাইকা, সিন্ধুরি, জয়না, পলাশসহ নানা প্রজাতির বড় গাছপালা পাচার হয়ে যাওয়ায় বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক খাবার, প্রজনন ও আশ্রয়স্থল সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
উল্লেখ্য, পশুপাখির খাদ্য সঙ্কট নিরসনের জন্য ২০০২ সালে বন বিভাগ মধুপুর ন্যাশনাল পার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় দোখলা ও লহুরিয়া বিটের ৫০০ একরে দেশি প্রজাতির ফলদ বাগান সৃজন করে। কিন্তু দুদফা অগ্নিকাণ্ড ও সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা নির্বিচারে গাছ কেটে ইট ভাটায় চালান দেয়ায় এসব ফলদ বাগান বিরান হয়ে গেছে।

প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে ঝরাপাতার বন মধুপুরে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বনভূমিতে শুকনো পাতার পুরু আস্তরন পড়ে থাকায় এ বনে একবার আগুন লাগলে তা সহজে নেভে না। চলে ২/৩ দিন জুড়ে। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে বিনষ্ট হয় সবুজ তৃণভূমি, ভেষজ বৃক্ষ, গুল্মলতাদি, বন্জ ফুলফল, গোটা ও কচি পাতা।

অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বন্যপ্রাণী ও পশুপাখি। খাদ্যাভাবে কাহিল এবং আবাসস্থল হারানো অসহায় প্রাণীগুলো চলে আসে লোকালয়ে। বনের বুক ভেদ করে চলে যাওয়া টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ ব্যস্ততম হাইওয়ে পার হতে গিয়ে প্রায়ই যন্ত্র দানবের চাকায় পিষ্ট হয় অসহায় এসব বন্য প্রাণী। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ দু’মাসে পাঁচটি হনুমান, ৬টি বানর একটি বাগডাসা এবং তিনটি বন্য খরগোশ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। এ সংখ্যা প্রকুত হিসাবে আরও বেশি বলে জানিয়েছেন কাকরাইদ এলাকার মিঠুন সরকার।

জাঙ্গালিয়া গ্রামের অসিত মাংসাং বাংলানিউজকে  জানান, গাছ চোরের উপদ্রবে গজারি বন পাতলা হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীরা আর বনে নিরাপদে লুকিয়ে থাকতে পারে না। বিশেষ করে বনের মায়া হরিণ প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসে। আর সুযোগ সন্ধানী মানুষ তাদের শিকার করে।

পঁচিশ মাইল গ্রামের সুমি নার্সারির মালিক ওমর শরীফ জানান, বানর-হনুমান দল বেঁধে লোকালয়ে এসে আনারস ও কলা বাগানে হামলা চালায়। গাছের নারিকেল, পেঁপে, আম, আতাফল, মিষ্টি বরই, তুলার কাঁচা বোল, কচি কামরাঙ্গা, সজনে, লাউ, কুমড়া, শিমসহ নানা ফল ও সবজি তচনচ করে। বেড়িবাইদ গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, এরা কাঁচা আনারস খামচে তুলে গোড়ার সাদা পাতা খায়। একবার কোনো বাগানে হামলা চালালে বারংবার সে বাগানেই তারা দল বেঁধে  ফিরে আসে এবং জমির সব ফল বিনষ্ট না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়না। এতে উত্যক্ত গৃহস্থরা লাঠিসোটা নিয়ে তাড়া করেও তাদের যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পান না। পরবর্তীতে দলবলে আরো ভারি হয়ে ফিরে আসে ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলো। চোখের পলকে কচি আনারস কামড়ে ছিড়ে এবং চর্তুদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিনষ্ট করে।

অপরদিকে, এদের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য গৃহস্থরা বিষটোপ ব্যবহার করে বলে অভিযোগ জানা গেছে। ফলে বিষাক্রান্ত হয়েও অনেক সময় মারা যায় এরা।

বনাঞ্চলের কোনো কোনো অংশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কলা চাষ হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকার ও মহাজনরা এখান থেকে কেনা কলা ট্রাকে ভরে নিয়ে যায়। ট্রাকে কলা লোড করার পর বানর-হনুমানরা পাকা কলার লোভে সবার অগোচরে গাছ থেকে লাফিয়ে চড়ে বসে ট্রাকে। এ সূত্রে এসব কলাবাহী ট্রাকে করে নিজের অআন্তে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চালান হয়ে যায় মধুপুর বনাঞ্চলের বানর-হনুমান।

সম্প্রতি কলার ট্রাকে চালান হয়ে আসা তিন হনুমান নিয়ে বিপাকে পড়ে টাঙ্গাইলের গোপালপুর ও ভূঞাপুর উপজেলার ৫০ গ্রামের মানুষ। মধুপুর জঙ্গল থেকে চলে আসা ওই তিন হনুমান আলমনগর, ঝাওয়াইল, হেমনগর, মির্জাপুর ও অর্জুনা ইউনিয়ন চষে বেড়ায়। পরে গ্রামবাসির পিটুনিতে তারা অসহায়ভাবে প্রাণ হারায়।

খাবারের অভাবে মধুপুর বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণীদের জামালপুর সদর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, ঘাটাইল, সখিপুর, গোপালপুর, সরিষাবাড়ি এবং ভূঞাপুর উপজেলার গ্রামগঞ্জেও খাদ্যাভাবে পাড়ি জমাতে দেখা যায়।

এ ব্যাপারে মধুপুর বনাঞ্চলের সহকারী বন সংরক্ষক রাজেশ চাকমা বাংলানিউজকে জানান, বনাঞ্চলের মাঝ বরাবর চলে যাওয়া মহাসড়কে যানবাহনে পিষ্ট হয়ে যাতে বন্য প্রাণীর প্রাণহানি না ঘটে সেজন্য বনের উভয় দিকের প্রবেশ পথে রসুলপুর ও পঁচিশমাইল বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি চালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকালয়ে বন্যপ্রাণী নিধনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। তবে কেউ এধরনের অভিযোগ নিয়ে কখনো আসেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯16 ঘণ্টা, ২৮ মার্চ, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।