ঢাকা, শনিবার, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

‘করুণ পাপিয়া’র করুণ সুর

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
‘করুণ পাপিয়া’র করুণ সুর গাছের ডালে বসে রয়েছে ‘করুণ পাপিয়া’। ছবি: সৌরভ মাহমুদ

মৌলভীবাজার: চা বাগানের পড়ন্ত বিকেল। চায়ের গাছে গাছে শীত মৌসুমের আমেজ। সমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ছায়াবৃক্ষে তখন পাখিদের শেষ সময়টুকু কাটানোর তাগিদ। তারপর নির্দিষ্ট একটি গাছে সঙ্গীদের সাথে রাতযাপনের পালা। একটু পরই নামবে দীর্ঘরাত।

আগত সোনালি সন্ধ্যার প্রকৃতিতে তখন নানা পাখির সুর। এর মধ্যে একটি পাখির সুমিষ্ট সুর গভীর মনোমুগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছে।

তার কণ্ঠস্বরে যেন সবটুকু মায়াময়তা। আপন সৌন্দর্য তুলে ধরে তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে টিলা-উপটিলায়। এটি কি বেদনার্ত গান? নাকি প্রিয়াকে খুঁজে পাওয়ার করুণ আর্তনাদ!

‘পিউ পিউ বলে পাপিয়া’- কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্ভবত পাপিয়াদের ডাকে মুগ্ধ হয়েই গানটি রচনা করেন। গ্রামাঞ্চলের ছায়াঘেরা ঘন ঝোপে লুকিয়ে ঘুরে বেড়ানো পাখিটির নাম করুণ পাপিয়া। এটি ছোট আকারের কোকিল।

করুণ পাপিয়ার ইংরেজি নাম Plaintive Cuckoo এবং বৈজ্ঞানিক নাম Cacomantis merulinus। এরা গাছের আড়ালে বসে স্পষ্ট ও সুমধুর সুরে শিস দেয়। বাসা তৈরির ক্ষেত্রে আজন্ম ব্যর্থ তারা। কখনোই এরা নিজেরা বাসা তৈরি করতে পারে না। পরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। শুধুই সুযোগ সন্ধানী হয়ে তারা ঘুরতে থাকে - কখন ‘রেডিমেইড’ বাসা খুঁজে পাবে। কখন দ্রুত ডিম পেরে পালিয়ে যেতে পারবে!

ফুটকি, প্রিনা ও টুনটুনিসহ অন্যান্য পাখির বাসায় ডিম পেরে রেখে আসে মেয়ে পাখিটি। অন্য পাখিরা নিজের ডিম ভেবেই তা দিতে থাকে, এক সময় ডিম ফুটে ছানা বের হয়। নিজের ছানা ভেবেই পরম স্নেহ-মমতায় তাদের মুখে খাবার তুলে দেয় সেইসব পাখি। তারপর একসময় তারা বুঝতে পারে যে এটি তার সন্তান নয়। ততদিনে ছানাগুলো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিজেরা শিখে যায় খাবার খেতে এবং উড়ে যেতে।

পাখি ও প্রকৃতি বিষয়ক গবেষক সৌরভ মাহমুদ বলেন, এটা আসলে কোকিল। আমাদের দেশে অনেক প্রকারের কোকিল রয়েছে। কোনোটাকে পাপিয়া, কোনোটাকে ‘চোখ গেল’, আবার কোনোটাকে ‘বউ কথা কও’ বলে। আমাদের দেশে কোকিলের ৮টি গণের ১৮টি প্রজাতির আছে। তবে অধিকাংশই পরিযায়ী। ‘করুণ পাপিয়া’ আমাদের দেশের সুলভ আবাসিক পাখি। তবে কোনো কোনো পাঠ্যপুস্তকে এ পাখিটির নাম ছোট ভরাউ হিসেবে লিলিবদ্ধ আছে।

সৌরভ মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে সব জায়গাতেই কমবেশি এদের বিচরণ রয়েছে। তবে গ্রামের দিকে একটু বেশি এদের দেখা মেলে। আমি এই প্রজাতির পাখিদের একবার করে সুনামগঞ্জ, বরিশাল, খুলনায় এবং দু’বার চাপাইনবাবগঞ্জে দেখেছি। এরা সবসময় পাতার আড়ালে-আবডালেই থাকে। সহজে দেখা দিতে চায় না। গ্রামের বাড়ির পিছনের জঙ্গলে। কখনো কখনো হাওরের ঝোপ-ঝাড়ে লুকিয়ে বেড়ায় বলে জানান তিনি।

সৌরভ মাহমুদ আরো বলেন, পুরুষ পাখির পিঠের পালক ধূসর আর বুকের পালক কমলা রঙের। মাথা, ঘাড়ের পাশ ও গলা ছাই-ধূসর। লেজ ধূসর কালো। লেজের আগা সাদা এবং বাইরের পালকে তীর্যকভাবে ডোরাকাটা। মেয়ে পাখির চেহারা দুই ধরনের। এক ধরনের চেহারা পুরুষ পাখির মতো। উভয় পাখির চোখ সাদা। পা বাদামি হলদে। ঠোঁট শিঙ-বাদামি। প্রজনন মৌসুমে ছেলেপাখিটি মিষ্টি সুরে ডাকে। প্রধানত একাই থাকে। তবে মাঝে মাঝে জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। এরা বিশ্বে এবং আমাদের দেশে বিপদমুক্ত অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্র জানায়, পৃথিবীতে Cacomantis গণের ৮ প্রজাতির পাপিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে করুণ পাপিয়া ছাড়াও আরো দুই প্রজাতির পাপিয়া রয়েছে। এরা হলো মেটেপেট পাপিয়া এবং দাগি তামাপাপিয়া। করুণ পাপিয়ার দৈর্ঘ্য ২৩ সেমি. এবং ওজন ২৫ গ্রাম। খাদ্য তালিকায় রয়েছে ছারপোকা, শুয়োপোকা, ফল প্রভৃতি। ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
বিবিবি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।