ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

তীর-ধনুকের শিকার ভুলে গেছেন নিমাই মুন্ডা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৭
তীর-ধনুকের শিকার ভুলে গেছেন নিমাই মুন্ডা নিমাই মুন্ডা। ছবি- বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

মৌলভীবাজার: ‘চারদিক নিস্তব্ধ। ভোর হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। শেষ রাত থেকেই কিছু একটা শিকার করার স্বপ্ন নিয়ে এসেছি। ঘন জঙ্গল ঘিরে আমরা মাত্র দুজন লোক। তীর আর ধনুক ছাড়া হাতে তেমন কোনো অস্ত্র নেই।

‘রাতের আঁধার কেটে যেতেই বন-মোরগের দল ধানক্ষেতে নামতে শুরু করবে। অধীর আগ্রহের অপেক্ষা এক সময় শেষ হলো।

তিন জোড়া জঙ্গলি মোরগ চলে এসেছে আমাদের সামনে। আমি বনের ঝোপঝাড়ে ঢাকা লুকানো এক অংশ থেকে একটাকে টার্গেট করি এবং তীর ছুঁড়ি। ’

‘আমার হাতে এইম ছিল মারাত্মক। আমার পাশের জন ছোঁড়ার আগেই আমি সব চেয়ে বড় বন-মোরগটির শরীরে তীর গেঁথে দেই। সেটি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যায়। অন্য মোরগগুলো উড়াল দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ’

এভাবেই প্রায় ত্রিশ বছর আগের শিকার জীবনের স্মৃতিমন্থন করেন এলাকার এক সময়ের শিকারী এবং দৃষ্টিনন্দন গোঁফের অধিকারী ‘নিমাই মুন্ডা’। এখন তিনি অকেজো। এই শব্দটা তার পরিবার তাকে দিয়েছে। বয়সের ভারে অনেকটাই কাতর তিনি।    

অথচ এক সময় পরিবারের সবচেয়ে বেশি আয়-রোজগারের মানুষ ছিলেন নিমাই। আজ বড় একা। নিঃসঙ্গ দুপুর বা পড়ন্ত বিকেল অথবা বিষন্ন সন্ধ্যায় তিনি থাকেন আত্মজৈবনিক সংলাপে মুখর। একা একা ঘুরে বেড়ান এলাকার পথপ্রান্তর।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিমাই মুন্ডা।  ছবি- বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপনশ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট ইউনিয়নের মংড়াবস্তি। এখানে মুন্ডা নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বাস। প্রায় ত্রিশ মুন্ডা পরিবার একত্রিত হয়ে গোত্র সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে এখানে।

শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) দুপরে মংড়াবস্তির কোণ ঘিরে দেখা গেল ‘মুন্ডা’ নৃ-গোষ্ঠীর বিচরণ। ছায়াঢাকা মায়াময় গ্রামটি তখন শিশুদের দৌড়ঝাঁপে মুখর। শৈশবকালকে তারা একটি জায়গায় ঠাঁয় দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছে না; প্রাণপনে গোল্লাছুট খেলার মতো করে এগিয়ে নিয়ে চলেছে এদিক-ওদিক।     

তবে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও ঐতিহ্য বিলুপ্ত হতে চলেছে। শনবাঁশের ঘরের পরিবর্তে তারা এখন ঢেউ টিন দিয়ে পাকা গৃহ নির্মাণে অধিক আগ্রহী। এক সময়ের ব্যাপকভাবে প্রচলিত ‘ঢেঁকি’-তে আর পা পড়ে না তাদের। বসতঘরের রাখা ঢেঁকিটি জীর্ণ অবস্থায় অবহেলা পড়ে রয়েছে একপাশে।

নিমাই মুন্ডা প্রথমে কথা বলতে চাইলেন না। তীর-ধনুকের প্রসঙ্গ উঠতেই এড়িয়ে গেলেন। পরে তাকে তার পরিবারিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নির্দশনের কথা বললে তিনি রাজি হয়ে যান।

তীর-ধনুক বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই বলেন, ‘তখন ছিল ঘন বন-জঙ্গল। মনের মাঝে লেগেই থাকতো শিকারের নেশা। হঠাৎ কোনো বন-মোরগের ডাক বা

বন্য-শুকরের উপস্থিতি টের পেলেই মনটা আনন্দে ভরে উঠতো। কিন্তু এখন দিন সম্পূর্ণ পাল্টেছে। ’  

‘এখন পাহাড় নাই বাবু, সব পাহাড় শেষ। আর শিকারের মন-মানসিকতাই নাই। সত্যি বলতে কি, আগের মতো বন্যপ্রাণীও নেই। যেগুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোকে না মেরে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখন আমরা তীর-ধনুক রাখি শুধু চোর-ডাকাত তাড়াতে। ’

প্রাক্তন এক শিকারী আদিবাসীর বন্যপ্রাণী বিষয়ক এমন কথা শুনে বিস্ময় জাগলো ঢের! এগুলো কী বললেন তিনি! অজোপাড়াগাঁয়ের এই মানুষটি তবে কি করে বন্যপ্রাণী ভাবনায় এতোটা উদার হলেন?

এ প্রশ্নগুলো উত্তরের অপেক্ষার প্রহর গুনছে। হঠাৎ নিমাই মুন্ডা বললেন, ‘আর কথা বলতে পরবো না বাবু। আমার নাতিটা খুব অসুস্থ; তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।