ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

মহানগর: রাতের নগরীর সফল দর্শন

মুহাম্মাদ আলতামিশ নাবিল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২১
মহানগর: রাতের নগরীর সফল দর্শন

‘জীবনে দুইটা জিনিসই সত্য, এক কর্ম, দুই কর্মফল!’- দুই বাংলায় সাড়া জাগানো ওয়েব সিরিজ ‘মহানগর’-এর প্রধান চরিত্র ওসি হারুন তার ডেপুটি মলয়কে এই উপদেশটি দিয়ে সিরিজটির শেষ পর্বে থানা ত্যাগ করেন।  

শুধু এটাই নয়, পুরো সিরিজ জুরে ওসি হারুন বাতলে গিয়েছেন দু’টি করে নানা উপদেশ, পরামর্শ, মতামত।

বাঁকা আঙ্গুল বনাম সোজা আঙ্গুল, সমস্ত সময় জুড়েই ওসি হারুন ও মলয়ের তথাকথিত সিস্টেমের পক্ষে-বিপক্ষে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলে। আর এর ফাঁকে ফ্রেমে ফুটেয়ে তোলা হয়েছে নানা রঙ্গের-ঢঙ্গের মানুষদের। আট পর্বের সিরিজটিতে মাত্র এক রাতের গল্পে রাজধানী ঢাকাকে আবিষ্কার করা হলো ভিন্ন এক রূপে।

নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবিয়ালের মাধ্যমেই নির্মাণ জগতে আসেন ‘মহানগর’ সিরিজটির পরিচালক আশফাক নিপুণ। এরপর ছবিয়াল ছেড়ে স্বতন্ত্রভাবে কাজ শুরু করে ‘ল্যান্ডফোনের দিনগুলিতে প্রেম’ ও ‘কষ্টনীড়’র মতো দর্শকপ্রিয় মুকিম ব্রাদার্সের মতো কাজ দিয়ে একের পর এক নিজের জাত চিনিয়েছেন। তবে এবারে তিনি যা নির্মাণ করেছেন তা দর্শক সাফল্যের মাপকাঠিতে একজন পরিচালকের ক্যারিয়ারে বারবার আসেনা। ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হৈচৈ -এ কাজটি মুক্তি পাওয়ার পর ওপার বাংলার গুণী নির্মাতাদের নির্মাণগুলোকে পাশে ফেলে জয় করেছেন দুই বাংলার দর্শকের মন।

সিরিজটির শুরুতেই যেটি মনে ধরে যায় তা হলো, এর টাইটেল ট্রাকের সেই আবহসংগীত এবং সেখানে ভিন্নরূপে রাতের ঢাকার চিত্রায়ন। রাজধানীর একটি অতি সাধারণ রাত পরিণত হয়েছে চাঞ্চল্যকর রাতে। শিল্পপতির ছেলে আফনান চৌধুরী মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে গাড়িচাপা দেয় এক সাইকেল চালককে। এরপর থানা, পুলিশ, মিডিয়া! সেই রাতের সময় যতটা গড়িয়েছে, সাসপেন্সের ততই পারদ ঊর্ধ্বগামী হয়েছে।  

টাকার কাছে হেরে যেতো ন্যায়বিচার, কিন্তু সেই থানার ওসি হারুনের কারণে সেটি হলো না! আফনান চৌধুরীকে ঠিকই চালান করা হলো আদালতে। আট পর্বের মহানগরের প্রথম সিজনের পর্বগুলির নাম নামগুলো যথাক্রমে ‘ঈশানের মেঘ’, ‘চিচিং ফাঁক’, ‘শাপে বর’, ‘গলার কাঁটা’, ‘অমাবস্যার চাঁদ’, ‘অন্ধের যষ্টি’, ‘গোড়ায় গলদ’ ও ‘কিস্তিমাত’। সম্ভবত থ্রিলার নির্মাণের প্রয়াস থেকেই পর্বগুলোর সাংকেতিক শিরোনাম।  

পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা সিরিজটি নিয়ে আলোচনায় লিখেছে, মহানগর ওয়েব সিরিজে সম্পদ হয়ে থাকলো ‘অভিনয়’। আমি দর্শক হিসেবে লাইনটি কিছুটা সম্পাদনা করে দিয়ে বলতে চাই, মহানগর ওয়েব সিরিজে সম্পদ হয়ে থাকলো ‘মোশাররফ করিমের অভিনয়’। কী দুর্দান্ত সংলাপের ভঙ্গি, পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অভিব্যক্তির কী দারুণ পরিবর্তন। অভিনেতা হিসেবে মোশাররফ করিমের নিজেকে প্রমাণের ইতিমধ্যেই কিছু বাকী নেই। এই কাজটি দিয়ে নিজেকে ‘কিংবদন্তি’র কাতারে নিয়ে গেলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।  

মলয় কুমার চরিত্রে মোস্তফিজুর নূর ইমরান, আবির হাসান চরিত্রে খায়রুল বাশার, ব্যবসায়ী পুত্র আফনান চৌধুরী চরিত্রে শ্যামল মাওলা ছিলেন ঠিকঠাক ও মার্জিত। সিরিজের মাঝে এক পশলা হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছে ছিনতাইকারীর চরিত্রে নাসির উদ্দিন খানের অভিনয়। তবে দৃঢ়চিত্ত এসি শাহানা হুদার চরিত্রে জাকিয়া বারী মম-কে কাস্টিং এর ব্যাপারে পরিচালকের আরও কয়েকবার ভাবা উচিত ছিল বলেই বোধকরি।

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন যেটি ছিল বড় শহরের বুকে এক নারীর লড়াই করে টিকে থাকার গল্প। অন্যদিকে আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’কে মোটা দাগে সোশ্যাল পলিটিক্যাল গল্প হিসেবে অভিহিত করা যায়। তাই এই দুই ‘মহানগর’-এর নাম ছাড়া সেভাবে কোনো মিল নেই। তবে পরিচালক এক সাক্ষাতকারে সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মবার্ষিকীতে তার সিনেমার সঙ্গে এই কাজের নামটি মিলে যাওয়াকে একরকম ‘আনইনটেশনাল ব্রেসিং’ মনে করেছেন।

ওটিটি প্লাটফর্ম হৈচৈ এর কল্যাণে ‘তকদীর’-এর পর মহানগর দেখেছেন ভারতীয় দর্শরাও এবং সেখানকার পত্রপত্রিকার সংবাদ অনুসারে এই সিরিজটিও সেখানে বাজিমাত করেছে। বলিউড-টলিউডের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অঞ্চলে আদ্যোপান্ত বাংলাদেশি একটি প্রডাকশনের এমন সাফল্য এদেশের অডিও-ভিজ্যুয়াল শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিঃসন্দেহে মনে আশার সঞ্চার ঘটায়।

ওসি হারুন মন থেকে সৎ নাকি অসৎ, সেটি নিয়ে খানিকটা ধোঁয়াশা দিয়েই শেষ হয় এর প্রথম সিজনের গল্পটি। তার সত্যিকারের মনস্তত্ত্ব বুঝতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী সিজন পর্যন্ত। ততক্ষণে অভিনয় আর গল্পের মিশেলে বাংলাদেশি একটি ওয়েব সিরিজের সাফল্যের আনন্দে বুদ হয়ে থাকা যাক।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৩ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২১
জেআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।