ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০ রবিউস সানি ১৪৪৬

বিনোদন

‘আমি আমার জন্য বাঁচতে চাই, আমার মতো করে’

আঁখি আলমগীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
‘আমি আমার জন্য বাঁচতে চাই, আমার মতো করে’ আঁখি আলমগীর

আজ ২০২০ এর শেষ দিন। এরমধ্যে একজন বলছিলেন, তোমার জীবন নিয়ে একটা নাটক লেখো, উত্তর দিয়েছি ২৪ পর্বের ধারাবাহিক হবে তাহলে বা মেগা সিরিয়াল।

হঠাৎ মনে হলো ৮ মাস ধরে ভোর ৬ টায় ঘুমাতে যাওয়া আমি আজ সময় মতো ঘুমিয়ে উঠে কী করবো, বরং সকালটা সেলিব্রেট করি কিছু লিখে।  

বছরখানা তো এবার সবার জন্যেই খুব ভালো ছিল না। সামনের বছর খুব ভালো হবে আমি আশা করছি না, তবে এবারের চেয়ে ভালো হতে পারে। ক্ষত হতে যা সময় লাগে, তার থেকে অনেক বেশি সময় লাগে ক্ষত শুকাতে।

২০২০-এর শুধু মার্চ মাসেই আমার শো ছিল ১৮টার উপর, আগে পরের কথা নাই বলি। সব ক্যানসেল হয়েছে। আমি ভেঙে পরিনি। টিমকে সাহস দিয়েছি। বাচ্চাদের আনন্দে রাখার চেষ্টা করেছি। এপ্রিল থেকে আমি অসুস্থ হওয়া শুরু করি। ভীষণ অসুস্থ। বিস্তারিত বলতেই আর ইচ্ছা হচ্ছে না। শুধু বলবো সবাই যখন করোনার ভয়ে ঘরে বসে হাহাকার করেছেন, আমি তখন এক হসপিটাল থেকে আরেক হসপিটালে দৌড়েছি। আমার হাতে ক্যানোলা লাগানো ছিল ২০ দিন। স্যালাইন অ্যান্টিবায়োটিক চলতো, কেন? সেই উত্তর আমাদের যোগ্য ডাক্তাররা আজও দিতে পারবেন কী না জানি না।  

MRI, CT scan, Xray, 100 blood tests সব ছিল ডাল ভাত পানি। আমার ESR কেনো ১৫-২০এর টা ১০৯ ছিল তার উত্তর আমরা কেউ জানি না। শুধু অসুখের জার্নি নিয়ে আরেকদিন লিখবো। তবে শারীরিক না, ভীষণ শক্ত এই আমি ভেঙেছি মানসিক ভাবেও। এত বেশি হসপিটালে যেতাম বলে পরিবারের মানুষের সেফটির কথা ভেবে আমি করোনা না হয়েও নিজেকে এক ঘরে করে ফেলেছিলাম। দূরে সরিয়ে ফেলেছিলাম সবাইকেই। ক্ষমা চেয়েছি অনেকের কাছেই, মৃত্যু ভয় আমাকে খাবলে খাচ্ছিল।  

এখনও প্রতিদিনই একটা ভালো থাকার যুদ্ধ। তবে আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি আগের চেয়ে, কাজ তখনও করেছি, এখনও করছি।

আমার অসুস্থতার যুদ্ধের সময়টা আমি হারিয়েছি অনেক, যা বুঝেছি চিনেছি, উপলব্ধি করেছি তার চেয়েও বেশি। আমার পারিবারিক পরিচয়টা বিশাল, রাজকীয় বললেও ভুল হবে না। শো-অফ নেই কিন্তু এটাই সত্যি। আমার নিজস্ব প্রাপ্তিকে নিন্দুকেরও ছোট করে দেখার অবকাশ সৃষ্টিকর্তা রাখেননি। কিন্তু আমি কি শুধুই আমার পরিবারের ভারী টাইটেলগুলোর উত্তরসূরি মাত্র? আমি শুধু জনগণের? আমি কি শুধুই একজন মা? আমার জীবন কি শুধুই জবাবদিহি, দায়িত্ব আর স্ট্যাটাসের আবর্তে ঘূর্ণায়মান? 

এত কিছুর ভিড়ে ‘আমি কোথায়?’ অনেক ভেবে বুঝেছি, আমাকে আমি অনেক আগেই হারিয়েছি। অপ্রয়োজনীয় বিসর্জন দিয়েছি অনেক, কোন দরকারই ছিল না সেগুলোর। পরিবার কী বলবে, সমাজ কী বলবে, কলিগরা হাসবে, বাচ্চারা কী করবে, মিডিয়া কী লিখবে, এইসব প্রশ্নের তারকাটার বেড়াজালে আমরা বেশীর ভাগ মেয়ে বা মেয়ে শিল্পীরা পাগলপ্রায় হয়ে থাকি। সব ব্যালেন্সের খেলায় একসময় নিজেরাই মানসিক ব্যালেন্স হারাই।

সুখে থাকার অভিনয়ের প্রতিযোগিতায় মেতে থাকি। আসলে কতজন সুখে আছেন? কতজন ঘুমানোর আগে একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে চোখটা বন্ধ করেন না? কতজন আসলে ঘুমান? 

নানান পুরস্কারে আমার ঘর ভরে আছে। সব, সব পেয়েছি। বিশেষ করে ২০১৯, ২০১৮, ২০১৭ ছিল পুরস্কারের বছর। আজীবনের শো বা কনসার্ট-এর সংখ্যা বলতে চাই না। তবে না বলা সংখ্যা ও কিন্তু একটা রেকর্ড। মেয়ে দু’টো মাশাআল্লাহ অনেক বুদ্ধিমতী, যথেষ্ট বাস্তববাদী। ওদের কাছে আমি বা আমার বংশ পরিচয় কোন ম্যাটার করে না। ওরা আমাদের নিয়ে গর্ব করে, তবে এটা ওদের কাছে কিছুই না। ওরা জীবনকে অন্যভাবে চিনেছে। ওরা ওদের জন্য বাঁচবে, ওদের মত চলবে। কিছু আরোপ করে দেওয়া অসম্ভব, তাই বলে ওরা বেয়াদব না। আমি সেভাবেই ওদের বাঁচতে শিখিয়েছি। জীবন তো একটাই। দোষ হোক ভুল হোক ভালো হোক যাই হোক, মেয়েদের আমি একা মানুষ করেছি, তাই ওদের সবটাই আমার। এখানে জবাবদিহির কোন অবকাশই নাই।

২০২০-এ আমি হারিয়েছি অনেক কিছু। যা হারিয়েছি তা ফিরে পাবার নয়। হারিয়েছি মানুষ, হারিয়েছি বিশ্বাস, হারিয়েছি অনেক আনন্দ। যা বুঝেছি, শিখেছি বা দেখেছি তা না হলেও হতো। আমার উপলব্ধি এমনিতেও গভীর, তা আরও গভীর হয়েছে। আমি বুঝেছি মানুষ চেনার কোন শেষ নাই আর শেখার কোন বিকল্প নাই। আমি বুঝেছি যারা প্রবল অনুভূতিপ্রবণ, তারা একা। যারা স্বার্থপর ,লোভী, অনুভূতিহীন, তারা সুখী, যদিও সেই সুখটাও ধার করা। আমি বুঝেছি আমি আমার জন্য বাঁচতে চাই, আমার মত করে। হয়তো পারবো বা পারবো না, কিন্তু এটাই এই বয়সে এই কঠিন বছরের শেষে এসে আমার চাওয়া।  

২০২০-এ আমি সংযমী হয়েছি অনেকটাই। হালকাভাবে  বললে মনে হচ্ছে সামনের বছরগুলোতে বেঁচে থাকলে বড়লোক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ২০২১ থেকে আমি পৃথিবী করোনা মুক্ত চাই। সবার ভালোটাই চাই সব সময়ের মত। আমি আমার মতোই থাকতে চাই, একটু দূরে, একটু একা। বরাবরের মত কাজ করে যেতে চাই, মানুষের পাশে থাকতে চাই। আমি মিথ্যা ঘৃণা করি, তাই বলতেও চাই না শুনতেও চাই না। সত্যের একটা শক্তি আছে যা আমরা ভুলে যাই।  

কারো মনে হতে পারে, ২০২০ শুধু খারাপই ছিল! না, বললাম তো, এটা ছিল শেখার বছর, উপলব্ধির বছর। বন্ধু পেয়েছি, বন্ধু চিনেছি। এভাবে লিখতে পারাটাও আমার জন্যে এক রকম মুক্তি। এই মুক্তি আমার ভীষণ প্রয়োজন...

সবার নতুন বছর ভালো হোক। পরিবার পরিজন ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকুক সবার। জীবন আসে জানান দিয়ে, বেশীরভাগ মৃত্যু অকস্মাৎ হয়। পরিবারের কাছে আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।  

আপনাদের কাছেও ক্ষমা চাই। একজন মুসলিম হিসেবে এটা আমাদের করণীয়। ক্ষমা চাই আল্লাহর  কাছে। সব সমাধান তার কাছে। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমিও দোয়া করি সকলের জন্য, বিশ্ববাসীর জন্য। আমার যে শত্রু, সেও ভালো থাক, তাদের যেন হেদায়েত হয়।

এবার না হয় নতুন বছরে আমরা নতুন করে মানুষ হতে চেষ্টা করবো। ভালো থাকা হোক, শুধুই ভালোবাসা হোক, বছর শুরু হোক সত্যের হাত ধরে… Happy new year !

*আঁখি আলমগীরের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
জেআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।