ঢাকা: গৌহাটিতে এখন চলছে কিংবদন্তী মাটি-মানুষের গায়ক ভূপেন হাজারিকার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তোড়জোর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ও সুরকার ভূপেন হাজারিকা ৮৬ বছর বয়সে শনিবার বিকেল চারটা ৩৭ মিনিটে মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধিরুভাই আম্বানি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর অতি আপনজনেরা সোমবার মুম্বাই থেকে দেহ গৌহাটি নিয়ে আসেন। যাযাবরের দেহ বহনকারী উড়োজাহাজ ক্ষনিকের জন্য কলকাতা বন্দরে বিরতি দেয়।
সোমবার দুপুরে উড়োজাহাজ গৌহাটির গোপীনাথ বরদলৈ বিমানবন্দরে পৌঁছায়। বিমানবন্দর থেকে শিল্পীর ৩০ কিলোমিটার বাড়ি অবধি পথে পথে সর্বস্তরের মানুষ তার মরদেহের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানায়।
জনতার উচ্ছ্বাস আর আবেগ এতোটাই ছিল যে এই ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। জনতার ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে যাযাবারের নশ্বর দেহ পৌঁছাল নিজরাপারের বাড়িতে।
গৌহাটির জালুকবাড়ি পার্কে মঙ্গলবারই শিল্পীপুত্র তেজ হাজারিকা মুখাগ্নি করবেন। কানাডা প্রবাসী তেজ নিউইয়র্ক হয়ে এদিনই গৌহাটি পৌঁছেছেন।
শেষকৃত্যের জন্য শেষ পর্যন্ত গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের এই জালুকবাড়ি পার্কটি বেছে নেওয়া হয়েছে। কেননা এটা হাজারিকা পরিবারের ভাবাবেগ।
সোমবার গৌহাটি বিমানবন্দরে ভূপেন হাজারিকার মরদেহে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আসামের রাজ্যপাল জানতিবল্লভ পট্টনায়ক ও এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ।
বিমানবন্দরের চৌহদ্দির বাইরে তখন তখন অসংখ্য মানুষের কণ্ঠে দুটি উচ্চারন ‘ভূপেনদা আমার মাজত হদাই অমর থাকিব’ ( ভূপেনদা আমাদের মাঝে অমর হয়েই থাকবেন), ‘ভূপেনদার বিনা অসমর নকশা না হয়’ (ভূপেনদা ছাড়া আসামের মানচিত্র রচিত হয় না)।
মঙ্গলবার আসামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি দপ্তর ছুটি ছিল। বন্ধ ছিল রাজ্যের দোকানপাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। আসাম সরকারের তরফে জানানো হয়েছে রাজ্যে তিনদিনের শোক পালিত হবে। শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছে অরুণাচল রাজ্য সরকারও।
অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী গানের স্রষ্টা ও শিল্পী ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। এছাড়াও তিনি ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় গান গেয়েছেন। বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা গানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানটি দখল করে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি। আমজনতার কথা তুলে ধরায় তাঁর গানের মধ্যে জনগণ বারবার নিজেদের খুঁজে পেত। গত জুনে বুকের সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভূপেন হাজারিকাকে ভর্তি করা হয়েছিল ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে।
ভুবনজয়ী এই শিল্পীর দুটি কিডনিই বিকল হয়ে যাওয়ায় চার দিন ধরে ডায়ালিসিস চলার পর শনিবার বিকেলে মারা যান। ডায়ালিসিস চলার পর ভূপেন হাজারিকার দেহের বিভিন্ন অঙ্গ সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়। বিকেল সাড়ে চারটায় কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ভূপেন হাজারিকার জন্ম ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের আসাম রাজ্যে। কৈশোরকাল থেকেই গান লেখা, সুর দেওয়া এবং একই সঙ্গে গাইতে শুরু করেন তিনি। বাংলা, হিন্দি ও অসমিয়া ভাষায় তাঁর গান শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করে যায়।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা। সংগীতচর্চার পাশাপাশি ছিলেন কবি, চলচ্চিত্রনির্মাতা ও সাংবাদিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ বিষয়ে পিএইচডি করেন।
অভিনয় করেছেন এক পাল নামে একটিমাত্র চলচ্চিত্রে। এ ছবিতে তাঁর অভিনয় অনেক চলচ্চিত্রবোদ্ধার হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
তিনি ১৪টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। অসমিয়া ভাষায় শকুন্তলা (১৯৬০), প্রতিধ্বনি (১৯৬৪) ও লটিঘটি (১৯৬৭)। চলচ্চিত্রে তিনি একই সঙ্গে প্রযোজক, পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৭৫ সালে চামেলী মেমসাহেব চলচ্চিত্রে সুরকার ও শিল্পী হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। সংগীত ও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’, ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার, ২০০১ সালে লাভ করেন ভারতের রাষ্ট্রীয় উপাধি ‘পদ্মভূষণ’ ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১১, নভেম্বর ০৮, ২০১১