ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া উচিত: আবদুল মান্নান রানা

আল রাহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, চট্টগ্রাম থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১১
বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া উচিত: আবদুল মান্নান রানা

‘যেখানেই যাও ভালো থেকো’ গানটি খ্যাত চট্টগ্রামের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী  আবদুল মান্নান রানা। সম্প্রতি বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেছেন, সরকার সুদৃষ্টি না দিতে পারলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্র (সিটিভি) বন্ধ করে দেওয়া উচিত।



বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আবদুল মান্নান রানা সাম্প্রতিক সংগীতচর্চা, সাফল্য, প্রতিবন্ধকতা এবং ব্যক্তিগত নানা বিষয়ে কথা বলেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্র (সিটিভি) প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পার হলে অনুষ্ঠানের মানের বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি উল্লেখ করে আবদুল মান্নান রানা বলেন, সরকার যদি সুদৃষ্টি না দিতে পারে তাহলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্র (সিটিভি) বন্ধ করে দেওয়া উচিত। একদিকে সিটিভির অনুষ্ঠানের মান ভালো নয়, অন্যদিকে সিটিভি দেখার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ মিলছে না নগরবাসীর। নগরে ক্যাবল টিভির সংযোগ নিলে সিটিভি দেখতে পান না অনেক দর্শক। এ ছাড়া কাট্টলী পতেঙ্গার পর তো সিটিভি দেখাই যায় না। এ সমস্যার সমাধান কে করবেন?’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রথম দিকে সিটিভির ১ ঘণ্টার অনুষ্ঠান জাতীয়ভাবে সারা দেশে সম্প্রচার করা হতো। এখন তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একাধিক সরকার এসেছে আর গেছে। সিটিভির ব্যাপারে সবাই শুধু আশ্বাসের বাণীই শুনিয়েছেন। সরকার যে টাকা সিটিভির একেক জন কর্মীর পেছনে ব্যয় করে, তার চেয়ে বেশি টাকা অবৈধ পথে আয় করছেন এই প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এখন সিটিভিকে ঘিরে অনেক দালালের উদ্ভব হয়েছে। ’

আবদুল মান্নান রানার কাছে প্রশ্ন করা হয়, গানের জগতে তো গুরু বা ওস্তাদ ব্যাপারটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আপনার গুরু কারা? মনে পড়ে তাঁদের কথা?  উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের সময়ে গান শেখা কঠিন ব্যাপার ছিল। পাড়ায় পাড়ায় সংগীত শেখার প্রতিষ্ঠান, ওস্তাদ ছিল না। আমার প্রথম ওস্তাদ চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী ও সংগীত পরিচালক মোহাম্মদ সেকান্দার। এরপর ওস্তাদ মিহির লালার কাছে গান শিখেছি। তবে হ্যাঁ খুব অল্প সময়ের জন্য গান শেখার সুযোগ হয়েছিল ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়–য়ার কাছে। এ ছাড়া ঢাকার সেতার বাদক আবিদ হোসেন খান এবং বয়সে আমার ছোট হলেও সুরবন্ধু অশোক চৌধুরীর কাছে গানের অনেক কিছু শিখেছি। আমি সব সময় তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।

দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান একটি মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন উল্লেখ করে আবদুল মান্নান রানা বলেন, চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংগীত শিক্ষার সুযোগ নেই। একটি অনুষ্ঠানে বিষয়টি জানালে পিএইচপি গ্রুপের অর্থায়নে আমাকে মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে বলেন সুফি মিজানুর রহমান। পরে আমি প্রশাসনের অনুমতি নিতে গিয়ে দেখলাম কলেজটি করতে হলে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাও রাখতে হবে। আমি চেয়েছিলাম শান্তি নিকেতনের মতো কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে। সাধারণ শিক্ষার জন্য আমি কেন কলেজ তৈরি করব! পরে পুরো পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো।

আপনার তো প্রায় ৮টি অ্যালবাম বেরিয়েছে। অবসরে কার কার গান শোনেন? এ প্রশ্নের উত্তরে রানা বলেন, আমার ৩ নম্বর অ্যালবাম ‘যেখানে যাও ভালো থেকো’, এটিএন মিউজিক থেকে প্রকাশিত ‘ডায়রী’, লেজার ভিশনের ‘দেশের জন্য’ ও ‘তুমি প্রেম দিয়ে পোড়ালে’সহ নিজের গানগুলো বারবার শুনি। পাশাপাশি ভারতের মান্না দে, মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, জগজিৎ সিং, সনু নিগম প্রমুখ এবং বাংলাদেশের মাহমুদুন্নবীর কণ্ঠমাধুর্য আমার ভালো লাগে। আমাকে খুব টানে।

আগামী বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫৪ বছরে পা দিচ্ছেন আবদুল মান্নান রানা। দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে তিনি গেয়েছেন অনেকের সঙ্গে। সে তালিকায় কারা আছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, রুনা লায়লার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলাম ‘চাঁদনী’ ছবিতে। ‘কত দিন পরে দেখা হলো দুজনাতে’ গানটি বেশ হিট হয়েছিল। এ ছাড়া সাবিনা ইয়াসমিন, আবদুল জব্বার, আনজুমান আরা, ফেরদৌসী রহমান, বশীর আহমদ, সৈয়দ আবদুল হাদী এবং সমসাময়িক এন্ড্রু কিশোরসহ অনেকের সঙ্গে গেয়েছি।
 
চট্টগ্রামে সংস্কৃতিচর্চার উপযোগী আধুনিক মিলনায়তনের সংকট দীর্ঘদিনের। এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান রানা বলেন, ‘প্রথমেই আমি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম বা টিআইসি’ নামে ২০০-২৫০ আসনের একটি আধুনিক মিলনায়তন তৈরি করেছিলেন। যেখানে সাউন্ডসিস্টেম, লাইট, গাড়িপার্কিং, শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সত্যিকার অর্থে শুধু সংগীতানুষ্ঠান বা সংস্কৃতিচর্চার জন্য নয় সার্বিকভাবে চট্টগ্রামে একটি ১ হাজার আসনের আধুনিক মিলনায়তন দরকার।

গানের প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল চলচ্চিত্রশিল্পের। কিন্তু এখন তো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে দুর্দিন-দুরবস্থা। এ ছাড়া অশ্লীল, নকল গানের ছড়াছড়ি। আবার কবে সুদিন আসবে? এ প্রসঙ্গে কিছুটা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে আবদুল মান্নান রানা বলেন, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের গৌরব পুনরুদ্ধার করা কঠিন। একে একে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। টেকনিক্যালি যদি প্রতিবেশী দেশ ভারতের মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ডে আমরা পৌঁছাতে না পারি তাহলে এ শিল্প টিকবে কীভাবে। সিনেমার গান এখন যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে যে ভালো গান হচ্ছে না তা নয়। এটাও ঠিক সপ্তম শ্রেণী পাস না করেও অনেকে রাতারাতি গীতিকার বনে যাচ্ছেন, সা-রে-গা-মা না শিখে হয়ে যাচ্ছেন তারকা শিল্পী। ’

তিনি ্টিভি চ্যানেল উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব দেন, ‘গানের সত্যিকারের পৃষ্ঠপোষকতার উদ্দেশ্যে দেশে সংগীতের একটি আলাদা চ্যানেল হতে পারে। ’

নানা ধরনের প্রতিযোগিতা, খুদেবার্তায় (এসএমএস) মেধা বিচারসহ নানা ভাবে সংগীতকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে বলে অভিমত সচেতনমহলের। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? উত্তরে আবদুল মান্নান রানা বলেন, সত্যি কথা হলো আমাদের সবকিছুতেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। সংগীতকে আলাদা করে দেখার দরকার নেই। তারপরও বলি এই যে, নানা ব্রান্ডের নামে রাতারাতি এত এত তারকা জন্ম দিচ্ছে, কই দীর্ঘমেয়াদে টিকছে ক’জন। বেশিরভাগই তো হারিয়ে যাচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ভাবে ব্যবসায়িক মনেবৃত্তি বাদ দিয়ে একটি শক্তিশালী বিচারক-প্যানেল করে সুস্থ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যায়।

আবদুল মান্নান রানা শিল্পী হিসেবে বেশ সুনাম কুড়ালেও ব্যবসার ভুবনেও তিনি বনেদি। রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা আজিজ গার্মেন্টস লিমিটেড, এশিয়া স্পেয়ার অ্যান্ড এক্সেসরিস ও নিপুন রেকর্ডিং স্টুডিওর কর্ণধার তিনি। পাশাপাশি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, চিটাগাং ক্লাব, বিজিএমইএ, মা ও শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন আবদুল মান্নান রানা।

রানার কাছে বাংলানিউজের প্রশ্ন ছিল, চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ জাতীয় মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এ জনপদ কিংবা গণমাধ্যমে চট্টগ্রামের শিল্পীরা অবহেলিত। আবদুল মান্নান রানা বলেন, শুধু সংগীত নয় পুরো চট্টগ্রামই অবহেলিত। পাকিস্তান আমলে একটি ছবি দেখেছিলামÑএকটি গাভির মুখ পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু দুধের ওলানটি পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রতীকী ওই ছবিটি এখন চট্টগ্রাম ও ঢাকার জন্য প্রযোজ্য। বিটিভিতে আমার ঈদের অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের তারিখ ছিল ২ নভেম্বর। কিন্তু টিকিট না পাওয়ায় যেতে পারিনি। এই হলো চট্টগ্রামে থাকার বিড়ম্বনা। ’

বেতার টেলিভিশনের শিল্পীদের সম্মানীর ১০ শতাংশ কেটে রাখার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল মান্নান রানা বলেন, ‘এটা আসলে ফকিরের ঝোলা কেড়ে নেওয়ার মতো ব্যাপার। সরকারের জন্য এ ব্যাপারটা লজ্জাজনক! একজন শিল্পী বেতার থেকে একটি অনুষ্ঠানের জন্য ২০০-৪০০ টাকা সম্মানী পান। এর মধ্যে আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়া, চা-নাশতা এসব বাদ দিলে আর কত থাকে?’

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বেতার ও ১৯৭৫ সালে টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত শিল্পী আবদুল মান্নান রানা এফএম রেডিওর চেয়ে বেতার পিছিয়ে আছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠানমালায় কোনো বৈচিত্র্য নেই। অথচ এফএম রেডিওগুলো শ্রোতাদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বেতার এ প্রতিযোগিতায় অনেক অনেক পিছিয়ে পড়েছে। কারণ যুগোপযোগী পরিকল্পনা-প্রস্তুতি নেই, কর্মীদের আন্তরিকতা নেই, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুযোগ নেই।

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, বেতারে গান করতে গেলে দেখবেন গিটারের ৫টি তারের তিনটি নেই কিংবা ছিঁড়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলে জবাব পাবেন ‘স্যার অফিস মেরামত করে দিচ্ছে না। ’

দীর্ঘদিন কাজ করেছেন গান নিয়ে। এমন কোনো বিষয় আছে যা আপনাকে পীড়া দেয়? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে
একটু যেন আনমনা হলেন আবদুল মান্নান রানা। হাসিখুশি চেহারার মানুষটাকে গ্রাস করল বিষণ্নতা। বিষন্ন কণ্ঠেই বললেন, আসলে বাংলাদেশের শিল্পীরা ভালো নেই। সাবিনা ইয়াসমিন, সুবীর নন্দীর মতো খ্যাতিমান শিল্পীদের চিকিৎসার জন্য ডোনেশন নিতে হয়। নামে মাত্র শিল্পী সম্মানী, গানের রয়েলিটি পেতে জটিলতা, শিল্পীসত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি সত্যিই চিন্তিত।

বাংলাদেশ সময় ১৪৩৫, নভেম্বর ০৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।