ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

তারার ফুল

তুমি রবে নীরবে....

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৭
তুমি রবে নীরবে.... নায়ক সিনেমায় উত্তম।

কলকাতা: লস এঞ্জেলসে গিয়ে এক সভায় দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন উত্তমকুমার। নিজের অভিনয় নিয়ে নানাদিক বিশ্লেষণ করেছিলেন সেখানে। সেই বক্তব্যে উঠে এসেছিলো সত্যজিত রায়ের নাম।

তপন সিনহার সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল রাজেন তরফদারের, সঙ্গে ছিলাম আমি (উত্তম কুমার)। তাঁরা বলেছিলেন দর্শকরা নেবে না।

আমাদের কিছু গোলমাল আছে। হয় ডায়ালগে গোলমাল, না হয় চিত্রনাট্যে গোলমাল আছে। আমাদের অভিনয়ে তো গোলমাল প্রচুর আছে। আমাদের কোনও গাইডেন্স আছে? নেই।   আমাদের কোনও কিছুই নেই।

উত্তমকুমার এই বক্তব্যের শেষের দিকে বলছিলেন,বাংলার স্টুডিয়ো, ক্যামেরা, অন্যান্য উপকরণ হতদরিদ্র ও সেকেলের।   ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়।   তা যাই হোক, আমরা এই দুর্দশার মধ্যে বেঁচে আছি এবং থাকবো। ছবিটি হচ্ছে। মানিকবাবু ছবিটবি করছেন।   আমাটলিউডে উত্তমের ভাস্কর্য।  দের খুব গর্বের লোক তিনি।   শুধু বাংলাদেশকে নয়, আমি পূর্ববাংলা আর পশ্চিমবাংলা তফাৎ করে দেখি না, দুই বাংলা এক, আজকে সারা ভারতবর্ষের ছবির মান উন্নতির মূল তিনি। ‘  

উত্তমকুমারের অনেক লেখায় বারে বারেই এসেছে সত্যজিত রায়ের প্রসঙ্গ।
 
আমার অভিনয়ের ‘মুক্তি’ নামে একটি লেখার শুরু হচ্ছে। ফিল্মে অভিনয় করার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করেছি অতৃপ্তি। একই ধরনের ভূমিকায় পাঁচ-পাঁচটা ছবিতে নাম বদলে পাঁচবার অভিনয় করতে হয়েছে। আমার অভিনয়ে মধ্য দিয়ে তখন আমি মনে প্রাণে মুক্তি খুঁজে বেড়াচ্ছি । আর ভালো লাগছে না একই ভূমিকায় বারবার অভিনয় করতে।
 
এমন সময় সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে অভিনয় করবার ডাক পড়ল আমার।   আমি আমাকে এক নতুন ভূমিকায় খুঁজে পেলাম। আমার মুক্তি হলো নায়ক সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে।  

‘নায়ক ’-এর পরিচালক সম্বন্ধে বলছেন, ‘সত্যজিতৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার আগেও মানুষটিকে দেখেছি। তাঁর অনন্য শিল্পসৃষ্টিও প্রত্যক্ষ করেছি কয়েকবার। ছবিতে কাজ করতে এসে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হল আমার। কোনও আত্মম্ভরিতা নেই, বিন্দুমাত্র দাম্ভিক নন, এমন একজন সহজ সরল এবং গুণী মানুষের ছবিতে কাজ করার মধ্যে একটা অন্য আনন্দ আছে।   যা আমার এতোদিনকার অভিনয় জীবনে খুব কমই অনুভব করেছি। সেই অনুভূতির নীরব প্রতিফলন আজো আমার অন্তর জুড়ে।
 
উত্তম বলছেন, সত্যজিত রায়ের অসামান্য বাস্তবধর্মী সংলাপ রচনার কথা।   যা তাঁর ‘কখনই মনে হয় না সাজানো কথাবার্তা। এই জন্যেই তাঁর বক্তব্য, ছবির পরিবেশে আত্মস্থ হলেই সম্ভবত অভিনয়ে আর কোনও জটিলতা থাকে না সত্যজিত রায়ের ছবিতে।
 
লস এঞ্জেলসে দেওয়া ভাষণের এক জায়গায় ‘নায়ক’ ছবির শুটিং এর মুহূর্তের একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন উত্তমকুমার। সত্যজিত রায় তাঁকে বললেন, ‘ওহে উত্তমকুমার। প্রথম সিনটা একটু ছবিবিক (ছবি বিশ্বাস) ঢঙে অভিনয় করতে হবে। এ ব্যাপারে উত্তমের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘ছবিবিক ঢঙে আমি কি অভিনয় করব? ছবিদা ছবিদার মতো অভিনয় করতেন, আমি আমার মতো করব। ’ এর পর সত্যজিত রায় আর কিছু সে ভাবে বলেননি। মর্যাদা দিয়েছিলেন আমার আত্মবিশ্বাসের প্রতি।
 
উত্তমকুমার এক অসামান্য উচ্চতায় তাঁর অভিনয়কে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘নায়ক ’-এ। যা বলাই বাহুল্য। এ তো হবারই কথা। কতখানি তিনি ভেবেছিলেন ছবির ‘অরিন্দম’ চরিত্র নিয়ে, তার নিদর্শন তো রয়েছে, ‘আমার অভিনয়ের মুক্তি’ নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, অরিন্দম আর উত্তমকুমার সম্পর্কে দুস্তর ব্যবধান কখনই থাকত না। অরিন্দমের মানসিকতার সঙ্গে নিজেকে ভাবতে গিয়ে বিসদৃশ মনে হয়নি। মনে হয়নি আমরা ভিন্ন ভিন্ন। মনে হয়েছে অরিন্দমের সুখ আমার সুখ, অরিন্দমের দুঃখ আমার দুঃখ। শুটিংয়ের পরেও অরিন্দমের সুখ, দুঃখ, জটিলতা সব কিছুই থেকে যেত নিজস্বতায়। এতদিনকার অভিনয়জীবনে আজও সেই সব বৃত্তান্ত অভিজ্ঞতা হয়ে রয়েছে। আর এই অভিজ্ঞতার ঝুলি বয়ে বেড়ানো একজন অভিনেতার কর্তব্য।
 
‘নায়ক ’(১৯৬৬ ) ও ‘চিড়িয়াখানা ’ (১৯৬৭ ) এই দুটি ছবিতেই কাজ করার সময় উত্তমকুমার সত্যজিত রায়কে, একজন সহজ ও স্বাভাবিক সত্তার মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘অভিনেতার সঙ্গে পরিচালকের যে গুড আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকার কথা, সেই সীমাবদ্ধতা মানিকবাবুর আছে। তিনি একজন অসাধারণ মানুষ। সত্যজিত রায় ছাড়া,  উত্তমকুমার বেশির ভাগ চিত্র-পরিচালকদের ক্ষেত্রে তাঁর স্টার ব্যক্তিত্বের প্রতি যেন একটা নতজানু ভাব আর কোনও আলোচনায় পাওয়া যায়নি। ।
 
সত্যজিত রায়ের ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? উত্তম বলেছিলেন, ‘প্রথমে চরিত্রটা ছবির মতো বুঝিয়ে দেন। তারপর মানিকবাবু নির্দেশ দেন। যেমন একজন পরিচালক একজন অভিনেতাকে যতটুকু নির্দেশ দিতে পারেন। আমি যদি আপনাদের চোখে ওই দুটো ছবিতে সফল অভিনয় করে থাকি তা হলে ধরে নিতে পারি আমার বোঝাবুঝি সার্থক হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে মানিকবাবুর কৃতিত্ব সর্বাধিক। নায়ক ছবিতে উত্তম
 
এক সাক্ষাত্কারের একটি কথায় উত্তমকুমারের হতাশা ঝরে পড়েছিলো,  ‘আজো আড়াই -তিনজন পরিচালক ছাড়া কারুর সঙ্গেই কাজ করে নতুন কিছু শেখার খোরাক পাইনি। এও সত্যি, উত্তমকুমার কখনও নিজেকে পরিচালকের কাছে সমর্পণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না।

দুই অসামান্য প্রতিভাবানের শিল্পক্ষমতার বিনিময় বলা যেতে পারে। দুজনেই দুজনের প্রতি সম্মান দিয়ে কাজ করেছেন। কেউ কারুর ভাবনা একে অপরের ওপর চাপাতে চাননি।
 
সত্যজিত রায়ের কাছেও উত্তমকুমার অভিনেতা হিসেবে অনন্য ছিলেন। উত্তম কুমারের প্রয়াণের পর টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োতে এক স্মরণসভায় সত্যজিত রায় তাঁর বক্তৃতার শেষে বলেছিলেন, ‘আজ এই সভাতে অনেক নায়ক উপস্থিত আছেন, তাঁদের অনেকেই ভালো অভিনয় করেন, অনেকের সাথে আমি কাজ করেছি, কাজ করে আনন্দও পেয়েছি, কিন্তু উত্তমের মতো কেউ নেই, উত্তমের মতো কেউ হবেও না। ’ মহানায়কের প্রয়াণের দু’বছর পর (১৯৮২ ) একটি বাংলা পত্রিকায় বক্তৃতাটির লিখিত রূপ প্রকাশিত হয়েছিল।
 
অভিনয়ের আভিজাত্য আর ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে মন জয় করেছেন আপামর মানুষের। বাংলা চলচ্চিত্রের এক এবং অদ্বিতীয় মহানায়ক হিসেবে তিনি আপামর বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তিনি হলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। ৩৭ বছর আগে ১৯৮০ সালের এই দিনে কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান ৫৩ বছর বয়সী এই অভিনেতা। রেখে যান অসাম্য অসংখ্য সৃষ্টিকর্ম।
 
তুমি রবে নীরবে ভক্তদের মাঝে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৭
ভিএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।