ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বিনোদন

এখন কেউ কাজের জন্য ডাকে না: প্রবীর মিত্র

কামরুজ্জামান মিলু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ছবি : নূর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৪
এখন কেউ কাজের জন্য ডাকে না: প্রবীর মিত্র ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর পাশে একটি লাল রং এর বাড়িতে থাকেন চলচ্চিত্রের প্রিয় মুখ প্রবীর মিত্র। প্রায় চার যুগ ধরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন তিনি।

স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকের মাধ্যমে অভিনয় শুরু করেন। কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের এক সময়কার তীর্থস্থান বিউটি বোর্ডিংয়ে একটা সময় নিয়মিত আড্ডা দিতেন প্রবীর মিত্র।

সেটা ষাটের দশকের কথা। তখনও গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়নি তার। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে থিয়েটারে যাওয়া-আসা চলছিল। ১৯৬৬ সালে প্রথম ডাক পান চলচ্চিত্রে অভিনয়ের। ছবির নাম ‘জলছবি’। এরপর অনেক ছবিতে তার মন মাতানো অভিনয় দিয়ে দর্শক হৃদয় জয় করেছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

বাংলানিউজের বিনোদন বিভাগ থেকে এক বিকেলে কথা বলার জন্য তার বাসায় হাজির হলাম। দরজায় নক করতেই ভরাট কণ্ঠে বললেন, ‘কে?’ পরিচয় পাওয়ার পর ড্রইং রুমে বসতে দিয়ে বললেন, আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বলুন কি জানতে চান ?
উত্তরে বললাম, অনেক কিছুই তো জানতে চাই। আপনার হাতে কি সময় আছে?
হেসে বললেন, এখন তো আমি  বেকার। হাতে তেমন কোন কাজ নেই। আমাদের এখন কেউ কাজের জন্য ডাকে না।

তাহলে কি করে এখন সময় কাটান?
এখন তো বই পড়ে, টিভি দেখে সময় কাটে। আর বিকেলের পর একটু কাকরাইল ফিল্ম পাড়ায় কয়েকজন পরিচিত পরিচালক বা প্রোডাকশন হাউজে গিয়ে সময় কাটাই। এই তো।

অভিনেতা হিসেবে তো প্রায় চার যুগ সময় পার করলেন? কিন্তু আপনার অভিনয়ের শুরুটা কোন বয়সে? সেসময়গুলোর কথা কি মনে আছে?
এইচ আকবর পরিচালিত আমার প্রথম ছবি 'জলছবি'। এর প্রধান চরিত্রে ছিলেন ফারুক। আর ছবির গল্প ও সংলাপ লিখেছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। 'জলছবি'তে অতিথি চরিত্র ছিল আমার। নির্ধারিত চিকিৎসক চরিত্রের শিল্পী না আসায় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন আকবর সাহেব। তবে সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় স্থানীয় এক থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’ডাকঘর’ নাটকে প্রথম মঞ্চে অভিনয় করি। অভিনয়ের জন্য বেশ প্রশংসাও পাই।
নাট্য নির্দেশক ননী দাসের অনুপ্রেরণায় নাটকের প্রতি বেশ ঝুঁকে পড়ি এবং সেসময় ননী দাসের পরিচালনায় বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করি। এরপর নাট্য পরিচালক এজাজ খানের নির্দেশনায় বেশ কয়েকটি টিভি নাটকে অভিনয় করা হয়।

আর চলচ্চিত্রে আসার পর বহু রকমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ? সেগুলো নিয়ে একটু জানতে চাই?
আমি চলচ্চিত্রে অনেক ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে এইচ আকবর আমাকে 'জীবন তৃষ্ণা' ছবিতে অন্ধের চরিত্রে অভিনয় করতে দিয়েছিলেন। এটিই ছিল এ ছবির প্রধান চরিত্র। সেসময় আমাকে সবাই কলকাতা থেকে আসা একজন গুণী অভিনেতা হিসেবে জানতেন। তবে এর আগেও আমি  এজাজ খান পরিচালিত 'ভাড়াটে বাড়ি' ছবিতে খল চরিত্রে অভিনয় করেছি।

আপনার অভিনীত প্রিয় ছবির তালিকায় কোন কোন ছবি রয়েছে?
আমার প্রিয় ছবির তালিকায় আছে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত 'সাজানো বাগান', আমজাদ হোসেনের ' জন্ম থেকে জ্বলছি, সুভাষ দত্তর 'আবদার' , দীলিপ বিশ্বাস এর ‘অপেক্ষা’, মইনুল হোসেনের ‘প্রেমিক’, মহিউদ্দিন এর ‘বড় ভালো লোক ছিল’, এইচ আকবর এর 'জীবন তৃষ্ণা', আবদুল জহির মিন্টু পরিচালিত ‘প্রতিহিংসা’। এছাড়াও 'অঙ্গার', 'পুত্রবধু', 'দাতা হাতেমতাঈ', 'সুখে থেকো', 'মান-অভিমান', 'রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা', ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’সহ আরো অনেক ছবি।

কোন ছবিটি আপনার ক্যারিয়ারের জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলে মনে করেন?
এইচ আকবর পরিচালিত ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিতে অভিনয় করার পর শেখ নজরুল পরিচালিত ‘চাবুক’ ও ঋত্বিক কুমার ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে নায়ক হয়ে অভিনয় করার সুযোগ পাই। তবে ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিটি ছিল আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এরপর চরিত্রহীন, তীর ভাঙ্গা ঢেউ, চাষীর মেয়ে, জয় পরাজয়, সেয়ানা ছবিতে একক নায়ক হিসেবে অভিনয় করি। এরমধ্যে সেয়ানা, জয় পরাজয়, চাষীর মেয়ে ছবিগুলো সেসময় বেশ ব্যবসা সফল হয়।

আপনার বাবা-মা সম্পর্কে জানতে চাই?
ঢাকার ফার্মগেটের খামার বাড়ি ছিল আমার দাদার বাগান বাড়ি। আমার বাবার নাম ছিল গোপেন্দ্র নারায়ন মিত্র। তিনি সেসময় জমিদারি দেখাশুনার পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্যও দেখতেন। আর মা অমিয় বালা ছিলেন রাজানগর বিক্রমপুরের ঘোষ পরিবারের মেয়ে। বাবা ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় ব্লক প্রসেসিং এর ব্যবসা শুরু করেন যার নাম ছিল রাইজিং আর্ট কটেজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাইজিং আর্ট কটেজ লুট হয়ে যায়। বাবা-মা আজ আর বেঁচে নেই।

আপনি তো ভালো ক্রিকেট খেলতেন ?
হ্যাঁ, আমার শিক্ষা জীবন শুরু হয় সেন্ট গেগরি মিশনারি হাই স্কুল থেকে। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার সময় এই স্কুল ছেড়ে পোগজ হাই স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলে ফুটবল এবং হকি খেলায় নিয়মিত অংশ নিতাম। ক্রিকেট খেলা শুরু করি কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায়। ন্যাশনাল স্পোর্টিং ক্লাবে প্রথম বিভাগের ক্রিকেট ক্যাপ্টেনও ছিলাম। আমার মনে আছে স্কুলের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে একবার বেস্ট স্পোর্টসম্যান হিসেবে প্রথম পুরুস্কার পেয়েছিলাম।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে কি পেয়েছেন ?
মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৮৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করার সুযোগ হয়। এরপরও অনেক ছবিতে ভালো অভিনয় করেছি আমি। তবে পুরস্কার জিনিসটা আমার কাছে মনে হয় একটু লবিং থাকতে হয়। এসব নিয়ে আসলে ভাবিনি। কাজ করে গেছি। তবে বাচসাস সহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে বহু পুরস্কার পেয়েছি।

অভিনয়ের জন্য কোন অভিনেতার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
একবাক্যে আনু ভাই (প্রয়াত আনোয়ার হোসেন)। আমার অনেক ছবির শুটিং এর সেটে তিনি এসে আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতেন। এমনকি একটি দৃশ্যে অভিনয় করার পর আমি এসে জানতে চাইতাম তার কাছে। বলতেন, ভালো হয়েছে তবে আরেকবার কর। আমার মনে আছে একবার একটি ছবিতে তার সাথে আমার অভিনয়ের দৃশ্যে আমি কাঁপছিলাম। তখন তিনি এসে আমাকে বললেন, কাঁপতেছিস কেন? নিজের সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে এটা ভাবিস না। অভিনয় নিয়ে চিন্তা কর। তিনি আসলে আমার অভিনয় গুরু। আমি তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।

বর্তমানে কি কি কাজ করছেন ?
এখন তো আমার বয়স হয়েছে। তেমন কাজেও মানুষ ডাকে না। তবে গত ঈদে 'দেহরক্ষী' ও ‘মাই ন্যাম ইজ খান’ ছবিটি মুক্তি পায়। এছাড়া সম্প্রতি ‘তোমার কাছে ঋণী’, 'নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ', ‘শতরূপে শতবার’ ও ‘অনেক সাধনার পর’ ছবির কাজ শেষ করলাম। এই ছবিগুলো সামনে মুক্তি পাবে। আরো নতুন কিছু ছবিতে অভিনয়ের কথা চলছে।

এক সময় তো আপনি প্রায়ই প্রতিদিনই কাজ করতেন, এখন এই সময়ে এসে সেই ব্যস্ততার দিনগুলো কি মনে পড়ে না ? আর কতদিন অভিনয় করে যেতে চান ?
আমার মনে আছে। আমি একসময় প্রায়ই ত্রিশ দিনই রাত-দিন কাজ করেছি। পরিবারে তেমন সময় দিতে পারিনি। আমার স্ত্রী ২০০০ সালে এবং আমার ছোট ছেলে ২০১২ সালে হঠাৎ করেই মারা যায়। এরপর আমি অনেক একা হয়ে পড়ি। এখন বুঝি আমার স্ত্রী এই সংসারটা কিভাবে সামলে রেখেছিলেন। আমার এক মেয়ে ও তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলেই এখন ব্যাংকে চাকরি করছে। আর অভিনয় করলেই সুস্থ থাকি। কাজ না থাকলেই একাকিত্ব আমাকে গ্রাস করে এবং আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।

অভিনয়জীবনে প্রাপ্তি নিয়ে কোন আফসোস আছে কী?
আমি অভিনয় করে দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছি। হয়তো আমি গাড়ি-বাড়ি করতে পারিনি। আর সবসময় সৎ ও সুন্দর উপায়ে জীবনযাপন করছি। কাউকে তোষামোদ করে চলতে হয় নি, এটা আমার কাছে বিশাল বড় একটা পাওয়া। তাই আফসোস নেই। ভালো আছি এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অভিনয় করে যেতে চাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, ১ মার্চ ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।