ঢাকা, বুধবার, ১৬ আশ্বিন ১৪৩২, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৭

বিনোদন

জীবনের গান আর গানের জীবন

সিয়াম আনোয়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:০৭, নভেম্বর ১০, ২০১৩
জীবনের গান আর গানের জীবন

তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছেন জীবন। ডানা ঝাপটানোর বয়স।

ক্লাস করেন, টিউশনি করেন আর গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্রিকেট খেলেন। চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের পাশের মাঠ কিংবা বাসার সামনের গলিতে বন্ধুদের নিয়ে যখন তখন নেমে পড়েন ব্যাট বল নিয়ে। মাথায় চিন্তা ক্রিকেটার হবেন।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল চট্টগ্রাম খেলতে গেলেই ঢু মারেন খেলোয়াড়দের হোটেলে। কথা বলার চেষ্টা করেন। অটোগ্রাফ নেন। দেশি ক্রিকেটার বিদেশি ক্রিকেটার। একবার অটোগ্রাফ নিচ্ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের রামনরেশ সারওয়ানের। আরো অনেকের ধাক্কাধাক্কির কারণে বিরক্ত ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান। চোখ কড়মড় করে তাকালেন জীবনের দিকে। তবু নিরস্ত হন না জীবন। অটোগ্রাফ নিয়েই ছাড়েন। এভাবে প্রায় অর্ধশতাধিক আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন জীবন।

ক্রিকেট নিয়ে বসবাস করা সেই সময়ে জমা হয় ক্রিকেট পাগলামীর অসংখ্য গল্প। সেই গল্পগুলোই একসময় কীভাবে যেন বাঁক বদলে নিলো। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন মোড় নিল গান লেখায়।

সেই থেকে পেরিয়ে গেছে এক দশক। ‘ক্রিকেট পাগল’ জীবন এ সময়ে হয়ে উঠেছেন মানুষের কাছে পরিচিত নাম রবিউল ইসলাম জীবন। নামের পাশে যোগ হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় তরুণ গীতিকারের স্বীকৃতি। ‘গর্জে উঠো বাংলাদেশ’ ‘লজ্জা’ ‘একমুঠো স্বপ্ন’ সহ জন্ম দিয়েছেন গত কয়েকবছরের একাধিক হিট গান। গান লেখার স্বীকৃতি স্বরুপ পরপর দুইবার পেয়েছেন সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড।
jibon-12
গীতিকার রবিউল ইসলাম জীবনের কৃতিত্বে সন্তুষ্টি আছে শ্রোতা এবং সঙ্গীত সংশ্লিষ্টদের। তবুও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়- ‘জীবন কেন ক্রিকেটার না হয়ে গীতিকার হলেন? গান লেখায় না এলে কী-ই বা হতো?

জীবনের জবাব, “হয়তো কিছুই হতো না, হয়তো অনেক কিছুই হতো। আমি তো কলেজ জীবনের আগে কখনো গান লেখার কথা চিন্তাও করিনি। কীভাবে কেমন করে যেন ভাগ্য এদিকে টেনে এনেছে। তবে ক্রিকেটার না হয়ে আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, সেটা নিয়ে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সন্তুষ্ট। ”

মুখে তৃপ্তি ঝরলেও রবিউল ইসলাম জীবনের এই সন্তুষ্টির আড়ালে পড়ে গেছে বহু অপূর্ণতার গল্প। শৈশবে বাবাকে না পাওয়ার অপূর্ণতা, চাহিদা মতো প্রয়োজনীয় জিনিসটি না পাওয়ার অপূর্ণতা, ক্লাসের সেরা ছেলেটি না হওয়ার অপূর্ণতা, শৈশব-কৈশোরের লালিত স্বপ্ন ক্রিকেটার না হওয়ার অপূর্ণতা কিংবা গান নিয়ে ছোট ছোট অপূর্ণতা...। এমন অপূর্ণতা আর না পাওয়ার গল্প আছে হাজারো। মুখ ফুটে কখনো রোমন্থন করা হয় না এইসব অপূর্ণতা আর না পাওয়ার গোপন শ্বাস।

করবেনই বা কি করে! জীবনের কাছে মন খারাপের যে কোন প্রসঙ্গ মানেই ‘সাইডলাইন’-র জিনিস। সব সময় ছোটাছুটি আর হাসি আনন্দের মধ্যেই তার দিনযাপন।

“আমি চাই আমাকে দেখে যেন আরেকজন ভালো থাকে। দুঃখ জিনিসটা সংক্রামক। খুশি করতে যদি নাও পারি, আমার কারণে কারো মনে যেন দুঃখ না আসে। জীবন নিয়ে খুশি থাকব, এটাই কথা। ”

খুশি থাকার চেষ্টাতেই জীবনের চালচলন, কথাবার্তা চটপটে-চনমনে। সবসময় হাসি লেগে থাকে মুখে। যে হাসিমুখ জীবনকে করে তুলেছে পরিচিতজনদের প্রিয়মুখ-এ।

কয়েকদিন আগের ঘটনা। কোন একটা কারণে প্রচন্ড মন খারাপ জীবনের। এসময় পরিচিত একজনের ফোন। এ কথা ও কথার ফাঁকে মানুষটি বললেন, “ভাই, মন খারাপ হলে ফেসবুকে আপনার টাইমলাইনে যাই। আপনার হাসিমাখা মুখ দেখলে মন অনেক হালকা হয়ে যায়। ”

শুনে মন ভালো হয়ে যায় জীবনেরও। নিজের ‘জীবন’ নামটাকে স্বার্থক বলে মনে হয়।
এই নামটি রেখেছিলেন জীবনের বাবা। জন্মের আগেই নাম চূড়ান্ত করেছিলেন। ছেলে হলে নাম রাখা হবে জীবন। যেদিন পৃথিবীর বুকে ছেলেটির জন্ম হলো সেদিন রবিউল আউয়াল মাসের রবিবার। ব্যস, আর ভাবাভাবির দরকার পড়েনি। নাম হয়ে গেল রবিউল ইসলাম জীবন।
jibon-22
খুব সহজে নাম হয়ে গেলেও কঠিন ছিল বড় হওয়া পর্ব। চার বছর বয়সে মারা যান জীবনের বাবা। দুই ভাই এক বোন। জীবন ঘরের বড় ছেলে । দেখলেন তিন সন্তান নিয়ে মায়ের সংগ্রামী সেই সব দিন। তখন মা শুধু মা না, বাবাও। সংসার যেমনই চলুক, পড়ালেখা চালিয়ে নিয়েছেন সন্তানদের। এসএসসি পাশের পর নোয়াখালীর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে জীবন পাড়ি জমালেন চট্টগ্রামে।

সেখানে পড়তেন, পড়াতেন আর খেলতেন। এসবের মাঝেও মনে হত কেমন যেন শূন্যতা। গ্রামের বাড়ি নেই, ভাই বোন নেই। মা নেই। বাবা তো চিরতরেই নেই। সবকিছুর মাঝেও নিঃসঙ্গ। একাকি মুহুর্তই করে তুলল ভাবুক, সদ্য কৈশোর পেরোনো বয়স বানিয়ে দিল দুরন্ত। এমনই এক ক্ষণে মনের মাঝে ছন্দবদ্ধ ভাবনার উঁকিঝুকি। কলমের কালিতে খাতার গায়ে যে ভাবনা হয়ে উঠল গান।

“জীবনে এরকম সময় কাটিয়ে এসেছি বলেই মনে হয় এককেন্দ্রিক গান আমার থেকে আসে না। কষ্টে ছিলাম, আবার খেলা নিয়ে আনন্দও তো কম করিনি । ”

রবিউল ইসলাম জীবন গান লিখেছেন বিভিন্ন ধারার। অডিও’র জন্য এ পর্যন্ত প্রায় তিন শ’ গান লিখেছেন। এছাড়া লিখেছেন চলচ্চিত্রের গান, জিঙ্গেল, থিম সংও । এক পা দু পা কিংবা চোখেরই পলকে’র মত রোমান্টিক গানের পাশাপাশি লিখেছেন ক্রিকেট নিয়ে ‘জ্বলে উঠো বাংলাদেশ’, পপ গুরু আযম খানকে নিয়ে ‘গুরু তোমায় সালাম’ এবং সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’-র মত গানও। বিষয়ভিত্তিক গানও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। এরমধ্যে আছে একুশে বইমেলা, গার্মেন্ট শ্রমিক, নারী, সাভার ঘটনার শাহীনাকে নিয়ে লেখা গান।

এসবেরও আগে জীবনের লেখা গান সর্বপ্রথম গেয়েছেন কণ্ঠশিল্পী আসিফ। ২০০৬ সালে প্রথম গান রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি বেশ উজ্জ্বল হয়ে আছে জীবনের স্মৃতিতে। “আমি সেদিন ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। জ্বরে আক্রান্ত শুয়ে আছি বিছানায়। সন্ধ্যার দিকে রাজেশ দা ফোন দিয়ে বললেন আমার ‘ভালোবাসি বলে’ গানটা আসিফ ভাইয়ের কণ্ঠে রেকর্ডিং হয়েছে। শুনে সাথে সাথে আমি খুশিতে একটা লাফ দিলাম। তখনই মনে হল জীবনে আর কিছুর দরকার নাই। সব পেয়ে গেছি। ”
jibon-3
আসিফের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অ্যালবামে ছিল জীবনের লেখা প্রথম গান। একই অ্যালবামে আরেকটি গান ছিল ‘ভাড়াটিয়া চাই’ শিরোনামে।   প্রথম গান রেকর্ডিংয়ের পরপরই ‘সব পেয়ে গেছি’ বললেও জীবনের মায়ের মতে এই ২০১৩তে এসেও অপূর্ণতা রয়ে গেছে। বিয়ে করাবেন ছেলেকে। মায়ের চাওয়াটা পূরণ করতে রবিউল ইসলাম জীবনের ভরসা এখন নিজের লেখা গান। ২০০৬ সালে লেখা প্রথম অ্যালবামের ‘ভাড়াটিয়া চাই’ আজ সাত বছর পর আবারও গাইতে হচ্ছে- “আমার বুকের ভেতর দুঃখ জমে হয়েছে এক বাড়ি, সেই বাড়িটা মালিকানা হয় না ছাড়াছাড়ি। দুঃখগুলো যখন তখন করছে আমায়তাড়া, সেই বাড়িটার অংশ কিছু দেব আমি ভাড়া। একজন ভাড়াটিয়া চাই। একজন ভাড়াটিয়া চাই। ”

এক নজরে রবিউল ইসলাম জীবন
মূলত গীতিকার
পেশা: সাংবাদিকতা, সহ সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ।
জন্ম: বেগম গঞ্জ, নোয়াখালী
পড়াশোনা: মাস্টার্স, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ
গান লিখেছেন: প্রায় তিন শ
জনপ্রিয় দশ গান : জ্বলে উঠো বাংলাদেশ(দূরবীন ব্যান্ড), একমুঠো স্বপ্ন (বেলাল খান মোহনা), চোখেরই পলকে (শুভমিতা-রিজভী ওয়াহিদ), লজ্জা (পড়শি), মানে না মন (ইমরান পূজা), গোলমাল (টেলিভিশন মুভি), ভাড়াটিয়া চাই (আসিফ), এক পা দুপা করে
(তৌসিফ-মুন্নী), কোথায় যাবি (জুয়েল-কনা), আজ বৃষ্টির দিন (অপু)

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪২ ঘণ্টা, ১০ নভেম্বর, ২০১৩
এসএ/জিআর/আরকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।