ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

নায়করাজ রাজ্জাকের একান্ত আলাপচারিতা

অতি-বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণেই হারিয়ে গেছে রুচিশীল দর্শক

বিপুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১০
অতি-বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণেই হারিয়ে গেছে রুচিশীল দর্শক

শুধু নায়ক নন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি নায়করাজ। চলচ্চিত্রের সোনালি যুগে তিনি একাই এ দেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বহুদূর।

চার শতাধিক ছবির নায়ক নায়করাজ রাজ্জাক। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও বার্ধক্যকে আঙুল দেখিয়ে এখনো তিনি অভিনয় করছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ক্রান্তিকালে নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হলো বাংলানিউজের।

বাড়ির নাম লক্ষীকুঞ্জ। অভিজাত গুলশানের এই আলিশান বাড়িটিতে নায়করাজ রাজ্জাক বাস করছেন প্রায় তিন যুগ। স্ত্রী রাজলক্ষীর নামেই বাড়ি। রাজ্জাক বিশ্বাস করেন, তার জীবনের সব সৌভাগ্যের মূলে আছেন তার স্ত্রী লক্ষী। এই লক্ষীকুঞ্জেই নায়করাজের মুখোমুখি হয় বাংলানিউজ।

শুরুতেই রাজ্জাক তার ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করলেন। জানালেন, ছোটবেলায় খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। পজিশন ছিল স্ট্রাইকারের। গোল দিলে পেতেন হাততালি। একবার পাড়ার একটা নাটকে অভিনয় করলেন। তার অভিনয় দেখে লোকজন খুব হাততালি দিল। রাজ্জাক তো অবাক, আরে অভিনয় করেও তাহলে হাততালি পাওয়া যায়! সেই থেকে অভিনয়ের পোকা তার মাথায় ঢুকে গেল। স্কুলজীবনেই কলকাতার শৌখিন মঞ্চনাটকে জড়িয়ে পড়লেন।

কলেজে পড়ার সময় নাটকের দলের একজনের সহায়তায় কলকাতার ছবি ‘রতন লাল বাঙ্গালী’তে ছোট্ট একটা চরিত্রে অভিনয় করেন। একটা-দুটো সংলাপ নিয়ে ‘পঙ্কতিলক’ ও ‘শিলালিপি’ নামে কলকাতার আরো দুটো ছবিতে অভিনয় করেন। এ সময় ফিল্মের পোকাটা তার মাথায় এমনভাবে ঢুকে যায় যে, ঠিক করেন ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করবেন। বোম্বে গিয়ে ভর্তি হলেন ‘ফিল্মালয়’-এ। কিন্তু ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারলেন না। ছুটিতে কলকাতায় এসে পড়ে গেলেন মহাবিপদে। লেগে গেল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেটা ১৯৬৪ সালের কথা। যে মহল্লায় তিনি থাকতেন, সেখানে দাবানলের মতো দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল। জীবন বাঁচাতে রাতের আধাঁরে পরিবারের সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এ দেশে চলে এলেন। পুরান ঢাকার এক আত্মীয়র বাসায় আশ্রয় নিলেন।  

ঢাকায় আসার পরের সেই কঠিন দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, ঢাকায় আসার পর কয়েক দিন ঘোরাঘুরি করেছি এফডিসির আশপাশে। ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। পুরান ঢাকার যে আত্মীয়র বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই বাড়ির কাছাকাছিই থাকতেন ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খান। আত্মীয়ের কাছে শুনলাম, উনি ফিল্মে আছেন। একদিন রাস্তায় সালাম দিয়ে বললাম, আমি ফিল্মে কাজ করতে চাই। কলকাতার ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি আমাকে এফডিসিতে দেখা করতে বললেন। দেখা করলাম। জব্বার খান আমাকে ইকবাল ফিল্মসে একটা কাজ জুটিয়ে দিলেন। ইকবাল ফিল্মস থেকে পরিচালক কামাল আহমেদ ‘উজালা’ নামের একটি ছবি তৈরি করবেন, আমাকে তার এসিস্টেন্ট করা হলো। এভাবেই আমি এফডিসিতে ঢুকি।

নায়করাজ রাজ্জাক প্রথম এফডিসিতে অভিনয়ের সুযোগ পান ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’-এ। চরিত্রটি একজন ডাকপিয়নের। সাইকেল চালিয়ে এসে দরজায় দাঁড়ানো, একটি খাম দিয়ে চলে যাওয়া। রতœ চিনতে যেমন ভুল করেন না খাঁটি জহুরি, তেমনি এই ছোট্ট চরিত্রটি করেই রাজ্জাক তেমনি চোখে পড়ে যান মেধাবী পরিচালক জহির রায়হানের। ‘বেহুলা’ ছবিতে জহির রায়হান রাজ্জাককে নায়ক করেন। প্রথম ছবিতে সুচন্দার বিপরীতে অভিনয় করেই রাজ্জাক নজর কাড়েন নির্মাতা-প্রযোজকদের। তারপর কত কত ছবি : ‘কাগজের নৌকা’, ‘আবির্ভাব’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘এতোটুকু আশা’, ‘ময়নামতি’, ‘নীল আকশের নীচে’, ‘আগন্তুক’, ‘যোগবিয়োগ’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘জীবন থেকে নেয়া’ এবং আরো অনেক।

স্বাধীনতার আগেই প্রায় অর্ধশত ছবিতে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন রাজ্জাক। নায়িকা কবরীর সঙ্গে রাজ্জাক গড়ে তুলেন জুটি। তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এই জুটি। স্বাধীনতার পরও তারা ‘অবুঝ মন’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘মতিমহল’, ‘গুন্ডা’সহ বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। তারপর একসময় সেই জুটি ভেঙে যায়।

কবরীর সঙ্গে জুটি ভেঙে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নায়করাজ বললেন, আসলে তখন বয়স ছিল কম। আবেগ ছিল বেশি। আমাদের দুজনের মধ্যে একসময় ইগো সমস্যাটা বড় হয়ে ওঠে। এর পেছনে আশপাশের মানুষের ইন্ধনও ছিল। সেসব কথা নাইবা বললাম। এখন কবরীর সঙ্গে আমার চমৎকার সম্পর্ক। কবরী এমপি হওয়ার পর আমিই বোধহয় প্রথম ফোন করে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম।

অভিনয় জীবনের কয়েকটি স্মরণীয় ছবি ও ঘটনার কথা জানতে চাইলে রাজ্জাক বলেন, চারশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছি। স্মরণীয় ছবি আর ঘটনা তো অসংখ্য, বলে শেষ করা যাবে না। কয়েকটি ছবির প্রতি দুর্বলতা খানিকটা বেশি। প্রথম নায়ক হিসেবে ব্রেক পাই আমি ‘বেহুলা’ ছবিতে। এ ছবির একটা দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে তো পানিতে ডুবে মরতে বসেছিলাম। দেশাত্মবোধের ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’ ও ‘ওরা ১১জন’ ছবিতে অভিনয় করতে পারায় আমি গর্ব অনুভব করি। নিজের পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘অনন্ত প্রেম’ আমার স্মরণীয় একটি ছবি। একইভাবে ‘জোকার’ আর ‘চাপাডাঙ্গার বউ’ আমার পছন্দের ছবি। আসলে পছন্দের ছবির তালিকাটা বিশাল।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট অভিনয়ে এসেছেন। আপনার প্রত্যাশা পূরণে দুই ছেলে কতটুকু সক্ষম হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চলচ্চিত্রে এগিয়ে যেতে হলে যা যা দরকার বাপ্পা আর সম্রাটের মধ্যে তার সবই আছে। আমার সন্তান হিসেবে বাড়তি কোনো সুযোগ তারা পাক, তা আমি কখনো চাইনি। আমার হাত ধরে তাদের অভিষেক হয়েছে, এটুকুই যথেষ্ট। বাকিটুকু নির্ভর করছে তাদের ওপরই।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র থেকে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীর দর্শক হারিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নায়করাজ বললেন, এজন্য তো আমরাই দায়ী। আমাদের অতি-বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণেই রুচিশীল দর্শক চলচ্চিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। আশির দশক পর্যন্ত মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে বিনোদনের জন্য সিনেমা হলে আসতেন। কিন্তু দেখা গেল, পরিবারকে নিয়ে ছবি দেখতে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। আস্তে আস্তে সপরিবারে ছবি দেখতে আসা ছেড়ে দিল। এদিকে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে ঘরে বসেই দেশি-বিদেশি ছবি দেখা সুযোগ তৈরি হলো। সব মিলিয়ে শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত দর্শক হলবিমুখ হয়ে পড়ল।

টিভি চ্যানেলগুলোর চলচ্চিত্র প্রযোজনায় এগিয়ে আসা সম্পর্কে রাজ্জাক বললেন, এ বিষয়ে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। পৃথিবীর বহু দেশের টিভি চ্যানেল চলচ্চিত্র প্রযোজনা করছে। কথা আছে একটা জায়গায়, সেটা হলো টিভি চ্যানেলের প্রযোজনায় যে ছবি নির্মিত হচ্ছে তা অবশ্যই সিনেমা হলে প্রদর্শনের জন্য নির্মিত হতে হবে। প্রিমিয়ারের নামে শুরুতেই টিভিতে সিনেমাটিকে দেখানো কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।

বর্তমানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি পুরোপুরি ‘ওয়ান ম্যান’ নির্ভর হয়ে গেছে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নায়করাজ হাসলেন। বললেন, একজনের ওপর নির্ভর করে একটা ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। এটা সাময়িক। সময়ই বিকল্প তৈরি করবে। এটাকে আমি মোটেও সমস্যা বলে মনে করি না।

পশ্চিমবঙ্গের ছবিতে রাজ্জাককে গত কয়েক বছর নিয়মিত অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে। কলকাতা ও ঢাকার ছবির মধ্যকার পার্থক্য জানতে চাইলে রাজ্জাক বললেন, একসময়ের কলকাতার চেয়ে আমাদের ছবি এগিয়ে ছিল। এখন ওরা আমাদের চেয়ে ১০ বছর এগিয়ে গেছে। মূল জায়গাটা হলো প্রযুক্তির। কলকাতার ছবিতে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে। আমরা পড়ে আছি সেই পুরনো প্রযুক্তি নিয়েই। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের চলচ্চিত্রে ব্যবহার করতে না পারলে আমরা আরো পিছিয়ে পড়ব।

সিনেমা হল সংকটকে নায়করাজ রাজ্জাক এই সময়ের চলচ্চিত্রের বড় সংকট বলে মনে করেন। তিনি বলেন, সিনেমা হল ভেঙে বড় বড় মার্কেট তৈরি হচ্ছে। গুলিস্তান-নাজ নেই, আনন্দ-ছন্দ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সারা দেশের একই অবস্থা। সিনেমা হলই যদি না থাকে তাহলে মানুষ কোথায় গিয়ে ছবি দেখবে? এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। পুরনো সিনেমা হল ভেঙে নতুন মাল্টিপ্লেক্স ভবন হতেই পারে। কিন্তু সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে সিনেপ্লেক্সের মতো ছোটখাট হল রাখার শর্ত যোগ করতে হবে। নকশা প্রণয়নের সময়ই এই শর্ত যোগ করা যেতে পারে। দেশের চলচ্চিত্র শিল্প টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে রাজ্জাক বললেন, এই বয়সে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। গন্তব্য তো একটাই। আমি একদিন শূন্য হাতে স্ত্রী ও শিশু বাপ্পাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম। পরিশ্রম করেই চলচ্চিত্রে জায়গা করে নিয়েছি। চলচ্চিত্র ছাড়া আর কিছুতেই মন বসে না। যতদিন সুস্থ আছি তত দিন চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাই। এ ছাড়া আর কোনো পরিকল্পনা নেই।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৭৩০, ডিসেম্বর ২২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।