ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

নাট্যকারই নন, শিল্পী নির্মাণের কারিগর আতিকুল হক চৌধুরী

কামরুজ্জামান মিলু, স্টাফ করেসপন্ডেট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৩
নাট্যকারই নন, শিল্পী নির্মাণের কারিগর আতিকুল হক চৌধুরী

ঢাকা: আতিকুল হক চৌধুরী। যার নামের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক মণ্ডলের নানা উদ্ভাসিত দিক।

শুধু একজন সফল নাট্যকার নন, নবীন অভিনয়শিল্পী ও নাট্যকারদের আবিষ্কারকও ছিলেন তিনি। তার হাত ধরে আমাদের মিডিয়াতে অসংখ্য গুণী শিল্পীর পথচলা শুরু। তারা প্রায় সবাই শিল্পাঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত।

এ তালিকায় রয়েছেন- আবদুল্লাহ আল মামুন, ফেরদৌসী মজুমদার, শবনম, আবুল হায়াত, হুমায়ুন ফরীদি, মিতা চৌধুরী, কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী, সুলতানা জামান, কেয়া চৌধুরী, শম্পা রেজা, ফাল্গুনী হামিদ, জিনাত বরকতউল্লাহ, নোবেল, সালমান শাহ, শংকর সাঁওজাল, আহমেদ রুবেল, মুনমুন আহমেদ, মানাম আহমেদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নাদের চৌধুরী, টিসা, শামীম আরা নীপা, শিল্পী সরকার অপু, সাবিনা বারী লাকী, পিলু মমতাজ, খালেদ খান, শমী কায়সার, নাতাশা হায়াতসহ অনেকেই।

এই প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী আর নেই। একথা ভাবতেই চোখে জল নেমে আসে। তাকে দেখার জন্য সোমবার রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে ছুটে আসেন দেশের অসংখ্য গুণী ব্যক্তিবর্গ।

স্ত্রী জোহরা বেগম, ছেলে ড. এনামুল হক চৌধুরী ও মেয়ে আসফিয়া বেগম নেহারসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী এবং শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন তিনি। তার মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আতিকুল হক চৌধুরীর মরদেহ রাখা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। এর আগে একুশে টেলিভিশনে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজা হবে। এছাড়া তার পূর্বের কর্মস্থল বাংলাদেশ টেলিভিশননে (বিটিভি) শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাকে মিরপুরে বুদ্ধিজীবী করবস্থানে দাফন করা হবে।

১৯৩১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ভোলা জেলার সৈয়দ বাড়ির বাটামারায় মামাবাড়িতে জন্মেছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী। বাবা মরহুম সেরাজুল হক চৌধুরী ছিলেন প্রাক্তন জেলা রেজিস্টার। মা মরহুম রওশন আরা বেগম। বরিশাল জেলার প্রখ্যাত উলানিয়া জমিদার বাড়ির সন্তান ছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী।

চল্লিশের দশকে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে অভিনয় ও আবৃত্তি করে প্রথম হয়ে অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ‘মীর কাসেম’, ‘একলব্য’ প্রভৃতি নাটকে। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

তিনি প্রথমে রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রযোজক ও অনুষ্ঠান সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রামে। বেতারে তার প্রযোজিত নাটকের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। ১৯৬২ সালে হল্যান্ডে প্রশিক্ষণকালীন তার পরিচালিত প্রথম নাটক ‘দ্য টাইডাল ট্র্যাজেডি’ হল্যান্ডের হিলভারসাম টিভি চ্যানেলে প্রচার হয়। এজন্য তিনি মেরিট সনদপত্র পেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে (পিটিভি) যোগদান করেন আতিকুল হক চৌধুরী।

১৯৬০ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে বসে প্রথম নাটক লিখেছিলেন, যার নাম ছিল ‘নেপথ্যের নায়িকা’ এবং এরপর ১৯৬৭ সালে রেডিওতে মুনির চৌধুরীর ‘সারেং’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এরপর তিনি দেশ স্বাধীনের পর প্রায় ৪০টির মতো নাটক লিখেছেন। তার নাটকে সমাজের গল্প এবং পরিবারের গল্প খুঁজে পাওয়া যেত।

বিটিভিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় ৩০০টিরও বেশি কালজয়ী নাটক প্রযোজনা করেন তিনি। এর মধ্যে তার লেখা ছিল ২৫টিরও বেশি। তার প্রযোজিত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘বাবার কলম কোথায়’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘সুখের উপমা’, ‘সাঁকো পেরিয়ে’, ‘সার্কাস দেখুন’, ‘নীলনকশার সন্ধানে’, ‘গাইড’, ‘সেই চোখ’, ‘নিঝুম দ্বীপের সন্ধানে’, ‘স্বর্ণতোরণ’, ‘উৎসব উৎসব’, ‘তিন দিনের ছুটি’, ‘শহরে ষাট ঘণ্টা’, ‘জুলেখার ঘর’, ‘সাড়ে তিন হাত’, ‘সোনার কাঠি রূপার কাঠি’, ‘আলোতে ছায়াতে’, ‘২০০ প্রাসাদ’, ‘পটভূমি পরিচিতি’, ‘সন্ধি কতদিন’, ‘ডা. মাহতাবের স্বপ্ন’, ‘সুখের অপর নাম’, ‘বাকরখানি’, ‘নীল দর্পণ’, ‘অথচ পবিত্র’, ‘অশ্রুত গান্দার’, ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘ঘুম নেই’, ‘নীল নীল যন্ত্রণা’, ‘মুনিয়া মফস্বলে’, ‘মশারি ৭৩’, ‘বিচারক’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘নিখোঁজ সংবাদ’, ‘নিভৃত যতনে’, ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’, ‘কুশল সংবাদ’, ‘বিচলিত প্রার্থনা’, ‘প্রতিচ্ছবি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘মালঞ্চ’, ‘শুভদৃষ্টি’, ‘মানভঞ্জন’, ‘শেষের কবিতা’, ‘দেয়াল’, ‘কুসুম’, ‘তার রহস্যময় হাসি’, ‘গৃহদাহ’, ‘যাব কি যাব না’, ‘আর কতদূর’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘দেখে যেন মনে হয়’, ‘চোখের বালি’, ‘নিঃশ্বাসের কাছাকাছি’, ‘আপন গন্তব্যে যাব’, ‘রসগোল্লা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘জোহরা’, ‘জোয়ার এলো’, ‘বারো ঘরের ঘরণী’, ‘রূপার কৌটা’, ‘অক্টোপাস’, ‘শাহজাদীর কালো নেকাব’, ‘গুপ্তধন’, ‘সমুদ্র অনেক দূরে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘রাতের পাখিরা’, ‘কোথায় যাব’, ‘আমার কথা লিখুন’, ‘পরিণীতা’, ‘চেহারা’ প্রভৃতি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও তলস্তয়ের সাহিত্য নিয়ে কয়েকটি নাটকের নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালের ৮ ডিসেম্বর বিটিভিতে প্রচারিত প্রথম প্যাকেজ নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’ পরিচালনা করেছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী।

রামপুরা টেলিভিশন ভবনের উদ্বোধনী দিনের নাটক ‘দূরদর্শিনী’ তার লেখা ও পরিচালিত। বিটিভির প্রথম এ মাসের নাটক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বড় দিদি’ অবলম্বনে নাটক প্রযোজনা করেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অতিথি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

২০০৫ সালে পরিচালক (অনুষ্ঠান) পদে একুশে টেলিভিশনে যোগদান করেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে সেরা নাট্য পরিচালক হিসেবে জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার, শেরেবাংলা স্মৃতি পুরস্কার, স্যার সলিমউল্লাহ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

নাটকের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিনি। আর সব সময় নবীনদের খুঁজে তার নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিতেন আতিকুল হক চৌধুরী। তাই শুধু নাট্যকার বা মিডিয়াব্যক্তিত্ব নন, একজন অভিনয় শিল্পীর আবিস্কারকও ছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৩
এমকে/সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।