ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

ওয়াইন

হলিউডের অন্য নায়ক

বিধান রিবেরু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১০
হলিউডের অন্য নায়ক

চলচ্চিত্রে বহুমুখী চরিত্রে অভিনয় করে থাকে সে। ভালো চরিত্র-খারাপ চরিত্র।

মুভির বাইরে তো অবশ্যই, ভেতরেও এই তারকার চরণধূলি পড়েছে এন্তার, বিশেষ করে হলিউডি মুভিতে। তার নাম ওয়াইন। এই তারকা অবশ্য বেশ আগেই নিজের স্থান পোক্ত করে নিয়েছিল। পৃথিবীর প্রাচীন সাহিত্য (বা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ) বাইবেলেও এই ওয়াইন বা অ্যালকোহলযুক্ত দ্রাক্ষারস নিদারুণভাবে উপস্থিত।

‘সেই নোয়াই হলেন প্রথম কৃষক, বস্তুত তিনি একটা আঙুরখেত করতে শুরু করলেন। আঙুররস পান করে তিনি মাতাল হলেন, এবং বস্ত্রহীন অবস্থায় তাঁবুর মধ্যে শুয়ে পড়লেন। (আদিপুস্তক ৯:২০-২১)
বাইবেলের নতুন নিয়মে যোহন লিখিত সুসমাচার ২: ১-৫-এও দ্রাক্ষারসের উল্লেখ আছে। যেখানে দেখা যায়, কানা নগরের এক বিয়েবাড়িতে দ্রাক্ষারস শেষ হয়ে যায়। সেখানেই প্রথমবারের মতো আশ্চর্য কাজ করে দেখান প্রভু যীশু। তিনি শূন্য জালা পানিতে ভর্তি করতে বলেন। এবং পানিকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করেন। মধ্যপ্রাচ্যে যীশুর জন্মের ৬০০০ হাজার বছর আগে থেকেই দ্রাক্ষারস অর্থাৎ ওয়াইনের সেবা করে আসছেন পিপাসুরা। নইলে রোমান দেবতা ডায়োনাইসাস কেন ওয়াইনের দেবতা হবেন!
হলি বা পবিত্র ওয়াইন থেকে ফেরা যাক হলিউডি ওয়াইনের গপ্পে।

‘মাই ফেয়ার লেডি’ (১৯৬৪) মুভিতে এলিজা ডুলিটিলকে প্রফেসর হেনরি হিগিনস শেখান কোন তরিকায় ওয়াইনের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। ‘ব্যাড কোম্পানি’ (২০০২) মুভিতে ক্রিস রককে শেখানো হয় বর্দুর পোর্ট  (বর্দু ওয়াইনের নাম আর পোর্ট হলো একটি ধরন; পোর্ট শ্রেণীর ওয়াইন হয় স্বাদু, গ্যাসহীন ও লালরঙা) কীভাবে তারিফ করতে হয়। ১৯৫৮ সালের মিউজিক্যাল মুভি ‘গিগি’তে দেখা যায় লেসলি ক্যারনকে বলা হচ্ছে রূপাজীবীর ভঙ্গিতে ওয়াইন পান করা শিখতে। কারণ ওটা তার প্রশিণের একটি অংশ। এ মুভির স্মরণীয় একটি গান ‘দি নাইট দে ইনভেন্টেড শেমপেইন। ’

শেমপেন শুদ্ধতা, আধিক্য, বিলাসিতা, ভালোবাসা ও উদযাপনের প্রতিনিধি। ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’ (১৯৪২) মুভিতে হামফ্রে বোগার্ট ও ইনগ্রিড বার্গম্যানকে দেখা যায় শেমপেন গলাধঃকরণ করতে, আসন্ন যুদ্ধকে ভুলে থাকার প্রয়াসে। স্যাম বাজাচ্ছে ‘এজ টাইম গো-জ বাই’ আর ওদিকে বোগার্ট বার্গম্যানকে বলছে,  ‘হেনরি (মালিক) চাচ্ছে এ বোতলটা শেষ করে আমরা আরো তিনটা নেই। কারণ সে বলে, জার্মানরা শেমপেনে মুখ লাগানোর আগে সব বোতল- বাগানে- গাছের গোড়ায় ঢালবে। ”

অ্যাকশন হিরো হিসেবে জেমস বন্ডই প্রথম ওয়াইনকে এনে দেয় পৌরুষ ও যৌনাবেদন। ২০০২ সালের ‘ডাই এনাদার ডে’তে চৌদ্দ মাস উত্তর কোরিয়ার জেলখানায় থেকে মুক্তি পায় জেমস বন্ড। এবং প্রথমেই সে চায় শ্মশ্র“-মুন্ডন অর্থাৎ শেভ এবং এক বোতল বোলেনজার ১৯৬১। গোল্ডেন আই (১৯৯৫) মুভিতে দেখা যায় এক নারী মনোচিকিৎসক জেমস বন্ডকে জিজ্ঞেস করছে, কীসে তার আরামবোধ হবে। বন্ড তার এস্টন মার্টিনের ড্যাশবোর্ডের একটি বোতামে চাপ দিল আর দেখা গেল হিমায়িত একটি কমপার্টমেন্ট বেরিয়ে আসছে। সেখানে বোলেনজার গ্রেন্ড আনে ১৯৮৮ এবং দুটো খাঁজকাটা কাচের পানপাত্র।

মল্লযুদ্ধেও বন্ড দারুণ রসিক। ‘ডক্টর নো’ (১৯৬২) মুভিতে জিরো জিরো সেভেনের হাতে ওয়াইনের বোতল- সামনে খলনায়ক। বন্ড সংলাপ দিচ্ছে, ‘এটা ডোম-পেরিন-ইয়ন ‘৫৫, এটাকে ভাঙলে কষ্ট লাগবে। ’ বলে বন্ড একটু পিছু সরলো, ‘তারচে বরং আমার ‘৫৩টাই ভালো। ’ নিজের হাতটাই ব্যবহার করল খলনায়ক শায়েস্তা করতে, রা পেল ওয়াইনের বোতল। ১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ডায়মন্ডস ফর এভার’-এ শত্র“প খুঁজে বের করতে লাল ওয়াইন সম্পর্কিত জ্ঞানকে কাজে লাগায় বন্ড। একটি ক্রুজ লাইনারের পাটাতনে বসে ডিনার করছে বন্ড ও টিফানি কেস (জিল সেন্ট জন)। ওয়াইন স্টুয়ার্ট এসে তাদের গেলাসে ঢেলে দিচ্ছে মোটন-রোথসচাইল্ড ১৯৫৫। বন্ড আড়চোখে তাকালো সেদিকে, মুখ দেখে বুঝা গেল সামান্য সমস্যা হয়েছে। কী সেটা? জাহাজে ক্যারেট (মোটন-রোথসচাইল্ডেরই একটি শ্রেণী, এর রঙ লাল) নেই ! সেই স্টুয়ার্টও বললো, নেই। ব্যস! বন্ড বুঝে ফেলল, ইনি শত্রু পরে লোক, স্টুয়ার্ট হওয়ার ভান করছে। কারণ যে ওয়াইন গেলাসে ঢালা হচ্ছিল সেটা ক্যারেট গোত্রেরই ছিল।

অ্যাকশনের বাইরে রসিকতার মধ্যেও ওয়াইন অনুপস্থিত থাকেনি। ‘স্লিপিং ইন সিটল’ (১৯৯৩) মুভিতে ম্যাগ রায়ানের বয়ফ্রেন্ডকে দেখা যায় বেশ মজা করে দোম দো-লুইসের বোতল অর্ডার করতে। ‘দি জার্ক’ (১৯৭৯) ছবিতে দেখা যায়, নব্যধনী স্টিভ মার্টিন তার বাগদত্তাকে নিয়ে নামিদামি এক ফরাসি রেস্টুরেন্টে গেছেন। প্রথমে তাদের থালায় পরিবেশিত হলো শামুক। এবং এর পরপরই পুরনো ওয়াইন। মার্টিন ওয়েটারকে বলল, ভাই আপনাদের ফ্রেশ, নতুন ওয়াইন নেই? থাকলে ওটা নিয়ে আসেন। আর আনার সময় গেলাসের ওপর ছাতাখানা দিতে ভুলবেন না যেন!

‘আ ওয়াক ইন দি কাউড’ (১৯৯৫) ছবিটিও ওয়াইনপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় আছে  সন্দেহ নাই। এই ছবিতে কিয়ানু রিভস একজন ফেরিওলা। তার সাথে পরিচয় হয় আইতানার (ভিক্টোরিয়া অ্যারাগন)। আইতানার বাবা আবার ক্যালিফোর্নিয়ার আঙুর খেতের মালিক। সেখান আঙুর থেকে পানীয় হয়। বিশাল গামলায় আঙুর পিষে রস বার করার দৃশ্যটি যারা দেখেছেন, তাদের চোখে এখনো লেগে আছে নিশ্চিত। দ্রাক্ষা মাড়িয়ে রস বার করার সেই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই রিভস আর অ্যারাগনের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসার রসায়ন।

ছবিটির একজায়গায় পিপেভর্তি ওয়াইন দেখা যায়। দেখা যায় পোকামাকড়ের হাত থেকে আঙুর খেত বাঁচানোর দৃশ্য। শেষ অঙ্কে দেখা যায় লন্ঠন থেকে পুরো আঙুর ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। রাতের আঁধারে দ্রাক্ষাক্ষেত্রের ঐ লেলিহান শিখা মনকে বিষাদ আর অসহায়ত্বে ভরিয়ে তোলে। পরদিন ভোরের দৃশ্য আবার মনের ভেতর ফেলে নতুন জীবনের বিভা : দেখা যায়, ভস্ম খেত থেকে রিভস আর অ্যারাগন খুঁজে পায় একটি জীবন্ত দ্রাালতা। সেটাকে তারা আবার বপন করে মাটিতে।

অ্যাকশন, কমেডি, রোমান্টিক বৃত্তের বাইরে হরর বা ভয়ের ছবিতেও ওয়াইন বেশ সগৌরবেই হাজির। বিশেষ করে ড্রাকুলাভিত্তিক ছবিতে। সেখানে দেখা যায় কাউন্ট ড্রাকুলা কাচের গেলাসে ক্যারেট (লাল ওয়াইন) ঢেলে দিয়ে মেহমানকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কী ব্যাপার, খাচ্ছো না যে?’ কিছুণ পর নিজেই আবার বলছে, ‘আমি আবার ওয়াইন-টোয়াইন খাই না!’
 
‘ইন্টারভিউ উইথ দি ভাম্পায়ার’ (১৯৯৪) ছবিতে দেখা যায় টম ক্রুজ একটা ইঁদুর ধরে, সেটাকে চিপে রক্ত ঢালে ওয়াইনের গেলাসে। তারপর তা পান করতে দেয় ব্র্যাড পিটকে। ‘সাইলেন্স অব দি ল্যাম্বস’ ছবিটি ১৯৯১ সালে যখন থিয়েটার তোলপাড় করছে তখন তার সাথে অনেক ওয়াইনপ্রেমীও নড়েচড়ে বসেছে। কারণ, টুসকান ওয়াইনের সাথে একধরনের বীজ আর মানবযকৃত খাওয়ার দৃশ্য!

হলিউডের থ্রিলারেও কয়েকশ বার ওয়াইনের বদন দেখা যায়। ‘ডিসকোজার’ (১৯৯৪) ছবিতে ব্যভিচার করতে ওয়াইনকে ব্যবহার করে ডেমি মুর। মুরের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মাইকেল ডগলাস। ডগলাস ঐ প্রতিষ্ঠানের নতুন ম্যানেজার, বিবাহিত এবং সুপুরুষ। মুর আকৃষ্ট তার প্রতি। একরাতে ডগলাসকে ডাকা হলো মুরের অফিসরুমে। সেখানে রাখা ক্যালিফোর্নিয়ায় চাষ করা লাল ওয়াইনের আঙুর ক্যাবারনেট থেকে তৈরি বিরল পানীয় ‘পাহলমিয়ার ’৯১’। দেখে ডগলাস জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কীভাবে বুঝলে পাহলমিয়ার ’৯১ আমার পছন্দের বস্তু?’ মুর উত্তর দেয়, ‘আমি চাই আমার অধীনে সব বালকই খুশি থাকুক। ’

সারা পৃথিবীতেই দ্রাক্ষারস এবং অ্যালকোহলযুক্ত দ্রাক্ষারস বেশ জনপ্রিয় পানীয়। আর চলচ্চিত্রে এই দ্রাক্ষারস বেশ ভালোভাবেই জোড় বেঁধেছে মার্কিন মুভির সাথে। এটার একটা কারণ হতে পারে আমেরিকানরা ওয়াইনকেই বেশি পছন্দ করে কঠিন পানীয় হিসেবে কিংবা মনে করে, ওয়াইন হলো হুইসকির চেয়ে জটিল তরল। জটিল কেন? ওয়াইনের নানা পদ, রঙ, নানারকম তার স্বাদ। বিভিন্ন কোম্পানির কথা তো বাদই দেওয়া যায়।

ওয়াইনকে প্রধানত তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়: স্বাদ (স্টেট), রঙ (কালার) ও ঢঙ (স্টাইল)। স্বাদ হয় দুই ধরনের : রসহীন(ড্রাই) ও মিষ্টি। রঙ হয় তিন ধরনের : শাদা, লাল ও গোলাপি। ঢঙও হয় দুই ধরনের : বুদবুদসহ (স্পার্কলিং) ও বুদবুদ-ছাড়া (স্টিল)। এখন এই যে তিন শ্রেণীতে ভাগ হলো, এর প্রত্যেক শ্রেণী থেকে একটি করে ধরন নিয়ে তৈরি হয় একটি বৈশিষ্টের ওয়াইন। ওই তিন শ্রেণীর মধ্যকার ভাগগুলো নিয়ে যতটি সমবায় সম্ভব- ওয়াইন তত প্রকার। যেমন- শেমপেইন স্বাদে হয় রসহীন, রঙে শাদা আর ঢঙে হয় বুদবুদসহ। এখন এই শেমপেইন আবার তৈরি করে বিভিন্ন কোম্পানি। অতএব বোঝাই যাচ্ছে ওয়াইন জিনিসটা সরল নয়, বরং বেশ জটিলই। এই চরিত্রের সাথে আমেরিকানদের মিল আছে বলেই হয় তো তাদের মুভিতেও নানা সময়ে নানা চরিত্রে অনায়াসে ঢুকে গেছে এই ওয়াইন। আমেরিকানদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ‘দি ক্রনিকল’ পত্রিকা ২০০৬ সালে প্রকাশ করে আমেরিকার শীর্ষ দশ ওয়াইন মুভির নাম :

১.    ক্যাসাব্ল্যাঙ্কা (১৯৪২), পরিচালক : মিখায়েল কার্তিজ
২.    ডক্টর নো (১৯৬২), পরিচালক : টেরেন্স ইয়ং
৩.    ফ্রেঞ্চ কিস (১৯৬৫), পরিচালক : লরেন্স কাসদান
৪.    গিগি (১৯৫৮), পরিচালক : ভিনসেন্ট মিন্নেললি
৫.    কিলার বিজ (১৯৭৪), পরিচালক : কারটিস হ্যারিংটন
৬.    দি মাপেট মুভি (১৯৭৯), পরিচালক : জেমস ফ্রলি
৭.    নটোরিয়াস (১৯৪৬), পরিচালক : আলফ্রেড হিচকক
৮.    সাইডওয়েজ (২০০৪), পরিচালক : আলেক্সান্দার পেনি
৯.    সাইল্যান্স অব দি ল্যাম্বস (১৯৯১), পরিচালক : জোনাথন দিমি
১০.    দিস আর্থ ইজ মাইন (১৯৫৯), পরিচালক :হেনরি কিং

এছাড়াও ‘এন এফেয়ার টু রিমেম্বার’ (১৯৫৭), ‘ব্লাড অ্যান্ড ওয়াইন’ (১৯৯৬), ‘দি গডফাদার’সহ (১৯৭২) বিভিন্ন নামকরা মুভিতে ওয়াইন অভিনয় করেছে এবং ভবিষ্যতেও করে যাবে। কিন্তু এত বছর পরও কমপে লাইফটাইম এচিভমেন্ট বিভাগে বেচারা কেন যে অস্কার পেল না, তা পুরস্কার দেনেওলারাই জানেন!

তথ্যসূত্র:

  • হলিউড অ্যান্ড ভাইন : ওয়াইনস স্টেরিং রোল ইন দি মুভিজ, নাতালি ম্যাকলিন, রিডার্স ডাইজেস্ট, জুলাই-২০০৭।
  • ওয়াইন : উইসডম, মগনদ্বীপ সিং, পেঙ্গুইন বুকস-২০০৫।
  • টপ টেন ওয়াইন মুভিজ, ডব্লিউ ব্লাক গ্রে, দি ক্রনিকল, জুন ২২, ২০০৬।    
  • পবিত্র বাইবেল, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী, ১৯৯৯


বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৯৫৮, ডিসেম্বর ৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।