ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না...

সারা মনামী হোসেন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১২
বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না...

টাকা জমিয়ে, স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখেনি এমন মানুষ বোধ হয় খুব কমই পাওয়া যাবে। আর ছুটির দিন বা যে কোন উপলক্ষ হলে সিনেমা দেখা তো চাই- ই চাই।

এভাবে এমন একটা সময় ছিল যখন সিনেমা ছিল বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সে সময়টিতে ছিল ভাল সিনেমা এবং হল ভর্তি দর্শক। নওয়াব পরিবারের তরুনদের হাত ধরে যখন ঢাকাই চলচ্চিত্র বা সিনেমার যাত্রা শুরু এরপর থেকেই সে ধারা আজও অব্যাহত আছে। শুরুতেই যে সিনেমাগুলো আমরা দেখতেই পাই তার অধিকাংশই ছিল সামাজিক বা লোক সাহিত্য নির্ভর। এক সময় শুরু হল সামাজিক ঘরনার ছবির । ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র তার ধরন পাল্টাতে শুরু করে। একসময় দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে রোমান্টিক ঘরনার ছবি। তরুণ দর্শকদের কাছে এ ধরনের ছবি ও তাদের জুটি চলেও আসে পছন্দের প্রথম তালিকায়। তবে এসব ছবির ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি ধরা পড়ে তাহলো হিন্দি সিনেমার প্রভাব। প্রতিটি ছবিতে প্রেম, পারিবারিক কলহ, মারামারি ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। অর্থাৎ নায়ক- নায়িকা উভয়ের পরিবারের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, তাদের অসম প্রেম অথবা গুন্ডা-মাস্তান বাহিনীর হাত থেকে নায়িকাকে উদ্ধার এবং সাথে সাথে একটি গানের দৃশ্যায়ন অনেকটা ফ্যান্টাসির মত তাদের সামনে তুলে নিয়ে আসা হয়। এখনকার সময়ের অনেক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও এই দশা অব্যাহত আছে। বাণিজ্যিক ছবির তোড়জোড় সেই-অ্যাকশন, প্রেম ও কাতুকুতু মার্কা কমেডিতে ঘুরপাক খায় আর তাতে হিরো হয়ে ওঠেন অতিমানব এবং হিরোইন হন সংর্বসহা।

বলা হয়, মানুষ বাস্তবে যা পারে না, চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রগুলো তাই করে দেখায়। দর্শক তাদের সাথে মিশে গিয়ে, অপ্রাপ্তির জায়গাটিকে ঐ চরিত্রের মাধ্যমে তৃপ্ত করে। দর্শক নিজেকে খুব সহজেই চরিত্রগুলোর মাঝে নিজেকে মানিয়ে নেয়। তার নিজস্ব বাস্তবতার সাথে মেলানোর চেষ্টা করে। ফলে ফিল্মি দুনিয়াটা অনেক সময় তাদের কাছে বাস্তবই মনে হয়। এ কারণেই কতজন প্রেমিক বা প্রেমিকা পরস্পরের জন্য হাত কেটেছে, রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছে এমন ঘটনা যেমন আছে। আর তেমনি অভিনেতাদের পোষাক, স্টাইল, চলাফেরা অনুকরণ করা তো খুবই স্বাভাবিক। এই সিনেমার দুনিয়া মানুষকে কতটুকু টানে সেসব বিষয় এসব ছোটখাট ব্যাপার থেকেও অনেকখানি বুঝা সম্ভব। তবে এ জায়গাটি পরবর্তীকালে এমন অবস্থায় এসে যেতে শুরু করে, যে মানুষ এক সময় হল বিমুখ হয়ে যায়। নব্বই দশক থেকেই চলচ্চিত্রে যুক্ত হয় যে ভয়াবহ শব্দটি তা হল অশ্লীলতা। একে পুঁজি করে অনেকেই দর্শক হলে টানার চেষ্টা করেছে। তৃতীয় শ্রেণী কিছু শিল্পীর অবাধ শরীরী উপস্থাপন চলচ্চিত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। ধর্ষন, ভিলেনদের সন্তুষ্ট করার জন্য নাচানাচি এসব কিছু চলচ্চিত্রের অশ্লীলতায় সংযোজিত হয় এবং এ কারণে এক শ্রেণীর লোক এসব উপভোগ করলেও এ শিল্প মাধ্যমটি যেতে থাকে পড়তির দিকে। অশ্লীলতার সাথে অ্যাকশন দৃশ্য যোগ করে রগরগে সিনেমা বানানোর অপচেষ্টা এবং তার সাথে যোগ হওয়া অশ্লীল গানের কারণে ’বাংলা সিনেমা’- একথা শোনার সাথে সাথে মানুষ নাক সিঁটকাটে শুরু করে। অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রভাবে সেন্সর বোর্ড থেকে কাটপিস জুড়ে দেওয়া এসব চলচ্চিত্র ছাড়পত্র পেতে শুরু করায় এ অবস্থা আরও প্রকট হয়ে যায়। এমন একটি সময়ে অনেক নির্মাতা, কলাকুশলী এবং প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন আসতে থাকে। ২০০৭ সালের এর বিরুদ্ধে র‌্যাব কর্তৃক টাস্কফোর্স অভিযান শুরু হলে এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।

এতসব বাণিজ্যনির্ভর ছবির মধ্যে চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র। জহির রায়হানের হাত ধরে চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে ভিন্ন একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি নির্মাণ করেন স্টপ জেনোসাইড। এরপর মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ’ওরা এগারো জন’, ’অগ্নিসাক্ষী’, ’আবার তোরা মানুষ হ’, ’আগুনের পরশমনি’, ’হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড’ এর মতন কিছু ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র পাওয়া যায়। এরপর বহু বছর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ’শ্যামল ছায়া’, ‘জয়যাত্রা’, ‘মাটির ময়না’,‘আমার বন্ধু রাশেদ’ এবং ‘গেরিলা’ দর্শক প্রিয়তা পায়। প্রতিটি ছবিই মহান মুক্তিযুদ্ধকে সুন্দরভাবে তুলে আনার চেষ্টায় প্রশংসা কুড়িয়ে নেয়।

এবার দেখে আসা যাক এত চড়াই উতরাই এরপর বাংলা চলচ্চিত্রের সার্বিক অবস্থান কোথায়। বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বছরে একশটি চলচ্চিত্র মুক্তি দেয় এবং এসব চলচ্চিত্রের জন্য গড় বাজেট প্রায় ২০ কোটি টাকার মত। এই বাজেটের মধ্যে যেগুলো নির্মিত হয় তার অধিকাংশই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র। গৎবাঁধা কাহিনী নিয়ে যা এখনও চলছে। এছাড়া অদ্ভুত ও উদ্ভট নামের কিছু চলচ্চিত্রও সামনে আসে। ‘খাইছি তোরে’ কিংবা ’মন বসে না পড়ার টেবিলে’। এ ধরনের নাম চলচ্চিত্রের মত শিল্পের নামের যে সৌন্দর্য বা ভাব গাম্ভীর্যতাকে হাস্যরসে পরিণত করেছে। নামের পাশাপাশি এসব ছবির পোস্টার গুলোও অনেক ক্ষেত্রেই অশ্লীলতা যুক্ত এবং বিকৃত রুচির পরিচয় দেয়। নান্দনিকতার বিষয়টি এখানে পুরোপুরি উধাও। দৃষ্টি আকর্ষণটাই বড় ব্যাপার।

এরপর যা দেখা যায় তা হল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের আগমন। এ চ্যানেলগুলোকে পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রের সার্বিক মন্দা দূর করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখা যায়। এর ফলে চ্যানেল আই এর প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর ব্যানারে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হতে থাকে। পরে এ আসে এটিএন, এনটিভি প্রযোজিত চলচ্চিত্র। এ সময়টিতে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র কিছু পাওয়া যায়। শুভা, শাস্তি, দ্বারুচিনি দ্বীপ, জয়যাত্রা, আমার আছে জল এর মত ছবি দর্শক উপভোগ করেছে।

তবে এ ছবিগুলো টেলিভিশন সেটটির ছোট পর্দায়ই আটকে ছিল। কারণ দর্শক টেলিভিশনের পর্দায়ই তা উপভোগ করছে। আর সিনেমা হল তার জায়গাতেই রয়ে গেছে। তবে চলচ্চিত্রের দূরাবস্থার মধ্যে কিছু রোমান্টিক ঘরনার, কিছু সামাজিক ঘরনার ছবি মুক্তি পায়, যা ধীরে ধীরে আবারও দর্শককে হলমুখী করতে শুরু করে। বাণিজ্যিকভাবে সফল এসব ছবির নির্মাণকাজ, দৃশ্য ধারন, লোকেশন, গান সবকিছু দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গানের কারণে ছবি মুক্তির আগেই অনেক ছবিকে আলোচিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। যার প্রমাণ হচ্ছে ব্যাচেলর, মনের মাঝে তুমি, হৃদয়ের কথা, আকাশ ছোঁয়া ভালবাসা, মনপুরা এর মত চলচ্চিত্র। ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া ’মনের মাঝে তুমি’ সিনেমা ইতিহাসে অন্যতম সর্বাধিক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। ছবিটির গান, কাহিনী দর্শককে আবারও বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে আগ্রহী করে তোলে। এরপর পর হৃদয়ের কথা; আকাশ ছোঁয়া ভালবাসা; মনপুরা; রানী কুটির বাকি ইতিহাস- এর মত ক্লাইমেক্স ও ভালবাসানির্ভর ছবি নির্মিত হয়। চলচ্চিত্রের সংগীত আবারও দর্শকদের হলে সিনেমা দেখাতে উৎসাহী করে। এখানে সিনেমার পাশাপাশি অভিনয় জুটি, সঙ্গীতাশিল্পীরাও জনপ্রিয় হতে শুরু করে। কাহিনী তেমন একটি শক্তিশালী না হলেও নির্মাণশৈলী ও গানের কারণে এসব চলচ্চিত্র  উঠে আসে।

এদিকে তরুণ প্রজন্মকে হলমুখী করতে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে আগ্রহ জাগাতে সম্প্রতি তাদের মত করে কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে তরুণ প্রজন্ম নতুন কিছু শিখেছে বা জেনেছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। সময়ের তালে তালে চলা ওয়েস্টার্ন স্টাইল বা ডিজুস ভাষা টাইম পাস সম্পর্ক যখন এসব চলচ্চিত্র উঠে আসে তখন তা এ প্রজন্মকে কোন মূল্যবোধের শিক্ষা দেয় কিনা বা আরও অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিনা তাই ভাবার বিষয়। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ’ব্যাচেলর’ বা ’থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এ তরুণদের ও বা বর্তমান সমাজের অবস্থা তুলে ধরার কথা বলা হলেও এটা চেপে যাওয়া হয়েছে যে এ ধরনের ছবি এ বিষয়গুলোকে আরও বিস্তৃত করবে। নারী পুরুষের মধ্যকার শ্রদ্ধা ও সম্মানের সম্পর্কটি তথা শ্রদ্ধা, পারস্পারিক নির্ভরতা ও সততা নিয়ে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বিষয়টি উহ্য থেকে গেছে। নিছক বিনোদন দানের উদ্দেশ্যেই ছবি চলেছে পর্দা জুড়ে।

এখানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠাগুলোর ব্যাপারটিও চলে আসে। তারা সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসলেও বৃহৎ স্পষ্ট এখানে মুনাফা লাভ। টেলিভিশনে যে ছবি দেখার তাতে যে স্পন্সর, যত বিজ্ঞাপন দর্শকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় তাতে লাভ হয় এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর। চলচ্চিত্রের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে এখানে তারা বিশেষ কোন প্রভাব রাখতে পারছে না। এমন কি মূল দৃষ্টিতেও সূক্ষ্ম সূক্ষ্মভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং লাভটা এখানে চলচ্চিত্র শিল্পের নয়, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর।

এখন হলগুলোর অবস্থা যদি পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে দেখা যায় ব্যবসায়িক মন্দার কারণে অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। দর্শকদের অভিযোগ পাওয়া যায় হলের পরিবেশ ভাল নয়। অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার অভাবে তারা আর হলে যান না। আর ভাল কয়েকটি যে হল আছে তাতে যদি ভাল ছবি আসে তবেই তা দেখা হয়, নচেৎ নয়। ঢাকার হলগুলোর যখন এ চিত্র মফস্বলের হলগুলো কতটুকু  উন্নত তাই নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সিনেমা হল নিয়ে যখন এত সমস্যা তখন পাইরেসির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। পাইরেসির কারণেও অনেক সময় চলচ্চিত্রের পরিচালক, প্রযোজকরা মার খেয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া চলচ্চিত্র ব্যবসা সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের জ্ঞানের অভাব চলচ্চিত্র শিল্পের অবনতির জন্য দায়ী। দ্রুত মুনাফা লাভের জন্য সস্তা বাজেটের ছবি তৈরি করে দর্শকদের সামনে দেওয়া হচ্ছে। আর এগুলো বিরূপ প্রভাব ফেলেছে খুব ভালভাবেই। এসব সমস্যার ক্ষেত্রে যদি চলচ্চিত্র বিনিয়োগকারী, পরিচালক, প্রযোজক বা হল মালিকেরা দায়ী থাকেন তাহলে এর পাশাপাশি অভিনয় শিল্পী ও দর্শকরাও তাদের দায়ভার পুরোপুরি এড়াতে পারবেন না। আজ যখন একটি ভারতীয় চলচ্চিত্র হলিউড থেকে নকল হয়ে আসছে তখন সবাই তা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। অথচ যখন বাংলা চলচ্চিত্র ভারতের কাহিনীকে নিয়ে নির্মিত হচ্ছে তখন তাকে নকল বলে উপহাস করা হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে নকল চলচ্চিত্রকে উৎসাহ দিতে হবে। এখানে ব্যাপারটি হচ্ছে মন মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থান। স্যাটেলাইটের কল্যাণে বলিউডি ও হলিউডি ছবি এখন সহজলভ্য। এর মধ্যে বলিউডি ছবি পুরো পৃথিবী জুড়েই তাদের অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছে। তাদের কাহিনী, নির্মাণ কৌশল, বাজেট সব কিছু অনেক উন্নত ও বেশি। কিন্তু ছবির মৌলিকত্ব কম। তাদের অনেক ছবি এখন হলিউড কিংবা তামিল চলচ্চিত্র থেকে নেওয়া, যাদের বলা হচ্ছে ’অমুক কাহিনী অবলম্বনে’ অথবা ’রিমেক’ । বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের হয়ত ছবির বাজেট কম থাকে। নকলের ছাপ থাকে। কিন্তু এই স্বল্প বাজেট এর  মধ্যে হয়ত সম্ভব সুস্থ ধারার ছবি নির্মাণ করা।

দর্শকদের অনাগ্রহের কারণেই ’স্বপ্নডানায়’, ’নিরন্তর’, ’জয়যাত্রা’, ’মেঘলা আকাশ’, ’মেঘের কোলে রোদ’, ’ঘানি’, ’হাজার বছর ধরে’ এ ধরনের চলচ্চিত্র তেমন ব্যবসায় সফল হতে পারেনি। তবে দর্শক সমালোচকদের প্রশংসা এসব ছবি পেয়েছে। এসব ধারার ছবি বিশেষ করে স্বাধীন ধারার ছবিগুলো বাণিজ্যিক ছবির মত রঙচঙে না হওয়ার কারণেই একশ্রেণীর দর্শকের কাছে এগুলো তেমন আগ্রহ বা সেন্টিমেন্ট জাগাতে পারেনি। এখানে আবার একটি কথা থেকে যায়। শহরের দর্শকই তো শুধু দর্শক নয়। গ্রামের বা মফস্বলের মানুষের কাছে চলচ্চিত্র বিনোদনের খুব বড় একটি মাধ্যম। শহরের মানুষের মত তারা এত সুযোগ সুবিধা পায় না, ফলে সারাদিনের পরিশ্রম বা জীবনসংগ্রামের কঠিন আবর্তে তারা যে বিনোদন চায় তা হল ক্ষণিকের জন্য রঙিন একটি জগতে ঘোরা। যেখানে জীবন ও ভালবাসার সব পরিণতিই সফল। শত্রুর সঙ্গে মারামারি বা নায়ক-নায়িকার পরিবারের আনন্দাশ্রু খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও তাদের কঠিন বাস্তবতার বেড়াজাল থেকে দূরে রাখে। আর তাই এ ধরনের দর্শকদের আবেগকে পুঁজি করে সস্তা ছবি নির্মাণ করে চলচ্চিত্র মাধ্যমের মানকে নি¤œ করে দেওয়া হয়েছে নানাভাবে। ভাল নির্মাতা, প্রযোজক যদি দর্শকের চাহিদা বুঝে ছবি নির্মাণ করেন তাহলে এ শিল্পটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া পারস্পরিক ব্যবসায়িক স্বার্থ যদি সিনেমা জগতকে কলুষিত না করে তাহলে আরও ভাল ভাল ছবি পাওয়া সম্ভব।

এসব সমস্যার পরও আমাদের চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রাপ্তি কিন্তু কম নয়। গত কয়েক বছরে ভাল ভাল কিছু ছবি মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে বেশ কিছু ছবি স্বীকৃতিও লাভ করেছে। যার মধ্যে মোরশেদুল ইসলামের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ’আগামী’ দিল্লি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পায় ও প্রদর্শিত হয়। প্রয়াত তারেক মাসুদের ’মাটির ময়না’ কান চলচ্চিত্র উৎসবের সমালোচক পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি অস্কার প্রতিযোগিতায় প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে আমন্ত্রিত হয় এবং ইউরোপ, আমেরিকায় বাণিজ্যকভাবে মুক্তি পায়। এছাড়া দেশের বাইরে আরও যেসব ছবি বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায় সেগুলো হল, তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালসালু’, গোলাম রাব্বানীর ‘স্বপ্নডানায়’, তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’, আবু সাইয়ীদের ‘শঙ্খনাদ’ ও ’নিরন্তর’, এনামুল করিম নির্ঝরের ‘আহা!’। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বাংলা চলচ্চিত্র পরিচিত পাচ্ছে, পাচ্ছে স্বীকৃতিও। সম্প্রতি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গেরিলা ’ ছবিটি পেয়েছে ন্যামটেক পুরস্কার। এ অর্জনগুলোকে ধরে রেখে ভাল ছবি নির্মাণে আরও উৎসাহিত হওয়া উচিত। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন কিছু নির্মাতার আবির্ভাব ঘটেছে। যারা নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই এখন চলচ্চিত্র নির্মাণে ঝুঁকেছেন। এর মাঝে ২০১১ সালে মুক্তি পায় মোস্তফা কামাল রাজের চলচ্চিত্র ‘প্রজাপতি’। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে রেদওয়ার রনি পরিচালিত ‘চোরাবালি’।

এছাড়া মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’ ও মুক্তি পাবে। এছাড়া এ বছর নোমান রবিন এর ‘কমন জেন্ডার’ বহুল আলোচিত ছবি হিসেবে দর্শকদের মনে স্থান করে নিয়েছে। নির্মাতারা যদি ভাল কাহিনী নির্ভর ও সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসে তবে এ শিল্প আরও এগিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে ।

উপন্যাস যেমন জীবনের কথা বলে চলচ্চিত্রও বলে। দু’টোতেই কল্পনা ও বাস্তবতার সম্মিলন থাকে। তবে পার্থক্য এই যে উপন্যাসের কাহিনী পাঠকের কল্পনায় জীবন্ত হয় আর চলচ্চিত্রের কাহিনী পর্দার ভেতর থেকে মানুষের সামনে আসে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কল্পনার খেলাঘর থেকে বেরিয়ে মানুষ মুখোমুখি হয় রূপালী এক দুনিয়ার সামনে। কয়েকটি ঘন্টা বা মুহূর্ত তার চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, আবেগ আর স্বপ্নকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। তাই দারুচিনি দ্বীপ ছবিতে অয়নকে শেষ মুর্হূতে ট্রেনে উঠতে দেখে দর্শক যেমন হাততালি দেয়, তেমনি মনপুরায় পরীর মৃত্যুতে সোনাই এর আর্তনাদে তাদের চোখে পানি চলে আসে। আবার তারাই শত্রুর পরাজয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে। এভাবে যদি চলচ্চিত্র মানুষের জীবন দর্শন, ভাবনা, চিন্তাকে তাদের মনের মত করে সাজিয়ে দিতে পারে, নাড়িয়ে দিতে পারে তবে কি আর বায়োস্কোপের নেশা এত সহজে ছাড়ে...

বাংলাদেশ সময় ১২২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১২
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।