‘আমার ঘরের ঘুলঘুলিতে চড়াই পাখির বাসা/ ধুলোবালি আর খড়কুটো দিয়ে গোছানো সে সংসার/ আমি তাজ্জব বনে যাই দেখি মানুষের ঘর নাই/ দেখ মানুষের ঘরে বাসা বেধে নিল ছোট্ট এক চড়াই’ -- এমনই ব্যতিক্রমী কথা আর হৃদয়ছোঁয়া সুরই সায়ানের গানকে করে তুলেছে সুপরিচিত।
বর্তমান সময়ে জেনে-বুঝে আর শিখে যারা গান করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম কণ্ঠশিল্পী সায়ান ।
এসব গানের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, অন্ধকারের বিপরীতে আলোর দিশা অনুসন্ধান করে চলেছেন সায়ান। তার সব গানের কথাই মানুষের ভেতরের নিস্ক্রিয় বোধকে জাগিয়ে তোলে। গিটার আর হারমোনিকাতে যুগলবন্দী তার অনবদ্য পারফর্মেন্স। বেয়াদব জনতা, আমি তাজ্জব বনে যাই, দুচোখ দিয়েই দেখ, কতটা পথ পেরুলে, আয়বুড়ি, আমিই বাংলাদেশ- সহ আরো অনেক গানের জন্য তিনি ভক্তদের কাছে ভালবাসার শিল্পী। মানুষ হিসেবেও সায়ান সবদিক থেকে আগাগোড়া ভিন্নধর্মী। সম্প্রতি জনপ্রিয় শিল্পী সায়ানের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলানিউজ।
বাংলানিউজ : আপনার বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই?
সায়ান : আমার জন্ম কানাডার মন্ট্রিলে। ৭ মাস বয়সে মায়ের সাথে বাংলাদেশে চলে আসি। তখন থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত বাংলাদেশের আলো বাতাস গায়ে লাগিয়ে বেড়িয়েছি। এরপর টরেন্টোতে চলে যাই। কয়েকবছর পর আবার চলে আসি দেশে। বয়স ২৫ থেকে এখন ৩৫ পর্যন্ত বাংলাদেশেই আছি। সামনে কি হবে জানি না।
বাংলানিউজ : গানের শুরুটা কিভাবে?
সায়ান : বাবা মা দুজনের পরিবারই ছিল গান পাগল। বাবা খসরু ওয়াহিদ, চাচা ফেরদৌস ওয়াহিদ থেকে শুরু করে পরিবারের প্রায় প্রত্যেকেই গানের সাথে জড়িত। আমি ছোট থেকে মায়ের কাছে বড় হয়েছি। মায়ের পরিবারেও গানের চর্চা ছিল। পারিবারিকভাবেই গানের প্রতি ভালবাসার শুরু। আমি গানের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেইনি। এটাকে আমি নিজের জন্য সবসময় ভালই বলি। বিশেষ কোন গন্ডির ভেতর আটকে নেই, দ্বিধাহীনভাবে মন খুলে গাইতে পারি।
বাংলানিউজ : সময় হয়েছে নিজেকে সবার সামনে মেলে ধরার, এটা ঠিক কখন মনে হয়েছে?
সায়ান : একুশ বছর বয়সের পর আমি টরেন্টোটে থাকতে শুরু করি। শখ করে সেসময় বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠান নিজের গানগুলো গাইতাম। আস্তে আস্তে সেখানকার বাংলা কমিউনিটির অনুষ্ঠানেও ডাক পড়তে শুরু করল। পরিচিত অনেকেই গানের অ্যালবাম বের করতে অনুরোধ করলেন। বেশ উৎসাহ বোধ করলাম। দেশে আসার পর বয়স ২৫-৩২ পর্যন্ত পুরো ৭ বছর ধরে আমি চেষ্টা করেছি একটা অ্যালবাম দাঁড় করাতে। অবশেষে ২০০৮ সালে বের হল আমার প্রথম অ্যালবাম সায়ানের গান।
বাংলানিউজ : এ পর্যন্ত মোট কয়টা অ্যালবাম বের হয়েছে?
সায়ান : দুটো একক- ‘সায়ানের গান’ ও ‘স্বপ্ন আমার হাত ধরো’ আর একটি মিক্সড ‘জাস্ট ওয়াহিদ’। এই মিক্সড অ্যালবামটি আমাদের পারিবারিক প্রকাশনা। সেখানে আমার সাথে আছে ছোট ভাই এরশাদ এবং চাচাতো ভাই হাবিব ওয়াহিদ।
বাংলানিউজ : আপনার গানের শক্তিশালী অংশ হল গানের কথা। জীবনমুখী ধারার গান করতে উদ্বুদ্ধ হলেন কিভাবে ?
সায়ান : সেই ছোট থেকেই শাহনাজ রহমতুলাহ ছিলেন আমার আইডল। সেসময় তার গান গাইতে পারাটাই ছিল জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। বয়স ১৪ বছর থেকে নিজেই চেষ্টা করতে শুরু করি গান লেখার এবং সুর করার। সেসময় ট্রেডিশনাল প্রেম বিরহের অনুভূতি নিয়েই গান করেছি। এখনকার ধারাটা যদি জীবনমুখী হয় তাহলে বলব বয়স ২৫-এর পর থেকে সেই ধরণটা ভালবাসতে শুরু করেছি। চারপাশে যা দেখছি তাই নিয়েই গান করছি। জীবনমুখী বলেন আর গতানুগতিক বলেন সবই আসলে অনুভূতির গান। জীবনের নানা সময়ে অনুভূতির ধরণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। সেসবই উঠে এসেছে আমার গানে। জীবনের নানারঙের অনুভূতি নিয়েই আমার গান
বাংলানিউজ : দেশকে নিয়ে গাওয়া নিজের কোন গানটা প্রিয়?
সায়ান : নিজের কাছে সব গানই তো ভাল লাগে। তবে ‘মাটির সাথে দোস্তি’ এবং ‘ভয় পেয়ো না তুমি আমার জন্মভূমি’ গান দুটির জন্য একটু অন্যরকম ভাল লাগা কাজ করে।
বাংলানিউজ : ব্যক্তিগত অনুভূতি নিয়ে গাওয়া প্রিয় কোন গানের কথা জানতে চাই।
সায়ান : ‘ওঠ মন ওঠ না’, ‘মন আমার লজ্জা কি তোর’, ‘স্বপ্ন আমার হাত ধরো’- এই গানগুলো আমার নিজের মনের সাথে নিজেরই একান্ত কথা বলা। প্রতিটা মানুষকেই জীবনের একটা কঠিন সময় পার করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। সেই কঠিন সময় তাদেরকে ভীষণ কষ্ট দেয়। আমারও এমন হয়েছে। তখন কাছের বন্ধুদেরও বুঝে উঠতে পারতাম না। সময় এগিয়ে যেতে থাকলে কষ্টের অনুভূতি ক্রমশ কমে যেতে থাকে। কিন্তু কোথাও একটা দীর্ঘশ্বাস থেকে যায়। সেসময় নিজেই নিজের সাথে কথা বলেছি। কথাগুলোতে সুর দিয়ে সব দীর্ঘশ্বাস ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি। জীবনটাকে বুঝতে চেয়েছি। এভাবেই নিজের কথাগুলো একেকটা গান হয়ে উঠেছে।
বাংলানিউজ : আপনাকে কেন একজন ছোট্ট বালকের মত সাজে থাকতে দেখা যায়? পোশাক এবং সাজসজ্জা নিয়ে বলুন।
সায়ান : আমার পোশাক দেখলে অনেকেই ভাবে এই সাজসজ্জা বোধ হয় প্রতিবাদমূলক। আসলে বিষয়টা তা না। পুরোটাই আমার মানসিকতার সাথে জড়িত। ছোট থেকেই পোশাক আর সাজসজ্জার প্রতি আমার তিলপরিমাণ আগ্রহ ছিল না। মনে হত পোশাক পড়তে হবে লজ্জা নিবারনের জন্য তাই শালীন যে কোন পোশাক পড়লেই হয়। একটা সময় পর্যন্ত মা খুব অত্যাচার করেছেন পোশাক নিয়ে। যখন বড় হলাম, সিদ্ধান্ত নিতে শিখলাম, তখন থেকে আমি এভাবেই চলি। মেয়েদের বৈচিত্রময় পোশাক আমাকে কখনো টানতো না। আমি যে সেসব পছন্দ করি না, তাও কিন্তু না। কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে মা যদি বলতেন কি পড়ব, আমি একটাই অপশন দিতাম সেটা হল শাড়ি পড়। শাড়ির চেয়ে সুন্দর আর কোন পোশাক মেয়েদের আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু নিজের জন্য সেটা আমার পছন্দ ছিল না। আমার মনে হতো, আমার যে চেহারা এটাকে সুন্দর করার আর কিছু নাই। এই ভাল আছি। চেহারা-ছবি নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করতে চাইনা। বছরে মাত্র একবার দর্জ্জিবাড়ি যাই। কোন অনুষ্ঠানে যেতে ৫ মিনিটেই রেডি হতে পারি। ইদানিং আমার ছোট ভাইয়ের বাচ্চারা খুব জালাচ্ছে। ফুপি তুমি এইসব কি কালো কালো ড্রেস পড়! পচা লাগে! ওদের জন্য মাঝে মাঝে রঙিন পোশাক পড়তে হয়। তারপরেও ফতুয়া কিংবা পাঞ্জাবিতেই সীমাবদ্ধ থাকি।
বাংলানিউজ : আপনার পরিবারের কথা জানতে চাই।
সায়ান : আমি মায়ের সাথে থাকি। ছোট একটা ভাই আছে। আমার স্বামী জার্মানিতে থাকে। তিনি একজন সফ্টওয়্যার ডেভেলপার।
বাংলানিউজ : ব্যক্তিগত জীবনের টুকিটাকি নিয়ে বলুন?
সায়ান : আমি আইন নিয়ে পড়াশুনা করেছি। বিভিন্ন ল’ একাডেমিতে ক্লাস নেই। এছাড়া ফ্রিল্যান্সার হিসাবে কয়েকজন ব্যারিস্টারের আন্ডারে কাজ করি। একসময় একজনের প্রেমে পড়েছি, তাকেই বিয়ে করেছি। সেই প্রেম ছুটেও গেছে। এখন প্রেমের সেই আকর্ষণ আর নাই। প্রেমের আকর্ষণ আসলে থাকেও না সারাজীবন। আকর্ষণটা সংসারের জিনিসপত্রের মধ্যে ঢুকে যায়। নিজের মত স্বাধীনভাবে থাকি। ভাল আছি।
বাংলানিউজ : গান নিয়ে ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা?
সায়ান : তেমন কোন পরিকল্পনা নাই। বর্তমানে যে কাজ করছি তাই আমাকে ভবিষ্যতে টেনে নিয়ে যাবে। যা করছি তাই সুন্দরভাবে করে যেতে চাই।
বাংলাদেশ সময় ১৮১৫, জুন ১০, ২০১২
সম্পাদনা : বিপুল হাসান, বিভাগীয় সম্পাদক