ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

জুটি বেঁধে নাচতে হবে!

বিপুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১২
জুটি বেঁধে নাচতে হবে!

পারফর্মিং আর্টের অন্যসব শাখার মতোই আধুনিক নৃত্যেও জুটিপ্রথা বেশ সমাদৃত। উপমহাদেশের নৃত্যাঙ্গনে জুটি প্রথা প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন নৃত্যগুরু উদয় শংকর।

রাশিয়ান নৃত্যশিল্পী ব্যালেরিনা অ্যানা পাভলোভার সঙ্গে তিনি জুটি গড়ে তোলেন ১৯২৩ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের যুগলনৃত্য রাধা-কৃষ্ণ বেশ প্রশংসিত হয়। সেই থেকে শুরু। এরপর যুগে যুগে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছে কতো না ঝলমলে নৃত্যজুটি। এই ধারা আজও বহমান আছে আমাদের নাচের জগতে।

প্রথম প্রজন্মের নৃত্যজুটি

binodonভারতীয় উপমহাদেশে পন্ডিত উদয় শংকরকে আধুনিক নৃত্যকলার অন্যতম জনক বলা হয়। তিনিই রুশ-সুন্দরী ব্যালেরিনার সঙ্গে নান্দনিকভাবে নেচে যুগলনৃত্যের আলাদা আমেজ ছড়িয়ে দেন এক মঞ্চ থেকে আরেক মঞ্চে। ব্যালেরিনার সঙ্গে উদয় শংকরের নৃত্যজুটি অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। প্রায় বছর খানেক এই জুটি ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন পেশাদার রঙ্গমঞ্চে নৃত্যের ঝড় তোলে। উদয় শংকর সবচেয়ে সফল জুটি গড়ে তুলেছিলেন প্যারিসের পিয়ানোশিল্পী সিমন বার্বিং সিংকির সঙ্গে। । নৃত্যগুরুর কাছে নাচ শিখতে এসেছিলেন সিংকি। নেহাত ঝোঁকের বশে সিংকি আব্দার ধরেন গুরুর সঙ্গে নাচার। তারা জুটি বেঁধে নাচতে শুরু করার পর এতোই প্রশংসিত হলেন যে, বিভিন্ন দেশের রঙ্গমঞ্চ দাঁপিয়ে বেড়ান প্রায় ১০ বছর। এরপর জীবনের পড়ন্তবেলায় উদয় শংকর তার ভারতীয় ছাত্রী শ্রীমতি অমলার সঙ্গে গড়ে তোলেন আরেকটি সফল নৃত্যজুটি।   খণ্ডনৃত্যের পাশাপাশি বহু নৃত্যনাট্যে তারা জুটিবদ্ধ হয়ে নেচে ব্যাপক সাফল্য পান। নৃত্যজুটি থেকে একসময় তারা জীবনজুটিও হয়ে যান।

ভারতীয় আধুনিক নৃত্যের প্রথম যুগে সফলতা পেয়েছিলেন আরো বেশ কিছু জুটি। যাদের মধ্যে কুচিপুড়ি নৃত্যগুরু রাজা রেতি-রাধা রেতি, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ-শাশ্বতী সেন এবং বনশ্রী রাও-জয় রমারাও আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।

দেশীয় নৃত্যাঙ্গনে জুটিপ্রথা এলো যেভাবে

দেশীয় নৃত্যাঙ্গনে নৃত্যগুরু বুলবুল চৌধুরী সাফল্যের সঙ্গে জুটিপ্রথা যুক্ত করেন। বুলবুল চৌধুরীর কাছে নাচের তালিম নেন আফরোজা বুলবুল। এরপর তারা জুটি বেঁধে দেশ-বিদেশের বহু মঞ্চে নেচে ব্যাপক প্রশংসিত হন। একসময় তারা বিয়ে করেন এবং দেশে নৃত্যকলা বিকশিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত করেন বুলবুল ললিতাকলা একাডেমী। আজকের বহু প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পীই এই একাডেমী থেকে বেরিয়ে এসেছেন ।

দর্শকদের কাছে অভিনেত্রী হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগে প্রয়াত রওশন জামিল সুপরিচিত ছিলেন নৃত্যশিল্পী হিসেবেই। তার নৃত্যগুরু ছিলেন গওহর জামিল। পরিবারের অমতেই রওশন জামিল নৃত্যশিক্ষক গওহর জামিলের সঙ্গে নাচতে শুরু করেন। একদিকে দর্শকদের ব্যাপক প্রশংসা পায় এই নৃত্যজুটি, অন্যদিকে পারিবারিকভাবে বাঁধার মুখোমুখি হন রওশন জামিল। একসঙ্গে জুটি বেঁধে নৃত্য পরিবেশন চালিয়ে যেতে তারা একসময় জীবনসঙ্গী হয়ে যান।

স্বাধীনতার আগে এদেশের নৃত্যাঙ্গনে আরো কয়েকটি নৃত্যজুটি সুপরিচিতি পেয়েছিল। এসব নৃত্যজুটির মধ্যে অন্যতম হলো জিএ মান্নান-রাহিজা খানম ঝুনু , আলতামাস আহম্মেদ-শাহেদা আলতামাস,  রাহিজা খানম ঝুনু-দুলাল তালুকদার প্রমুখ। শুধু দেশ-বিদেশের মঞ্চেই নয়, ঢাকায় টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হলে উল্লেখিত নৃত্যজুটিরা জনপ্রিয় অনেক যুগলনৃত্য, খন্ডনৃত্য ও নৃত্যনাট্য উপহার দেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের নৃত্যজুটি

binodonস্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেন হাসান ইমান। তার সঙ্গে গড়ে উঠে পরপর কয়েকটি নৃত্যজুটি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত হাসান ইমাম-অঞ্জনা রহমান নৃত্যজুটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীতে অঞ্জনা চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় খুব বেশিদূর যেতে পারে নি এই জুটি। এরপর হাসান ইমাম জুটি গড়ে তোলেন নৃত্যশিল্পী জিনাত বরকতুল্লাহর সঙ্গে। প্রায় ১০ বছর ধরে এই জুটি দেশ-বিদেশের অসংখ্য স্টেজ শোতে পারফর্ম করেন। ২৫টি দেশে তারা পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে ব্যাপক খ্যাতি পান। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন।

নৃত্যে অসামান্য মেধা ও দক্ষতার অধিকারী হাসান ইমামের সঙ্গে আশির দশকের শুরুতে শামীম আরা নীপা গড়ে তোলেন চমৎকার একটি জুটি। অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তারা । একসঙ্গে নাচতে নাচতেই তাদের মন-বিনিময় হয়ে যায় । ১৯৮৩ সালে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের পর বছরখানেক তারা পারফর্মেন্স চালিয়ে যান ১৯৮৫ সালে দাম্পত্যজীবনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নৃত্যজুটিও ভেঙ্গে যায়।

আদর্শ ও সার্থক নৃত্যজুটি

বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনে সবচেয়ে দীর্ঘ ও আলোড়ন জাগানো নৃত্যজুটি শিবলী মুহম্মদ ও শামীম আরা নীপা। হাসান ইমামের সঙ্গে সংসার ও নৃত্যজুটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর শামীম আরা নীপা নাচতে শুরু করেন শিবলী মুহম্মদে সঙ্গে। সময়টা ছিল ১৯৮৫ সাল।   জনপ্রিয়তার দেখা পান। ১৯৮৯ সালে শিল্পকলা একাডেমীর আয়োজনে তারা ইতালির ৯টি শহরে ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ নৃত্যনাট্যটি পরিবেশন করেন। অনবদ্য যুগল পরিবেশনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের সুপরিচিত করে তোলে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ আমেরিকা, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ায় আমন্ত্রিত হয়ে এই নৃত্যজুটি নাচ পরিবেশন করেন। শিবলী মুহম্মদ আর শামীম আরা নীপা দুজনের মতেই, তাদের জুটির টার্নিং পয়েন্ট ছিল ইতালি সফর।   এরপর থেকে টিভিতে, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে, সরকারি-বেসরকারি আয়োজনে নৃত্যের ঝংকারে দেশ-বিদেশের মঞ্চ মাতিয়ে চলেছেন এ জুটি।

ব্যক্তিজীবনে নিটোল বন্ধুত্ব ধরে রেখে শিবলী মুহম্মদ ও শামীম আরা নীপা একসঙ্গে গঠন করেছেন নৃত্যাচর্চা প্রতিষ্ঠান নৃত্যাঞ্চল। এই প্রতিষ্ঠান থেকে নৃত্যের বিভিন্ন শাখায় তালিম নিচ্ছেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা।

এ সময়ের জনপ্রিয় নৃত্যজুটি

শিবলী-নীপা জুটির তুমুল সাফল্যের পর যুগলনৃত্যে সাফল্য পেয়েছে নাদিয়া-লিখন জুটি।   প্রায় একযুগ ধরে তারা জুটি বেঁধে নৃত্যপরিবেশন করে চলেছেন। নিঃসন্দেহে  নাদিয়া-লিখনকে এই সময়ের সেরা নৃত্যজুটি বলা যায়। টিভিতে, মঞ্চে, খণ্ডনৃত্যে, নৃত্যনাট্যে সবখানেই আছে এই জুটির উজ্জ্বল উপস্থিতি। সৌন্দর্য, পারস্পরিক বোঝাপড়া আর অভিব্যক্তির অনন্যতায় তারা জয় করেছেন দর্শকহৃদয়।

binodonনাদিয়া-লিখনের আগে নব্বুইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সোহেল রহমান-রিয়া জুটি। নৃত্যাঙ্গনের সর্বত্রই ছিল সোহেল-রিয়া জুটির উপস্থিতি। গ্ল্যামারাস এই জুটির সম্ভাবনার ইতি ঘটে বিয়ে করে রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাওয়ার পর। রিয়ার অনুপস্থিতিতে সোহেল রহমান বর্তমানে জুটি গড়ে তুলেছেন নবীন অভিনেত্রী ও মডেল শখের সঙ্গে। তবে এখনো এই জুটি সেইভাবে তাদের সাফল্য প্রমাণ করতে পারে নি।

দর্শকদের কাছে বর্তমানে নাদিয়া-লিখনের পরপরই পছন্দের নৃত্যজুটি হলো আনিসুল ইসলাম হিরু-চাঁদনী জুটি। বৈচিত্রময় পরিবেশনা দিয়ে তারা আলোচনায় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনে সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী হলেন সাদিয়া ইসলাম মৌ। নৃত্যশিক্ষক কবিরুল ইসলাম রতনের সঙ্গে তাকে বেশ কিছু  স্টেজ পারফর্মেন্সে অংশ নিতে দেখা গেছে। অনেক সম্ভাবনা থাকলেও করিরুল ইসলাম রতন- সাদিয়া ইসলাম মৌকে মাঝেমধ্যেই কেবল একসঙ্গে নাচতে দেখা যায়। নৃত্যপরিবেশনে এই জুটি অনিয়মিত হওয়ায় তাদের ঘিরে সেইভাবে ক্রেজ তৈরি হয় নি।

ওরা আসছে !

বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনের নবীনশিল্পীরাও  ইদানিং সিনিয়রদের দেখানো পথে হাটতে শুরু করেছেন। কারণ সিনিয়রদের দেখে তারা বুঝে জুটি বেধেঁ না নাচলে হালে পানি পাবেন না। নতুন প্রজন্মের বেশ কয়েকটি নৃত্যজুটি এরই মধ্যে আলোচনায় ওঠে এসেছেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইভান শাহরিয়ার সোহাগ-নিসা, ফারহানা চৌধুরী বেবী-আবদুর রশিদ স্বপন, আমিনুল ইসলাম মনি-ইলা, অনীক বসু-স্মিতা দে, শহীদুল ইসলাম বাবু-চিত্রা, তুষার-আনিকা, উপমা-রণবীর মুকুল-মুক্তি প্রভৃতি নৃত্যজুটি। এদের মধ্য থেকেই নিশ্চয়ই আমরা পাবো আগামী দিনের বিশ্ব  কাপাঁনো নক্ষত্রখচিত নৃত্যজুটি।

আজকের প্রজন্মের মেধাবী আর ঝলমলে নাচিয়েদের প্রত্যেকের মধ্যেই এখন এক আওয়াজ... জুটি বেধেঁ নাচতে হবে !



বাংলাদেশ সময় ০৭৫৫, এপ্রিল ২৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad