ঢাকা: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) মেরুদণ্ড সোজা করে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করার কথা বলেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। এছাড়া কালো টাকার প্রভাব রোধ, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, ইসি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব প্রদান ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীন আনার মতো পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
সোমবার (৬ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনের সম্মেলনে কক্ষে আয়োজিত এক সংলাপে প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ার প্রতিনিধিরা এমন পরামর্শ দেন।
দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ বলেন, আমি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করতে চাই যে, প্রত্যেকটা নির্বাচনী এলাকায় আমরা যদি একটা কমিটি করি একদম ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বাদ দিয়ে সামাজিক শক্তি যারা আছে, পেশাজীবী ধরেন, একটা এলাকার গণ্যমান্য শিক্ষক যারা, সবাই মুরুব্বি, যারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন; পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও তরুণদের নিয়ে যদি আমরা একটা কমিটি করি, সেই কমিটি নজরদারি করবে সবকিছুর। সবাইকে যদি এটার সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন তাহলে এটা একটা বড় বিষয় হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক আবু তাহের বলেন, নির্বাচন মৌসুমে কিছু কিছু গল্পকার দেখা যায় বিভিন্ন জেলায়। এই গল্পকাররা আমাদের শোনান আড়াই হাজার ভোট ৩৫ মিনিটে কাস্ট হয়ে গেছে। অথবা সারাদিন শুনলাম ৭ ভোটে আবু তাহের পিছিয়ে আছেন। অথচ সন্ধ্যায় ঘোষণা করা হলো, তিন হাজার ভোটে আবু তাহের জয়লাভ করেছেন। এই রূপকথাগুলো কারা শোনান। দুই ধরনের ভদ্র সন্তান এই গল্প শোনান, একজন হলেন ওসি, আরেকজন হলেন ডিসি। এই দুই ধরনের ভদ্র সন্তান নিয়ে যেন ইসি সজাগ থাকে।
তিনি বলেন, সিইসির পক্ষে আল্লাহ কাছে অনুরোধ করবো, হে আল্লাহ সিইসির হাতকে তুমি এমন শক্তিশালী করে দাও যেন ওই দুই ভদ্র সন্তানের টুঁটি চেপে ধরতে পারেন।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনটা কীভাবে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতাই ইসির ক্ষমতাকে নির্ধারণ করে। গত তিন টার্মে সেটাই হয়েছে। যে কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বা করা যায়নি।
তিনি বলেন, এই সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের সুযোগটা রয়েছে যে, তার ওপর কোনো অর্পিত দায়িত্ব নেই। যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের আগামী নির্বাচন করার ইচ্ছে নেই বা ক্ষমতায় আসার ইচ্ছে নেই। তাই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কোনো বাধা নেই। এখন যারা নির্বাচনে অংশীজন, তারা কীভাবে অংশ নেবে তার ওপর আগামী নির্বাচন নির্ভর করবে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মারুফ কামাল খান সোহেল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কাঠিন্য অবলম্বন করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে। আশা করি ভালো ভোট হবে।
দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, আগামী নির্বাচন যাতে কেউ বানচাল করতে না পারে, সেজন্য দৃঢ়তা দেখাতে হবে। সাংবাদিক নীতিমালা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এটা দয়া করে সংশোধন করুন। গণমাধ্যমকে শত্রু হিসেবে না নিয়ে সহযোগী হিসেবে দেখেন।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, প্রার্থীর হলফনামা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন এটা ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। এতে ভোটার এবং পুরো দেশের মানুষ ওই প্রার্থী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানতে পারবেন। সেই ব্যবস্থাটা উন্মুক্ত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।
দৈনিক খবরের কাগজের সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, মবের রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সেই জায়গাটার কোথায় বাধা। যারা বিগত তিনটা নির্বাচন করেছে, তারাই এবারও করবে। সেই আর্মি, সেই বিজিবি, সেই পুলিশ, সেই সাধারণ প্রশাসন। কাজেই সেই জায়গাটায় ইসির পক্ষ থেকে কঠিন বার্তা যেতে হবে।
জাগোনিউজ২৪.কমের সম্পাদক কেএম জিয়াউল হক বলেন, আচরণবিধিটা আরও একটু ক্লিয়ার করা দরকার। আচরণবিধি লঙ্ঘনে শাস্তি বা জরিমানা হয় এটা দৃশ্যমান পর্যায়ে এলে আচরণবিধি লঙ্ঘন কম হবে।
দৈনিক খবর সংযোগের প্রধান সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, আগাম প্রচার প্রতিরোধ করতে হবে। অনেকেই এখনই বিলবোর্ডে প্রচার চালাচ্ছে।
দৈনিক প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, এবারের নির্বাচনে বোঝা যাচ্ছে, অর্থ ও বলপ্রয়োগ অনেক হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দুর্বল, প্রশাসনের অবস্থা দুর্বল। এই অবস্থায় কতটুকু কী পরিমাণে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এ নিয়ে আশঙ্কা রয়ে গেছে।
দৈনিক আমার দেশের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ বলেন, ১২টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে গুটিকয়েক ছাড়া বাকি সব নির্বাচন বিতর্কিত ছিল। নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মেরুদণ্ড শক্ত করে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।
দৈনিক নয়াদিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী বলেন, ইসির প্রতি আস্থার জন্য সিইসি যে আশা ব্যক্ত করেছেন, এর জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় যেটা প্রশাসনের মধ্যে নিরপেক্ষ আচরণের আবহ তৈরি করা দরকার। টাকার ছড়াছড়ির বিষয়ে যদি ইসি নমুনামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে, তাহলে মেসেজটা চলে যাবে। কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেই মেসেজটা চলে যাবে। ঋণখেলাপি বা করখেলাপি যেন প্রার্থী না হতে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিলে ভালো ফলাফল আসবে।
ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল বলেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে নির্বাচন কমিশন সফল হবে।
দ্য ডেইলি স্টারের হেড অব নিউজ জিয়াউল হক বলেন, ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকরা প্রবেশ করে যেন কোনো বাধা ও হয়রানির শিকার না হন এবং তাদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়।
সারাবাংলাডটনেট-এর হেড অব নিউজ গোলাম সামদানী বলেন, অনেক সময় নির্বাচন কমিশন চাইলেও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি। পুলিশ সহায়তা করেনি। এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে রেখে নির্বাচন করতে হবে। এছাড়া একাধিক দিনে নির্বাচন করা যায় কিনা তা ভাবতে হবে।
দৈনিক ইত্তেফাকের রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। একইদিন নির্বাচন হলে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
প্রতিটি নির্বাচন অফিসে মাঠ পর্যায়ে অভিযোগ বক্স স্থাপনের গুরুত্বও তুলে ধরেন তিনি।
নির্বাচন কমিশন বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসির (আরএফইডি) সভাপতি কাজী এমাদ উদ্দীন (জেবেল) বলেন, যে মন্ত্রণালয়গুলো নির্বাচনের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত সেগুলো যদি ভোটের সময় ইসির অধীনে রাখা যেতো তাহলে নির্বাচন কমিশনের ভোট কনডাক্ট করা সহজ হতো। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অতীতে দুর্নীতি বা অন্য কোনো অভিযোগ নেই তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব বা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে।
সাংবাদিক নীতিমালা নিয়ে তিনি বলেন, আরএফইডির পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাবনা কমিশনকে দেওয়া হয়েছিল। কমিশন সেটি কী করেছে সেটা নিয়ে কোনো ফিডব্যাক এখনো দেয়নি। এ নিয়ে সভা হতে পারে। যে নীতিমালা করা হয়েছে সেটা বহাল থাকলে ভোটের খবর সংগ্রহ করা কঠিন হবে।
আরএফইডির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ইসি গণমাধ্যমকে বললেও অনেক সময় বৈষ্যম্যমূলক আচরণ করেন। প্রশ্ন করলে ক্ষেপে যান, অনেক সময় ফ্যাসিস্টও আখ্যা দেন।
পোস্টাল ব্যালট নিয়ে তিনি গণমাধ্যমকর্মী ও তাদের পরিবারকেও এর আওতায় আনার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে নিবন্ধিত অনেকগুলো দলকে সংলাপের বাইরের রাখার প্রশ্ন তুলে ভবিষ্যতে তাদের সভায় ডাকা হবে কি না জানতে চান।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজের সঞ্চালনায় সভায় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
ইইউডি/এইচএ/