ঢাকা: নির্বাচনকে কালো টাকার প্রভাবমুক্ত করতে প্রার্থীর পরিবর্তে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিজেই প্রচারের ব্যবস্থা করে দেবে। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের এক মঞ্চে এনে সভার আয়োজন, প্রার্থীদের ঘোষিত ইশতেহার বই আকারে প্রচার ইত্যাদি প্রক্রিয়ার দিকে যেতে চাচ্ছে সংস্থাটি।
সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা সংশোধন করে এই বিষয় যুক্ত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি খসড়া তৈরি করেছে ইসি সচিবালয়, যা বুধবারের (২১ মে) কমিশন সভায় অনুমোদন হলে বাস্তবায়ন হবে এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে হবে নির্বাচনী প্রচারণা। পরীক্ষামূলকভাবে ওই কার্যক্রম পরিচালিত হবে আটটি সংসদীয় আসনে। এক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসার/সহকারী রিটার্নিং অফিসার/কমিশনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্বাচনী প্রচারণার ব্যবস্থা নেবেন; প্রতীক বরাদ্দের পর পারস্পারিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশে রিটার্নিং অফিসার/সহকারী রিটার্নিং অফিসার একই মঞ্চে সব প্রার্থীদের উপস্থিতিতে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার/ঘোষণাপত্র এবং আচরণবিধি প্রতিপালনের ঘোষণা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এরপর প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতিহার/ঘোষণাপত্র পুস্তক আকারে প্রকাশ করবেন এবং প্রার্থীদের মধ্যে বিলি করার উদ্দেশে বণ্টন করবেন।
প্রার্থীদের নাম, ব্যানার/ফেস্টুন/লিফলেটে ছবি, মার্কা ও দল গ্রাম/পাড়া/মহল্লায়/ওয়ার্ড/ইউনিয়ন/উপজেলা/জেলা সদরে টানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণও করবেন।
এ ছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপজেলা সদর/ইউনিয়ন সদর/ওয়ার্ডভিত্তিক নির্বাচনী সভার মঞ্চ নির্মাণের ব্যবস্থা করবেন। নির্বাচনী প্রতীকের আদ্যক্ষরের ক্রমানুসারে প্রার্থীদের নির্বাচনী সভা করতে হবে। ক্ষেত্রমত একইসঙ্গে জনগণের সামনে তাদের ইশতেহার ও বক্তব্য পেশ করবেন। প্রচার ব্যয় সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার বা কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্ধারিত কোড/হিসাব নম্বরে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত হারে প্রার্থীরা টাকা জমা করবেন। যথানিয়মে খরচ পরবর্তী নিরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এবং উদ্বৃত্ত অর্থ সমহারে ফেরতযোগ্য হবে।
এ ছাড়া গ্রামভিত্তিক ভোটারদের ভোটের তথ্যাদি সম্বলিত ভোটার কার্ড/স্লিপ নির্বাচন কমিশন বিলি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রার্থীদের সম্ভাব্য জমাকৃত টাকাসহ নির্বাচনী ব্যয়ের একটি বাজেট রিটার্নিং অফিসার/কমিশনের কর্মকর্তা প্রস্তুত করবেন এবং তা অনুমোদনের জন্য কমিশনে পাঠাবেন। কমিশনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পাইলটিং আসনের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণার খাত, যেমন- ক. সভাস্থলে, খ. মাইকিং, গ. ব্যানার, ঘ. ফেস্টুন, ও. লিফলেট ইত্যাদি খাতের ব্যয় সম্বলিত বাজেট এবং একটি কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন করবেন এবং স্থানীয়ভাবে আইটেমভিত্তিক সেবা ক্রয়ের কার্যাদেশ প্রদান করবে।
প্রস্তাবিত বিধিমালা অনুমোদন হলে নির্বাচনে কোনো পোস্টারিং করা যাবে না। প্রচার শুরু হবে প্রতীক বরাদ্দের পর এবং ভোটগ্রহণ শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে তা বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনে ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার চালানো যাবে। এক্ষেত্রে কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট বা অন্য কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা পরিচালনা করতে পারবেন, তবে ওই ক্ষেত্রে প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট বা উক্ত ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ই-মেইল আইডিসহ অন্যান্য শনাক্তকরণ তথ্যাদি প্রচার-প্রচারণা শুরুর আগে রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করতে হবে।
ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণাকালে কারও ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি, কোনো ধরনের তিক্ত বা উসকানিমূলক বা মানহানিকর কিংবা লিঙ্গ, সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেওয়া, কনটেন্ট বানানো ও প্রচার করা যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে ডিজিটাল বা সাইবার সুরক্ষা আইনে শাস্তি হবে।
এদিকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ডে যোগ করতে পারবেন না বা কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচারণা করতে পারবেন না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী এলাকায়, সংশ্লিষ্ট জেলায় বা অন্য কোথাও কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা তার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচনী কাজে সরকারি প্রচার যন্ত্রের ব্যবহার, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের ব্যবহার বা সরকারি যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন না এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ বা ব্যবহার করতে পারবেন না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যতিত আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী বা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও বুঝাবে। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তার নির্বাচনী এলাকায় সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্তৃত্ব করতে পারবেন না কিংবা এতদসংক্রান্ত সভায় যোগদান করতে পারবেন না। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে আগে সভাপতি বা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বা মনোনীত হয়ে থাকলে বা কোনো মনোনয়ন প্রদত্ত হয়ে থাকলে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে তিনি বা মনোনীত ব্যক্তি ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো সভায় সভাপতিত্ব বা অংশগ্রহণ করবেন না অথবা ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো কাজে জড়িত হবেন না। নির্বাচনী প্রচারণা সময়কাল শুরু হওয়ার আগেই ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
এ ছাড়া সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজে প্রার্থী কিংবা অন্য কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট না হলে ভোটদান ব্যতিরেকে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ কিংবা ভোট গণনার সময় গণনা কক্ষে প্রবেশ বা উপস্থিত থাকতে পারবেন না। জাতীয় সংসদের কোনো শূন্য আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনকালীন কোনো সফর বা নির্বাচনী প্রচারণায় যেতে পারবেন না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নির্বাচনী এলাকায় ভোটার হলে তিনি কেবল ভোট দেওয়ার জন্য এলাকায় যেতে পারবেন।
এদিকে নির্বাচনকালীন অনিয়মের দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল প্রতিকার চেয়ে নির্বাচনী তদন্ত কমিটি বা কমিশন বরাবরে দরখাস্ত পেশ করতে পারবে। দরখাস্ত কমিশনের বিবেচনায় বস্তুনিষ্ঠ হলে কমিশন তা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট বা যেকোনো নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে পাঠাবে বা তাৎক্ষণিকভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা রিটার্নিং অফিসার বা প্রিজাইডিং অফিসার অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিতে পারবে।
এ ছাড়া কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচনকালীন এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। আবার নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হতে পারে এমন কোনো কাজ প্রার্থী বা তার এজেন্ট অথবা তাদের নির্দেশে বা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশে এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তদন্ত সাপেক্ষে কমিশন ওই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, নির্বাচনী আচরণ বিধিতে আমরা সব প্রার্থীর জন্য সমতা আনার কথা ভাবছি। এ ছাড়া বিধান না মানলে কঠোর শাস্তির বিধান আনতে চাচ্ছি।
ইইউডি/আরবি