ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ঈদ সংখ্যা

ঈদ আয়োজন

বসফোরাসে ভাসমান সন্ধ্যায় | ফারুক মঈনউদ্দীন

ভ্রমণ / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৪
বসফোরাসে ভাসমান সন্ধ্যায় | ফারুক মঈনউদ্দীন ছবি : লেখক

সন্ধ্যার জন্য বিখ্যাত বসফোরাস ক্রুজের বুকিং দিয়েছিলাম হোটেলের কাউন্টারে। ওরা জানালো ঠিক সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে ট্যুর বাস এসে হোটেলের লবি থেকে তুলে নিয়ে যাবে।

সুলতান হামেৎ-এর লা-লেলি অংশটাতে যে রকম ট্রাফিক-ব্যস্ততা দেখেছি, তাতে এ রকম কাঁটায় কাঁটায় সময় বেঁধে দেওয়া অবাক করা বিষয়ই বটে। আর আজ দুপুরে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে তুর্কিদের যা সময়ানুবর্তিতা দেখলাম, তাতে লা লেলির ভিড় না থাকলেও আমার সন্দেহ ঘুচত না। ইস্তাম্বুল যখন নামি তখন আমার পকেটে নগদ বিশ ডলার দিয়ে নেওয়া ই-ভিসা, যদিও অ্যারাইভাল ভিসা মেলে আমাদের জন্য, যদি পরবর্তী গন্তব্য ইউরোপ বা আমেরিকা হয়। ভাবি এই বিশ-ডলারি ভিসাটির জন্য আমাকে অ্যারাইভাল ভিসার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে না। কিন্তু যাকেই কাগজটি দেখাই সে-ই আমাকে দীর্ঘ সর্পিল এক মনুষ্যসারির দিকে পথ দেখায়। সারিটি হচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ার নাগরিকদের জন্য। অগত্যা লাইনের পেছনে দাঁড়ানোর প্রথম দিকে মোটামুটি গতি থাকলেও কিছুক্ষণ পর লাইন আর আগে বাড়ে না। মাথা উঁচিয়ে দেখি এতক্ষণ তিনটি ইমিগ্রেশন কাউন্টার চালু ছিল, এখন মাত্র একটি। সেখান দিয়ে হুইল চেয়ারের যাত্রী, ক্রন্দনরত শিশুকোলে মা এবং বৃদ্ধ দম্পতিসহ সবাই বিশেষ বিবেচনায় পার হয়ে যাচ্ছে, ফাঁকে ফাঁকে ডাক আসছে আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের। সেদিন ছিল শুক্রবার, ভাবলাম জুমার নামাজ পড়তে গেছেন বুঝি ইমিগ্রেশনের অফিসাররা, কিন্তু নামাজের সময় শেষ হওয়ার পরও দ্বিতীয় কোনো কাউন্টারে লোক আসে না। ভেতর দিক থেকে অফিসাররা গদাইলস্করি চালে এসে এদিক-সেদিক কোথাও যেন উধাও হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ শূন্য কাউন্টারগুলোর দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র করে না। তখন উপলব্ধি করতে পারি, মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্ককে ইউরোপের মতো আধুনিক করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের তুর্কি স্বভাব বদলাতে পারেননি। অথবা এশিয়া-আফ্রিকার নাগরিকদের জন্য এদের এমনই এ রকম হেলাফেলা অবস্থা।

শেষপর্যন্ত প্রায় আড়াই ঘণ্টার জিল্লতি পোহানোর পর ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলের রিসেপশনে এসে আরেকটা ঝামেলা বাঁধে। অ্যাগোডা নামের হোটেল বুকিং সাইটটির মাধ্যমে অগ্রিম ভাড়া মিটিয়ে এই হোটেলে রিজার্ভেশন করে এসেছি, অথচ কাউন্টারের লোকটি আমতা আমতা করে বলে, ইয়ে মানে, আমাদের এখানে সামান্য একটা সমস্যা হয়েছে, আপনাকে আমাদের ঠিক পাশের বিল্ডিংয়ে অন্য একটা রুম দেখাচ্ছি আরও বড়, দেখুন পছন্দ হয় কি-না।   একজন বেল বয় আমাকে পাশের বিল্ডিংয়ে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ির নিচে একটা বন্ধ রুম চাবি দিয়ে খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বলাবাহুল্য বেসমেন্ট ফ্লোরের ইঁদুরের অভয়ারণ্য বলে মনে হওয়া সেই বিকল্প আবাসনে রাজি না হয়ে আমি হোটেলের লবিতে ফিরে আসি। লোকটা আমার গনগনে চেহারা দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পারে বোধহয়। তার ধারণা সঠিক প্রমাণ করে একটা কঠিন ঝাড়ি দিলে আমাকে ঠিকই ভিজে বেড়ালের মতো এটা রুম দিয়ে দেওয়া হয়। বুঝতে পারি আমাকে অন্য জায়গায় পাঠাতে পারলে বুকিং কোম্পানির সস্তায় বুক করে রাখা রুমটি তারা হয়তো বেশি দামে কারও কাছে ভাড়া দেওয়ার ধান্দা করার কথা ভাবছিল। এখানেও তুর্কি স্বভাব নিয়ে আমার মনে আবারও একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে।

অতএব ঠিক সময়ে বাসটি এসে পৌঁছাবে সে ভরসা না থাকলেও ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ৭টা ৩৫ মিনিটে লবিতে নেমে দেখি দুপুরের সেই ছেলেটিই তখনও কাউন্টারে। চেক ইন করার সময় আমার সঙ্গে যে ঝামেলা করেছিল, ওর ভাব দেখে মনে হলো এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ওকে জিজ্ঞেস করলে জানায় যে কোনো সময় চলে আসবে বাস, বলে, আপনি বরং এখানেই অপেক্ষা করতে থাকুন। ইস্তাম্বুলে আসাটা এবার আমার ঘোড়ার জিন চাপিয়ে আসার মতো বলে লবিতে বসে না থেকে সামনের রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ইস্তাম্বুলের এই এলাকাটির চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টায় উঠে পড়ি আমি। ঘড়ির কাঁটা ৮টার ঘর ছুঁই ছুঁই করলে কাউন্টারে আবার খোঁজ নিতে যাই। রিসেপশনিস্টের সঙ্গে আমার কথাবার্তা শুনতে পেয়ে উলুক-ঝুলুক লং স্কার্ট পরা এক মধ্যবয়সী মহিলা এগিয়ে এসে বলে, ওহ, আমরাও তো অপেক্ষা করছি এই বসফোরাস ক্রুজের বাসের জন্য। ভালোই হলো, এই হোটেল থেকে পরিচিত একজন থাকবে আমাদের সঙ্গে। লবির কোনায় বসে শান্তশিষ্ট চেহারার এক লোক পত্রিকা পড়ছিলেন, মহিলা আমাকে সেদিকে নিয়ে গিয়ে বলে, ফাবলিস, ইনিও আমাদের মতো অপেক্ষা করছেন বাসের জন্য। ভদ্রলোক মুখের ওপর থেকে চশমা সরিয়ে আমাকে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ‘হাই’ বলেন। বোঝা যায় এই নৌবিহারে তার কোনো আগ্রহ নেই, কেবল বউয়ের কথায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হচ্ছে। পরিচয়পর্বে জানা গেল এই ফরাসি দম্পতি দু’জন দু’দিক থেকে এসে ইস্তাম্বুলে মিলিত হয়েছেন। ভদ্রলোক, ফাবলিস উজোলো, ব্যবসার কাজে দেশ-বিদেশ ঘোরেন, এবার সেই সুযোগে তার বউ সোফি ইস্তাম্বুলে এসে পাকড়াও করেছেন স্বামীকে। সোফি উজোলো একজন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট, তার মাধ্যম মূলত মেটাল, আর বিষয় ওয়াইল্ড লাইফ। ছোটবেলা থেকে আফ্রিকায় থাকার কারণেই বোধহয় ওয়াইল্ড লাইফ ওর প্রিয় বিষয়। ফ্রান্সের কানে বিভিন্ন গ্যালারিতে তার শিল্পকর্মের কয়েকটা প্রদর্শনীও হয়েছে। ভদ্রমহিলা ফোনের ক্যামেরায় তোলা তার কয়েকটা শিল্পকর্মের ছবি দেখিয়ে আমার মুখের দিকে নিবিড় মনোযোগে তাকালে আমি শিক্ষকের সামনে পড়া না শেখা ছাত্রের মতো ওর দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রবল  আগ্রহে ফোনের স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়ি। সেখানে মেটালের ওপর হাতি, বাঘ, পান্ডা— এসবের খোদাই করা ছবি। আমি শিল্পকর্মের কী বুঝি, তবুও সমঝদারের মতো প্রশংসাসূচক মাথা নাড়াতে হয়। কিছু একটা বলতে হয় বলেই বলি, বাহ, এ রকম কাজ তো আগে দেখিনি  কখনও। সোফি শিল্পের এই মাধ্যমটি সম্পর্কে আরও কিছু প্রসঙ্গ তুলে আমাকে চরম সঙ্কটে দিতে ফেলে দেওয়ার ভূমিকা শুরু করতেই হোটেলের ডোরম্যান জানায় বাস এসে গেছে।

** পুরো ভ্রমণ ই-ম্যাগাজিনে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ঈদ সংখ্যা এর সর্বশেষ