ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ঈদ সংখ্যা

ঈদ আয়োজন

আঁধার যুগের ইতিকথা | মঞ্জু সরকার

উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৪
আঁধার যুগের ইতিকথা | মঞ্জু সরকার অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ধর্মপুর ছিল শহর-সভ্যতা থেকে একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। পাদদেশে প্রমত্ত তিস্তা নদী এবং অন্য তিনদিকেও সেই নদীরই শাখা-প্রশাখা আরও কিছু ছোট নদী ও খাল।

এখনকার যুগে যেমন পাকা রাস্তায় অসংখ্য সেতু-কালভার্ট, পঞ্চাশ বছর আগের দৃশ্যপট মোটেও সে রকম ছিল না। বড় নদী পেরোনোর জন্য খেয়ানৌকা ছিল অবশ্য, আর ছোট নদী ও খালের ওপরে ছিল বড় জোর বাঁশের সাঁকো। অধিকাংশ বাঁশসেতুর প্রশস্ততা ছিল পায়ের তলার চেয়েও কম। ধর্মপুর থেকে জেলা শহরে যাওয়ার ডিস্ট্রিক বোর্ডের কাঁচা রাস্তাটায় সারারাত তো বটে, দিনের বেশিরভাগ সময় সুনসান নির্জনতা। শুকনো মৌসুমে কয়েক ইঞ্চি পুরু ধূলার আস্তরণ। বাতাসে ধূলি উড়ে রাস্তার দু’পাশের জংলি গাছপালা ও লতাগুল্মের সবুজ শরীর সাদা হয়ে যেত। বর্ষাবৃষ্টিতে গা ধুয়ে সেগুলো আবার সবুজ-সতেজ হয়ে উঠত অবশ্য, কিন্তু রাস্তাটায় কাদাপানি জমত যত্রতত্র। সেই সময়ে রাস্তায় যানবাহন বলতে ছিল গরু কিংবা মোষে টানা গাড়ি। সুবিধাপ্রিয় ভদ্দরলোকদের বাহন ছিল প্যাডেল ঘোরানো দ্বিচক্রযান। জেলা শহরে যাওয়ার সময় বাঁশের সাঁকোতে সাইকেল ও পায়ের জুতা-স্যান্ডেলও তাদের ঘাড়ে উঠত।
ডিস্ট্রিক বোর্ডে কাঁচা রাস্তাটায় সব সেতু ও কালভার্ট পাকা হয়ে যাওয়ার পর ধর্মপুরে প্রথম মোটরগাড়ি যেদিন তিস্তার মুখ পর্যন্ত আসে, সেটা ছিল সম্ভবত ধর্মপুরের বিচ্ছিন্নতা ঘোষণার, এবং একই সঙ্গে আমাদের এ কাহিনীর নায়ক ড. মাসুদুল হক পাটোয়ারির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রথম বড় ধরনের ঘোষণা।
মাসুদ তখন প্রাইমারিতে পড়া গেঁয়ো বালক। বাড়ির কাজের মেয়ে সমবয়সী ধানকন্যা অঞ্জনি তাকে উত্তেজিত হয়ে প্রথম খবরটা দেয়, ‘পাগলা হাতি বারাইছে। হাতির পিঠে আজাও আছে। সবই দেখতে গেইছে, চল হামরাও যাই। ’
ডিস্ট্রিক বোর্ডের কাঁচা রাস্তায় প্রথম ধূলি ওড়ানো মোটরযান দেখতে ছোটরা তো বটে, ধর্মপুরের বয়স্ক গেরস্ত-চাষিরাও ছুটতে শুরু করেছিল। যান্ত্রিক যানটি প্রথমে ধর্মপুর হাটের কাছে থামায় গাড়ির ভেতরে সাদা চামড়ার একজন বিদেশি আরোহীকে দেখেছে যারা, কিন্তু চিনতে পারেনি, তারাও আরও ভালো করে দেখা ও জানার কৌতূহল নিয়ে গাড়ির পেছনে ছুটছে। গাড়ি দেখা ছাড়াও মোটরগাড়ির তিস্তা পেরোনোর ক্ষমতা দেখা এবং সাহেবের গন্তব্য জানতেও কৌতূহলী মানুষ গাড়ির পেছনে ছুটছে।
অঞ্জনির পিছে ছুটতে ছুটতে রাস্তায় মোটর জিপের ওড়ানো ধূলিঝড় দেখে প্রথম। ধূলি উড়িয়ে কালো রঙের জিপটি যে আসলে হাতি নয়, সেটা তখন পর্যন্ত মোটরযান বা হাতি না দেখার কারণেই বালক মাসুদ বা অঞ্জনির বুঝতে দেরি হয়। ধূলির মধ্যে মিশে থাকা পোড়া পেট্রলের গন্ধ এবং নৈঃশব্দ ছিঁড়ে অদ্ভুত এক গোঁ-গোঁ আওয়াজে মেতে ছোট-বড় সবাই গাড়ির পেছনে ছোটে। পাগলা কুকুর কি শেয়ালকে মারার জন্য গাঁয়ের মানুষ যেভাবে হইহই করে ছোটে, অনেকটা সেরকম আওয়াজও দিচ্ছে কেউ কেউ। মাসুদ ও অঞ্জনিও নিঃশব্দে ছোটে।
তিস্তার ধু-ধু চর দেখে ডিস্ট্রিক বোর্ডের সড়কটা হঠাৎ বটগাছ তলায় কুচিয়া মাছের গর্তে ঢোকার মতো মুখ লুকিয়েছে যেখানটায়, জিপগাড়িটি সেখানে গিয়ে থামে। গাড়ি থেকে নামে সাদা চামড়ার এক আশ্চর্য মানুষ। তার চোখে কালো চশমা, মাথায় হেট, হাতে পাইপ, যাকে বিদেশি হুঁকা বলে শনাক্ত করে গাঁয়ের লোক।
আগন্তুক বিদেশি চর দেখে, নদী খোঁজে এবং চারপাশের ভিড়ও দেখে। কথা বলতে পারে না বোধহয়। হেসে অঙ্গভঙ্গির ইশারায় ভিড়কে কী যেন বোঝাতে চায়।
গাঁয়ের সাহসী ও দুষ্টু চ্যাংড়ার দল, যারা জিপ গাড়িটি টিপেটুপে এবং বুক ভরে পেট্রলপোড়া গন্ধ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, পাগলা হাতি নয় মোটরগাড়ি আসলে, তারাও এবার গাড়ির আরোহী সাহেবের প্রতিও কৌতূহলী হয়ে ওঠে। নিজেরাও বানর-বিড়াল কি কুত্তা হয়ে নানারকম ভঙ্গি ও আওয়াজ করতে শুরু করে। । হাস্যরোল ওঠে ভিড়ের মধ্যে।
হাস্য-পরিহাস উপেক্ষা করে ধর্মপুরের সত্যসন্ধানী বয়স্করা বলতে শুরু করেছিল : ব্রিটিশরা না দেশ ছাড়ি চলি গেইল বাহে, ফের ইংরেজ আসিল কোণ্ঠে থাকি... ইংরাজ না হয়, পাকিস্তানি পাঞ্জাবি মনে হয়... আরে বাঙালি ডাইভারের কাছে শোনেন... বিদেশি আমেরিকান সাহেব... নদী দেখতে এসেছে... তিস্তার উপর একটা বাঁধ হইবে... চরের নদীভাঙা মানুষকে সাহায্য দেবে।
বড়দের নানারকম কথাবার্তার মধ্য দিয়ে কাছাকাছি বাড়ির এক কৃষক সাহেবের বসার জন্য একটি হাতলভাঙা চেয়ার এনে দেয়। খাওয়ার জন্য গাছের দুটি ডাব আর পান-সুপারির বাটাও আনে একজন। সাহেব ডাব খায়, কয়েকজন পান খাওয়া শিখিয়ে দেওয়ার পর সুপারি ও বোঁটাসহ ছাগলের মতো চিবিয়ে খায়। তার খাওয়া দেখেও হাসে অনেকে।
জীবনে প্রথম সাদা চামড়ার সাহেবকে দেখে সাহস সঞ্চয় করে বালকদের মধ্যে অবশেষে মাসুদই তার সামনে এগিয়ে যায় প্রথম। নিজের সামান্য ইংরেজি জানা বিদ্যা প্রয়োগ করে জানতে চায়, হু আর ইউ? হোয়াট ইজ ইওর নেম অ্যান্ড কান্ট্রি? এত বড় ভিড়ের মধ্যে একমাত্র বালকের কণ্ঠে ইংরেজি শুনে সাহেবটি অবাক এবং খুশিও হয়। মাসুদকে কাছে টেনে যা জবাব দেয়, মাসুদ তার কিছুই বুঝতে পারে না।
কিন্তু যা বোঝার বুঝে যায় গ্রামের লোকজন। বালকটির পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সাদা চামড়ার ইংরেজ সাহেবের সঙ্গে ইংরেজিতে টক্কর দেয়া কি যা তা কথা! মাসুদকে যারা চিনত, তারা গর্বিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে চেনায় এবং সাহেবকেও চেনানোর চেষ্টা করে। ধর্মপুরের মাথা মেহের পাটোয়ারির নাতি, এয়াকুব হেডমাস্টারের ছেলে। বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া।

** পুরো উপন্যাস ই-ম্যাগাজিনে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ঈদ সংখ্যা এর সর্বশেষ