ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

রাজনীতির কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা

আল-আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪
রাজনীতির কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা

ঢাকা: দেশের সহিংস রাজনীতির কবলে পড়ে স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষ করে গত বছর (২০১৩) দেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় দেশের শিক্ষা খাত বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

একই সঙ্গে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক নেতাদের সংবর্ধনায় শিক্ষার্থীদের ব্যবহারেও উদ্বিগ্ন তারা।

২০১৩ সালের পুরোটা জুড়েই নির্দলীয় তত্ত্বাধায়ক সরকারের দাবিতে হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট (বর্তমানে ১৯ দল)। এর ফলে একাধিকবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি), জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসির মতো দেশের সর্বৃহৎ পাবলিক পরীক্ষাগুলো বাঁধার সম্মুখীন হয়।

২০১৩ সালের শুরুতে ৩ ফেব্রুয়ারির মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এসএসসি) এবং এপ্রিলের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার (এইচএসসি) সময় একাধিকবার হরতাল আহবান করে বিরোধী দলীয় জোট। এর ফলে এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ৩৩টির অধিক বিষয়ের পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখ বারবার পরিবর্তন করতে হয়।

একই ভাবে গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে জুনিয়র জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও হরতাল-অবরোধের কারণে তা দুই দিন পিছিয়ে ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয় এবং পরীক্ষা ২০ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা নির্ধারিত সময়ের বেশ কয়েকদিন পরে শেষ হয়।

অপরদিকে দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ২০ নভেম্বর শুরু হয়ে ২৮ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হয় ৬ ডিসেম্বর।

হরতাল এবং অরোধের কারণে বার বার পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব পরীক্ষা শেষ করার জন্য একই দিনে একাধিক পরীক্ষা নিতে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। এছাড়া বছরজুড়ে সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বিভিন্ন সময়ে স্কুল-কলেজের ক্লাস বন্ধ রাখতে হয়। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অধিকাংশ স্কুল এবং কলেজকেই শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট সিলেবাস শেষ না করেই পরীক্ষা নিতে হয়।

আবার সিলেবাস ও পরীক্ষা শেষ করার জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটির দিনগুলোতে ক্লাস এবং পরীক্ষা নিয়েছে।

অভিভাবকদের অভিযোগ, বার বার পরীক্ষা পেছানোর কারণে তাদের সন্তানদের ফলাফল তুলনামূলক খারাপ হয়েছে।

এছাড়া বছরের শেষ সময় নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত স্নাতক ১ম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু রাজনৈতক পরিস্থিতির কারণে এখন পর্যন্ত দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি।

রাজধানীর উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাহির সাদমান গত বছর জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সে বাংলানিউজকে বলেছে, পরীক্ষার মধ্যে হরতাল-অবরোধ থাকায় আমাদের নির্ধারিত তারিখের বেশ কিছু পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। এতে করে আমরা যে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম তা পিছিয়ে যায়। ফলে আমাদের পরীক্ষা দিতে সমস্যা হয়েছে।

একই স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র মেহরাব খান বাংলানিউজকে বলেছে, হরতাল-অবরোধের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় ক্লাস হয়নি। ফলে আমাদের শিক্ষকরা যেভাবে সিলেবাস শেষ করতে চেয়েছিলেন, তা পারেননি। তাই আমাদের পরীক্ষার ফলাফল তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়েছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জিনিয়া রহমান বাংলানিউজকে বলেছে, অনেক সময় আমাদের একই দিনে দুইটি পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আবার ডিসেম্বরে পরীক্ষা দ্রুত শেষ করে বেড়াতে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তা পারিনি।

আব্দুল কাদির নামে একজন অভিভাবক বলেন, আমার ৩ মেয়ে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ছে। মেজো মেয়ে এবার পিএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। পরীক্ষায় সে ফলাফল ভালো করলেও বেশ কয়েকবার পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার কারণে তাকে পড়তে বসাতে সমস্যা হতো।

শাহরিন আক্তার নামে ৪র্থ শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাজমা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ থাকলে আমার মেয়ে শুধু বলতো ‘হরতাল অবরোধ কেন দিচ্ছ? এসব না থাকলে দ্রুত পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো’।

ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জু আরা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, গত বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমরা ঠিতমতো ক্লাস-পরীক্ষা নিতে পারিনি। ক্লাস-পরীক্ষা সঠিকভাবে না হলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়ে এবং তাদের লেখাপড়ায় ঘাটতি থেকে যায়। তবে আশা করছি, এ বছর আর এমন কোনো সমস্যা হবে না এবং রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে কর্মসূচি দেবে।

এছাড়া গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আবার নির্বাচনের পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজয়ী দলের মন্ত্রী-সাংসদদের সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়।

ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সংবর্ধনা দেওয়ার নামে যারা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে আমি তাদের দারুণভাবে তীব্র নিন্দা জানায়। এই নিন্দা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রাজনীতিবিদদের উচিত কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার না করা। তাছাড়া এসব কাজে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার না করতে বতর্মান সরকারেরই নির্দেশনা রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ক্ষতি প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি বছরের শেষ সময় শিক্ষাক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত বছরও নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে দুইটি পাবলিক পরীক্ষা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং বিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক পরীক্ষা ছিল। কিন্তু এ সময়ে বিরোধী জোট সহিংস কর্মসূচি দেওয়ার কারণে ছাত্র-শিক্ষক সবারই ক্ষতি হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা অব্যহতভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার যে কাজ করে যাচ্ছি বিরোধী দলের সহিংস কর্মসূচির কারণে তা বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে ৫৮৫টি বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের চোখের সামনে হরতাল-অবরোধে মানুষ পুড়তে দেখেছে। এতে তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, এসব কর্মকাণ্ড শিশুদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করেছে। আমরা হয়তো তাদের শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু তাদের মানসিক ক্ষতি পোষাতে আমাদের দীর্ঘ সময় লাগবে।

তিনি আরও বলেন, আমি আশা করি, আমাদের বিরোধী দল এটা উপলব্ধি করবে এবং আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত-শিবির থেকে দূরে থাকবে।           

বাংলাদেশ সময়: ০০২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।