ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সংকট কাটছেই না

শাহীন রহমান, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১২
পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সংকট কাটছেই না

পাবনা: সংকট কাটছেই না ১১৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের। দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না শিক্ষার সুযোগ সুবিধা।

ফলাফলের দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে থাকলেও শিক্ষক, কর্মচারি, আবাসন, পরিবহন সংকটের মধেই চলছে এর শিক্ষা কার্যক্রম।

কলেজ সূত্র জানায়, ১৮৯৮ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠা হয় এ কলেজ। ১৯৫৪ সালে ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। জাতীয়করণ হয় ১৯৬৮ সালে। ১৯৫৪ সালে অনার্স কোর্স চালু হয় আর মাস্টার্স কোর্স চালু হয় ১৯৯৫ সালে।

বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২২ হাজার ৬১৩। এর মধ্যে ডিগ্রি পাশ কোর্সে ৪ হাজার ৮৩৩, অনার্স কোর্সে ১৪ হাজার ৯২৫ এবং মাস্টার্সে ২ হাজার ৮৫৫ জন।

স‍ূত্র আরও জানায়, বর্তমানে কলেজটিতে ১৭টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে। আর মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে ১৫টি বিষয়ে।

অনার্স কোর্স চালু আছে- বাংলা, ইংরেজি, দর্শন, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, মার্কেটিং, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদ বিদ্যা ও প্রাণী বিজ্ঞান।

১৭টি বিষয়ের মধ্যে ১৫টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। শুধুমাত্র ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিং এ মাস্টার্স কোর্স চালু নেই।

আসন সংকটের কারণে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থীই অনার্সে ভর্তি হতে পারেন না।

তথ্য অনুযায়ী বিষয় ভিত্তিক আসন সংখ্যা হচ্ছে, বাংলায় ২২৫, ইংরেজিতে ২৩০, দর্শনে ২২০, ইতিহাসে ২৫০, ইসলামে ইতহাস ও সংস্কৃতিতে ২৪০, অর্থনীতিতে ২৭০, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ২৭০, সমাজ বিজ্ঞানে ২৭০, হিসাব বিজ্ঞানে ৩০০, ব্যবস্থাপনায় ৩০০, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং এ ৬৫, মার্কেটিং এ ৬৫, পদার্থ বিজ্ঞানে ১১০, রসায়নে ১৪০, গণিতে ১১০, উদ্ভিদ বিদ্যায় ১৬০ ও প্রাণী বিজ্ঞানে ১৩০।

হিসাব বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বাদে সব বিষয়ে আসন সংখ্যা কমপক্ষে ৩০০ করা জরুরি বলে মনে করছেন শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ফিন্যান্স ও মার্কেটিং বিষয়েও ৬৫টি আসনের জায়গায় অন্তত: ২৫০ আসন প্রয়োজন।

অপরদিকে কলেজে বেশকিছু শিক্ষক-কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। এতে করে শিক্ষা ও দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

কলেজের প্রধান সহকারী বাবুল আখতার বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে শিক্ষক আছেন ১২০ জন। ৪৩ জনের পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে অধ্যাপক ১, সহযোগী অধ্যাপক ১০, সহকারী অধ্যাপক ৯ এবং ২৩ প্রভাষকের পদ শূন্য আছে।

এছাড়া তৃতীয় শ্রেণীর ১১ পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৩ জন। আর চতুর্থ শ্রেণীর ২০ পদের মধ্যে শূন্য আছে ৭টি। কলেজের কলেবর, বিষয়, ছাত্রছাত্রী বৃদ্ধি সবকিছু মিলিয়ে নতুন কোনো কর্মচারির পদ সৃষ্টি করা হয়নি।

কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. নাইদ মো. শামসুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, “শিক্ষক সংকটে পাঠদানে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি শিক্ষক সংকট সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। এ বিভাগে আছেন মাত্র ২ জন শিক্ষক। একজনের পদোন্নতি হয়ে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে বদলি হয়ে যাবেন। এ বিভাগের পাঠদান কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা শিক্ষক সংকটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার জানিয়েছি। ”

কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মো. বজলুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “আরবী ও ইসলাম শিক্ষা বিভাগের অনুমোদন থাকলেও অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু হয়নি শিক্ষক সংকটের কারণে। বিভাগটি চালু হলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবেন। ”

অপরদিকে কলেজে আরও তিনটি বিষয় (ভূগোল, মনোবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান) অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

কলেজের পরিবহন সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২২ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে এক হাজারের মতো থাকেন কলেজের ৫টি ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসে। আনুমানিক ১০ হাজার শিক্ষার্থী শহরের বিভিন্ন মেসে ও আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করছেন। বাকি ১১ হাজার শিক্ষার্থী প্রতিদিন জেলার ৮টি উপজেলা থেকে কলেজ বাস ও পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন।

এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য আছে কেবল ৪টি বাস। জেলার সাঁথিয়া, সুজানগর, ঈশ্বরদী, পাকশী, চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া রুটে ডাবল শিফটে শিক্ষার্থী পরিবহন করছে বাসগুলো।

বাসে যাতায়াতকারী বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আরিফ আহমেদ, রিপন মাহমুদ, দর্শন বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র সুমন হোসেন, তৌসিক আহমেদসহ অন্যরা বাংলানিউজকে জানান, বাসগুলোতে আসন সংখ্যাও কম। ছাত্রীদের জন্য আলাদা কোনো বাস নেই। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের একই বাসে যাওয়া আসা করতে হয়।

তারা জানান, সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্য দিয়েই রীতিমতো যুদ্ধ করে বাসে যাতায়াত করতে হয়। আর কোনো কারণে বাস নষ্ট হলে তো এ দ‍ুর্ভোগের আর শেষ নেই।
তাদের দাবি, কমপক্ষে আরও দুটি বাস চালু করার।

এ বিষয়ে কলেজের প্রধান হিসাব সহকারী বাবুল আখতার বাংলানিউজকে জানান, একটি নতুন বাস কেনার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঝুলে আছে নতুন বাস কেনার প্রক্রিয়া।

কলেজের অন্যতম একটি সমস্যা আবাসন (হোস্টেল) সংকট। বর্তমানে কলেজে হোস্টেল আছে ৫টি। এর মধ্যে দুটি ছাত্রী হোস্টেলের গোপী সুন্দরী দাসী হলের আসন সংখ্যা ৮০ ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ২০০।

অপরদিকে তিনটি ছাত্র হোস্টেল, শহীদ শামসুজ্জোহা মুসলিম হলে ২৫০, কামাল উদ্দিন হলে ১৫০ এবং গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী হলে ৮০ আসন। এ ৫টি হলের ৭৬০ আসনের বিপরীতে দিগুন সংখ্যক শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে অবস্থান করেন।

হলে থাকা শিক্ষার্থীরা জানান, কিছুই করার নেই। কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে। হোস্টেলের বাইরে মেসে থাকতে গেলে অনেক খরচ। ঝামেলাও অনেক। কলেজে অন্তত: ৩-৪টি হোস্টেল নির্মাণ করা দরকার।

দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর একেএম নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বড় কলেজ হিসেবে পানির তেমন কোনো সংকট নেই। তবে টয়লেটের কিছু সমস্যা আছে উল্লেখ করে তিনি জানান, আগামীতে হয়তো এ সমস্যা আর থাকবে না।

কলেজের বিনোদন ব্যবস্থা সম্পর্কে কলেজ স‍ূত্র জানায়, বিনোদনের জন্য রয়েছে ১টি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ১টি ব্যায়ামাগার, ৩টি খেলার মাঠ ও ১টি মিলনায়তন।

এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজে বিনোদনমূলক প্রতিযোগিতার কোনো আয়োজন হয় না। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেও বিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ করেন তারা।

এ বিষয়ে পাবনা জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “আমরা সমস্যাগুলো নিয়ে একাধিক মিটিং করে সমাধানের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু তেমন কোনো বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ”

একটি বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান করা যেতে পারে বলে মনে করেন জেলা প্রশাসক।

পাবনার প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ নুরুন্নবী বাংলানিউজকে জানান, কলেজে একটি স্বাধীনতার ভাস্কর্য নির্মাণ হলে এর ঐতিহ্য, সুনাম ও সৌন্দর্য আরো বাড়বে।

নানাবিধ এসব সংকট নিরসনের পাশাপাশি স্বাধীনতার ভাস্কর্য নির্মাণে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে এ সরকার। এমনটাই প্রত্যাশা জেলাবাসীর।

বাংলাদেশ সময়: ২২০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১২
সম্পাদনা: আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।