ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

পঞ্চমুখি সংকটে খুলনা সিটি কলেজ!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১২
পঞ্চমুখি সংকটে খুলনা সিটি কলেজ!

খুলনা: ১৯৬৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য মরহুম এসএমএ মজিদ সাহেবের বাসভবনে বসে ‘দি খুলনা সিটি কলেজ’ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯৬৫ সালের ১ জুলাই কলেজটি যাত্রা শুরু করে।



১৯৬৮ সালে এসএমএ মজিদ ইন্তেকাল করেন। কলেজ পরিচালনা পরিষদ তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কলেজটি ‘মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ’ নামকরণ করে। ১৯৯৩ সালে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়।

কলেজটিতে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণিতে ৩ হাজার ১শ ৬৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক প্রফেসর আহমেদুল কবীর চাইনিজ বাংলানিউজকে জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কলেজটি ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে খুলনা বিভাগ ও যশোর বোর্ডের মধ্যে ১ম অথবা ২য় স্থান অধিকার করেছে।

এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণিতেও এ কলেজের শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করছে।  

তিনি আরও জানান, বর্তমানে কলেজটিতে প্রচণ্ড শিক্ষক সংকট রয়েছে। বিশেষ করে সমাজকল্যাণ বিষয়ের কোনো শিক্ষক নেই। তাছাড়া পদার্থ ও বাংলা বিষয়ে একজন করে শিক্ষক রয়েছেন।

কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর অবণী ভূষণ নাথ বাংলানিউজকে জানান, কলেজটিতে ৪৯ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র ৩৭ জন, যার কারণে প্রায় বিষয়ে অতিথি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নেওয়াতে হচ্ছে।

তিনি জানান, কলেজের ছাত্রছাত্রীর তুলনায় ক্লাসরুমে বসার জায়গা কম। ফলে, অনেক শিক্ষার্থী বসতে না পেরে ক্লাস করেনা। তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যার সমাধানের জন্য বার বার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করার পরও সমাধান হয়নি। ’

এদিকে, শিক্ষার্থীরা এসব সংকট ছাড়াও বাংলানিউজকে জানিয়েছেন পঞ্চমুখি সংকটের কথা।

দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ভালো ফলাফলের জন্য তিনি বাগেরহাট থেকে এসে এখানে ভর্তি হয়েছেন। কলেজে ছাত্রী হল না থাকায় তাকে মেসে থাকতে হচ্ছে।

তিনি জানান, বিভাগের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের মেধাবী ছাত্রীদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছাত্রী হল না থাকায় অনেক অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের এ কলেজে ভর্তি করছেন না।  

একাদশ শ্রেণির ছাত্র সাতক্ষীরা থেকে আসা নাজমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘কলেজে নামমাত্র ছাত্র হল আছে। কিন্তু, সন্ত্রাস ও ছাত্র রাজনীতির কারণে কেউ সেখানে থাকেনা। ’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘ছাত্র হলটিতে প্রতিদিন মাদক বিক্রির হাট বসে। ’  একই কথা বলেন, মাগুরা থেকে আসা দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মো. আরিফ।

তিনি বাংলানিউজকে জানান, ছাত্র হলটি কলেজ থেকে দূরে হওয়ায় সেখানে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে; যার কারণে সেখানে তিনি থাকার সাহস পাননা।

স্নাতক ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘স্বনামধন্য এ কলেজটিতে শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠ নেই। ফলে, খেলাধুলা ও বিনোদন থেকে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে রয়েছে। ’

স্নাতক শেষবর্ষের ছাত্র মো. আল-আমিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারি কলেজ হলেও এ কলেজে একটিও গাড়ি নেই। ফলে, দূরপাল্লার শিক্ষার্থীদের কলেজে আসতে পচণ্ড বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ’

একই বর্ষের ছাত্রী কানিজ ফাতেমা বাংলানিউজকে বলেন, ‘কলেজে কোনো ক্যান্টিন নেই। লাইব্রেরি আছে, পর্যাপ্ত বই নেই। ’

কলেজের সাবেক ছাত্র সংসদের জিএস মশিউর রহমান জাদু বাংলানিউজকে বলেন, ‘২০০৪ সালের পর এখানে ছাত্র সংসদের কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে, খুলনার ছাত্র রাজনীতির রাজধানীখ্যাত কলেজটিতে সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতির চর্চা হচ্ছেনা। ’

কলেজের সাবেক অধ্যাপক বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংবাদপত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ‘দৈনিক অনির্বাণ’ সম্পাদক আলী আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সব আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার এই সিটি কলেজ। সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠাকালটি এদেশের রাজনীতির ইতিহাসের ক্রান্তিকাল। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৬ দফা, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। ’

তিনি বলেন, ‘তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত কলেজগুলি থেকে ছাত্রনেতাদের বহিষ্কার করে শিক্ষাজীবন চিরতরে শেষ করা হচ্ছে। এমনি অবস্থায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটি নৈশ ও দিবাভাগে পরিচালিত থেকে সরকারের এবং সরকারের গোয়েন্দাদের আড়ালে আবডালে বহিষ্কৃত নেতাদের ভর্তি করে গ্রাজুয়েট হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ’

এ বিষয়ে মরহুম অধ্যক্ষ রুহুল আমীন, উপাধ্যক্ষ মুহাম্মাদ নাযীম উদদীন এবং তৎকালীন কয়েকজন শিক্ষক অধ্যাপক আলী আহমেদ, হেলালউদ্দীন খান, সরদার আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক আব্দুর রহমান প্রমুখের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে আলী আহমেদ মন্তব্য করেন।
 
সিটি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল যারা, তারা হচ্ছেন- খুলনার মেয়র সাবেক ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী তালুকদার আব্দুল খালেক, খুলনা জেলা পরিষদ প্রশাসক ও সাবেক হুইপ শেখ হারুনুর রশীদ, আওয়ামী লীগ মহানগর সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান, খুলনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা, শহীদ সাংবাদিক হুমায়ন কবীর বালু, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের বার্তা সম্পাদক কামাল মাহমুদ, সাবেক এমপি আলী আজগর লবি, জাসদ নেতা মনু, প্রয়াত ছাত্রনেতা বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের পিএস আলী তারেক, সিটি কলেজের প্রথম ভিপি ছাত্রনেতা অ্যাডভোকেট শেখ শহীদ, প্রয়াত ডাকসাইটে ছাত্রনেতা নজরুল ইসলাম, হেকমত ভূঁইয়া, আবদুস সামাদ, মাহবুব আলম হিরণ, বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন কমিটির নেতা হায়দার গাজী সালাহউদ্দীন রুনু, সাবেক এমপি কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম, শেখ মো. গাউস, মাহবুবুল আলম সোহাগ, জালাল শরীফ, এসএম কামাল, সাবেক এমপি অধ্যাপক গোলাম পরওয়ার, কণ্ঠশিল্পী শাম্মী আক্তার, রুহিন হোসেন প্রিন্স, আছাদুজ্জামান মুরাদ, ফারাজী ফেরদৌস আহমেদ, ননী গোপাল এমপি, ওমর ফারুক, আশরাফুল আজম, অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী, অ্যাডভোকেট পারভেজ আলম খান, অ্যাডভোকেট মুজিবর রহমান, হাসিনা বানু শিরীন, মেজর (অব.) শামসুল আরেফীন খোকন, কমরেড ফরহাদ হোসেন, কাজী মোতাহার রহমান বাবু, মিজানুর রহমান মিলটন, চৌধুরী শফিকুল ইসলাম হোসেন, আলমগীর হোসেন, মশিউর রহমান যাদু প্রমুখ।

কলেজ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা মনে করেন, সরকারের সঙ্গে প্রাক্তন এসব গুণীব্যক্তিরা কলেজের সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

পাঠক আগামীকাল মঙ্গলবার খুলনা সরকারি বজ্রলাল কলেজের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন দেখতে বাংলানিউজ ভিজিট করুন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।