ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

চেয়ারম্যান শাহজাহানের ভর্তি বাণিজ্য

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪০ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১২
চেয়ারম্যান শাহজাহানের ভর্তি বাণিজ্য

ঢাকা: নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অযোগ্য নিজ পুত্রবধূকে বিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি করিয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থী দেখিয়ে সনদ দিয়েছেন।



তাছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাণিজ্য করেছেন বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২ জানুয়ারি দায়িত্বরত রেজিস্ট্রার প্রফেসর রাশেদের কাছ থেকে জোর করে ১১ ছাত্র ভর্তির অফার লেটার সই করিয়ে নেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান। মোটা অংকের বিনিময়ে শাহজাহান এই অফার লেটারগুলো ফেল করা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন। তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি চার লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে শাহজাহানের এমন অপকর্মের খবর জানাজানি হয়ে গেলে ২০০৯ সালের ২ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ তুলে একটি চিঠি পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। যার স্মারক নম্বর বিমক/বেঃবিঃ/২৭৬(৪) অংশ-১/৯২/৬৯২৪। তবে দায়িত্বরত রেজিস্ট্রার নিজের চাকরি রক্ষার্থে শাহজাহানের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে মঞ্জুরি কমিশনের তোলা অভিযোগের জবাব দিতে বাধ্য হন। যে সব অভিযোগের সবই সত্যি ছিল। তবুও শাহজাহানের ছোবল থেকে রক্ষা পাননি তিনি। অপকর্মের সাক্ষী না রাখতে রেজিস্ট্রারকে বিনা নোটিসে চাকরিচ্যুত করেন শাহজাহান।

অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দিয়ে নিয়মিত অপকর্ম ও দুর্নীতি করতে বাধ্য করাতেন ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান শাহজাহান। তার কথামতো কাজ না করায় তার হাতেই লাঞ্ছিত হয়েছেন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা। তার নজর থেকে কোনোভাবে বাদ পড়েননি সুন্দরী মহিলা শিক্ষক-কর্মকর্তারাও। মানসম্মান বাঁচাতে অনেকে চাকরি ছেড়ে যেতেও বাধ্য হয়েছেন।

জানা গেছে, তার ছোট ছেলের স্ত্রী গাজী তানজিল লাবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি করিয়েছেন। যার আইডি নম্বর ১০১ ০৭১৪ ৫০০। ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারিতে লাবিবার দেওয়া একটি আবেদনে মো. শাহজাহান উপাচার্য হাফিজ জিএ সিদ্দিকীকে লিখেছেন, ‘আবেদনকারী আমার ছোট ছেলের স্ত্রী, তাকে বিবিএতে ভর্তি করা হোক। ’ আবেদনটিতে লেখা রয়েছে, লাবিবা ২০০৬ সালে ‘ও’ লেভেল। ‘এ’ লেভেল প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাকে নন-ডিগ্রি শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করাতে আবেদন জানানো হয়েছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের আরও একাধিক অপকর্মের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। তার অপকর্মের সত্যতা যাচাই করে একটি তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে এসব কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির খুবই সুনাম ছিল। তবে এমন কর্মকাণ্ড হতে থাকলে এটির যথেষ্ট সুনাম নষ্ট হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এনএসইউর ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই কমিটি গঠনের কাজ শুরু করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম তদন্তে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন, সাধারণ তহবিল থেকে যে পরিমাণ টাকা অন্যত্র সরানো হয়েছে বা নর্থ সাউথ ফাউন্ডেশনের নামে এফডিআর করা হয়েছে তা এনএসইউর সাধারণ তহবিলে স্থানান্তর, ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য প্রার্থীদের ভর্তি না করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্র জানায়, ইউজিসির তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠনের কাজ আগামী সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হবে।

ইউজিসিরি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম দিকের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত কিন্তু কেবলমাত্র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কোন্দল ও রেষারেষির কারণেই এর সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, এনএসইউতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা তদন্তে গত ২৭ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। কমিটির আহ্বায়ক হলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আতফুল হাই শিবলী। সদস্যরা হলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন, পরিচালক সামছুল আলম, অতিরিক্ত পরিচালক মিজানুর রহমান ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক ড. দুর্গারানী সরকার। এই কমিটি ২৭১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।

ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য প্রার্থীদের ভর্তি করা যাবে না বলে তদন্ত কমিটি মন্তব্য করেছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের সুপারিশ এবং উপাচার্যের অনুমোদন সাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষায় পাসের জন্য নির্ধারিত নম্বরের চেয়ে ৫ শতাংশ কম পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ২০ জনকে প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি করা যেতে পারে বলেও কমিটি অভিমত দিয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডিন বলেন, একজন ট্রাস্টি সদস্য প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করা সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে পারেন। কিন্তু বর্তমান কর্তৃপক্ষ এ নিয়ম লঙ্ঘন করে ইচ্ছেমতো অকৃতকার্য শিক্ষার্থী ভর্তি করছে।

ভর্তি বাণিজ্য বন্ধের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিনের নেতৃত্বে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিচালিত ভর্তি কমিটির পরিবর্তে এনএসইউর প্রতিটি ফ্যাকাল্টি থেকে প্রতিনিধি সমন্বয়ে উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি ভর্তি কমিটি গঠন করতে হবে। ভর্তি কমিটি প্রতিবছর পুনর্গঠন করতে হবে।

ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনা এক শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। কারণ এর আগেও কয়েকজন শিক্ষিকা ও নারী স্টাফ চেয়ারম্যানের কাছে লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং কেউ কেউ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া উপাচার্য ড. হাফিজ জিএ সিদ্দিকীকে চার দিনের ছুটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দুই মাসের ছুটি দেওয়াকে চ্যান্সেলর তথা রাষ্ট্রপতির আদেশ অমান্যের শামিল বলে তদন্ত কমিটি অভিমত দিয়েছে।

নর্থ সাউথ ফাউন্ডেশনের কাজে ব্যবহৃত হওয়া এনএসইউর নিজস্ব ভবনের সপ্তম তলা পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টিতে ডিন অথবা চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং শিক্ষা কার্যক্রম সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত পুরোপুরি উপাচার্যের এবং সিন্ডিকেটের এখতিয়ারভুক্ত। এক্ষেত্রে ট্রাস্টি বোর্ডকে কোনো ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৯ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।