ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

সোনালি আঁশে হাসি ফুটেছে কৃষকের

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০২২
সোনালি আঁশে হাসি ফুটেছে কৃষকের

বগুড়া: নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করেও সোনালি আঁশেই রঙিন স্বপ্ন দেখেন বগুড়ার কৃষকরা। এ জেলায় বিগত কয়েক বছর পাটচাষিরা তেমন লাভবান হতে পারেননি।

তবে সুদিন ফেরার আশায় বার বার আবাদ তালিকায় পরিবর্তন আনলেও হার মানেননি তারা। নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করে হাজারো কৃষক পাট চাষ অব্যাহত রেখেছেন।

বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) বগুড়া জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, পাট নিয়ে কৃষকদের নানা কর্মব্যস্ততা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলার ১২টি উপজেলায় ১২ হাজার ২৫৭ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে তোষা পাট ১১ হাজার ৬০৮ হেক্টর, মেস্তা পাট ৩৩৩ হেক্টর, দেশি পাট ২২৫ হেক্টর ও কেনাপ পাট ৯১ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। অর্জন হয়েছে মোট ১২ হাজার ২৫০ হেক্টর জমির পাট। যা প্রায় শতভাগ।

জানা যায়, গেল বছর বন্যার পানি বাড়ার ফলে বগুড়া জেলার চাষিরা বিগত বছরগুলোর তুলনামূলক কম পরিমাণে জমিতে পাট লাগিয়েছিলেন। কেননা বন্যার পানিতে ক্ষতির মুখে পরতে হয়েছে চাষিদের। জেলার যমুনা অধ্যুষিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট এ তিনটি উপজেলায় পাট চাষ বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া জেলার ৯টি উপজেলায় কমবেশি পাট চাষ করেন চাষিরা।

এ জেলার চাষিরা এখন পর্যন্ত তুলনামূলক পাটের ভালো দাম পেলেও অনাবৃষ্টির কারণে পানির অভাবে নানা বেগ পেতে হয়েছে তাদের। জেলার বিভিন্ন বাজারে পাটের আমদানি বেশি হওয়ায় গেল এক সপ্তাহের ব্যবধানে জাতভেদে মণ প্রতি পাটের দাম কিছুটা কমেছে বলে দাবি করছেন কিছু চাষি। তবে এ বছর পাটের দাম ভালো হওয়ায় বেশ লাভবান হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন চাষিরা। আর এতেই ঘুচেছে শতকষ্ট।

সরেজমিনে দেখা যায়, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই জেলার পাটচাষিরা তাদের কর্মব্যস্ততা চালিয়ে যাচ্ছেন। পানির মধ্যে কাজ করলেও শরীর থেকে ঝরছে ঘাম। তাদের সেদিকে খেয়াল নেই একদম। পাটখড়ি থেকে সোনালি আঁশ আলাদা করতে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন কয়েকজন চাষি। জাগ দেওয়া পাট বৈঠার নিচে ফেলে পিটিয়ে হাতের কৌশলে পাটখড়ি ও আঁশ আলাদা করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তারা। সেই পাটখড়ি ও আঁশ পানির কিনারা ঘেঁষে কিছুটা ওপরের দিকে আলাদা করে রাখছিলেন।

এরপর আঁশগুলো নিয়ে শুকানোর জন্য সারিবদ্ধভাবে নেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। একইভাবে পাটখড়ি বিশেষ কায়দায় খাড়া করে শুকানো হচ্ছিল। এ কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও দেখা মেলে। এভাবে কৃষাণ-কৃষাণী মিলেমিশে সোনালি স্বপ্ন ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা।

সোনাতলা উপজেলার কামরান মিয়া, লিয়াকত মণ্ডলসহ একাধিক পাটচাষি বাংলানিউজকে জানান, যমুনা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় কঠোর পরিশ্রমের পরেও তাদের চোখে-মুখে চরম হতাশার ছাপ থাকে। বন্যায় হিংস্র যমুনা কেড়ে নেয় জমির ফসল। এরপর বাজারে ভালো দামের আশায় পাট চাষ অব্যাহত রাখেন তারা।

লিয়াকত মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, তিনি প্রায় ১২ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় তার খরচ পড়েছে প্রায় ১৩ হাজার টাকার মতো। বিঘা প্রতি ফলন হয়েছে ১২ থেকে ১৩ মণ হারে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী সেই পাট ২ হাজার ৮০০ টাকা মণ বিক্রি করতে হচ্ছে। বাজারে সর্বোচ্চ ভালো মানের প্রতি মণ ২ হাজার ৯০০ টাকা আর ক্রেতার চোখে একটু সমস্যা মনে হলেই প্রতি মণ একই পাট ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকার মধ্যে দাম হাঁকছেন পাইকাররা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বগুড়ায় এ বছর যমুনায় পানি বাড়লেও তুলনামূলক ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বললেই চলে। তা মোটামুটি কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান দেখলেও অনুমেয়। ভালো দামে পাট বিক্রির কথা জানা গেছে বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে। পাটের বেশি দামের ব্যাপারটি কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন। তবে পাটের ক্রেতা নির্দিষ্ট। অন্য ফসল যেমন অনেক শ্রেণির ক্রেতা সাধারণ কিনে থাকেন। পাটের ক্ষেত্রে তেমন ক্রেতা নেই মন্তব্য চাষিদের।

সারিয়াকান্দি উপজেলার আব্দুল আলীম, কামাল হোসেনসহ কয়েকজন পাটচাষি বাংলানিউজকে জানান, তাদের এলাকায় চরাঞ্চলে বালিযুক্ত মাটি হওয়ায় অন্য ফসল ভালো হয় না। তারা চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকার বেশির ভাগ জমিতে পাট চাষ করেন। জমি ভেদে পাট চাষে ব্যয় নির্ণয় হয়ে থাকে। এ বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি বিঘা পাটের জমির বিপরীতে ১০ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়। বাজারে তাদের উৎপাদিত দেশি ও তোষা পাট ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি বেশি হলে সেদিন পাটের দাম কিছুটা কম পাওয়া যায় বলেও মন্তব্য করেন তারা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, জেলায় এবার পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমি। সে অনুযায়ী ১২ হাজার ২৫৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়। অর্জন হয়েছে ১২ হাজার ২৫০ হেক্টর জমির পাট। এর মধ্যে বেশির ভাগ পাট চাষ করা হয় যমুনা বেষ্টিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায়।

তিনি জানান, নদীর তীরবর্তী ও চর এলাকায় উৎপাদিত পাটের মান অত্যন্ত ভালো হয়। এ জেলায় পাট চাষের লক্ষমাত্রা বেশি নির্ণয় করা হলেও বন্যায় ক্ষতির কারণে পূর্ণ অর্জন হয় না। সেদিক থেকে কৃষকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী দামটাও পায় না। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা জীবিকার তাগিদে পাট কম দামে বিক্রি করতেও বাধ্য হয়। তবে এ বছর ঘটেছে ব্যতিক্রম। এবার চাষিরা ভালো ফসলের পাশাপাশি দামটাও বেশ ভালো পাচ্ছেন। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ দেশি ও তোষা পাট ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

পাট বাজারে আমদানি বেশি হলে কিছুটা কম দাম পেয়ে থাকেন চাষিরা। তবে ব্যবসায়ীদের কাছে চরে উৎপাদিত পাটের বাড়তি চাহিদা থাকায় এখনও ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। সব মিলিয়ে বলা চলে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করেও সোনালি আঁশেই রঙিন স্বপ দেখেন বগুড়ার কৃষক।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০২২
কেইউএ/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।