ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

বেনারসিপল্লিতে ব্যস্ত কারিগর

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
বেনারসিপল্লিতে ব্যস্ত কারিগর বেনারসি শাড়ি বুনতে ব্যস্ত কারিগর। ছবি: বাংলানিউজ

বগুড়া: বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলা শহর। এখানে থেকে ৪-৫ কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে দেখা মিলবে ঘোলাগাড়ী কলোনির।

মানুষজনের কাছে যার আরেক নাম ‘বেনারসিপল্লি’।

শনিবার (২৩ এপ্রিল) বেনারসিপল্লি নামে খ্যাত ঘোলাগাড়ী কলোনিতে গিয়ে দেখা মেলে সেখানে চলছে শাড়ি তৈরির কর্মযজ্ঞ।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনি বেনারসিপল্লিতে ১৯৯০ সালের পর থেকে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। নারীরাও এ পেশায় নিজেদের যুক্ত করতে থাকেন। সাংসারিক কাজের ফাঁকে-ফাঁকে এ কাজ করেন তারা। বেনারসিপল্লিতে বেনারসি, বুটিক, জামদানি, টাইটাকি, কাতান, কাতান বুটিক, পাটি নামের বাহারি ডিজাইনের শাড়ি বানানো হয়। এসব বাহারি শাড়িতে ফুটে ওঠে প্রতিটি বাঙালি ললনার প্রকৃত রূপ-মাধুরি। আর সেই শাড়ি যদি মানসম্পন্ন ও পছন্দের হয় তবে তো কথাই নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, মাটি কেটে নির্দিষ্ট স্থানে চার কোণাকৃতির গর্ত তৈরি করা হয় প্রত্যেক কারখানার জন্য। গর্তে আসন গড়েন কারিগরা। সেখানে বসেই মেশিন চালান তারা। বাহারি ডিজাইনের ক্যাটালগ লাগানো হয় প্রত্যেক তাঁত মেশিনে। সামনে জালের মত বিছানো রংবেরঙের সুতা। কারিগরের হাত-পায়ের তালে তালে চলছিল তাঁত। সচল মেশিনে সুতোভর্তি কাঠ নিয়ে একহাত এপাশ-ওপাশে চালনা করছিলেন তাঁতী। সমানতালে চালাচ্ছিলেন পা। মেশিন সচল রাখতে গিয়ে হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছিল তাদের। কিন্তু যতো ক্লান্তিই হোক, শরীর যতোই বিদ্রোহ করুক, মেশিন বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ একদম নেই। সুযোগ নেই দম ফেলারও। বেনারসিপল্লিতে সারাক্ষণ কেবল একটাই শব্দ ‘খটাশ-খটাশ’। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের দেখা গেলো ঘূর্ণায়মান মেশিনে সুতো গোছাতে। পাশাপাশি ড্রাম মেশিনের সাহায্যে সুতা প্রসেসিং করছিলেন কয়েকজন পুরুষ-শ্রমিক। কারিগরের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় এই সুতা একসময় হয়ে ওঠে একেকটি আকর্ষণীয় শাড়ি। এতো সব আয়োজন মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে। দরজায় কাড়া নাড়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে ঘনিয়ে আসছে ঈদুল ফিতর। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেনারসি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন কারিগররা।

তোড়জোড়ের পরেও কারিগরদের রয়েছে বড় একটি সমস্যা। তাঁত মেশিনের সাহায্যে এখানে উন্নতমানের শাড়ি তৈরি করা হয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত সাপোর্ট না থাকায় এর ফিনিশিংয়ের কাজ করতে হয় ঢাকায় গিয়ে। এজন্য যেতে হয় ঢাকার মিরপুর বেনারসিপল্লিতে। ফিনিশিংয়ের কাজ শেষে তারা নিজ গাঁয়ে ফিরে আসেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করা বেনারসিসহ হরেক রকমের শাড়িগুলো বাজারজাত করেন। এক্ষেত্রেও তারা ঢাকার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। কেননা এ শাড়িগুলো তারা ঢাকার ব্যবসায়ীর কাছেই বেশি বিক্রি করে থাকেন। কারখানা মালিক রানা মিয়া বংলানিউজকে জানান, বেনারসিপল্লিখ্যাত এ এলাকায় শাড়ি তৈরির কাজ আগের তুলনায় অনেকটাই কমে এসছে। যুগের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। ১০ থেকে ১২ বছর আগেও এ উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনি, বড়পুকুর ও পাঁচআড়ঙ্গ এলাকায় এক সময় ব্যাপক পরিসরে বেনারসি তৈরি করতেন কারিগররা। শুধুমাত্র ঘোলাগাড়ী কলোনি এলাকায় ৪০ থেকে ৫০টির মতো তাঁত মেশিন স্থাপন হয়েছিল। গেল বছর করোনার কারণে ১৫-২০টিতে দাঁড়ালেও এ বছর সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০-২৫টিতে।

তিনি বলেন, সাংসারিক কাজের ফাঁকে-ফাঁকে নারীরাও এ পেশায় নিজেদের যুক্ত করেন। একটা সময় এ গ্রামের বেশির ভাগ নারী এ পেশার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিলেন। এ থেকে বাড়তি আয় হয়। যে আয় তাদের অভারের সংসারের অভাব অনেকটা দূর করে।

কারখানার মালিক খোরশের আলম, সালাউদ্দিন আহম্মেদ বাংলানিউজকে জানান, ১৮৯০ সালের পর থেকে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনিতে তারাসহ হাতে গোনা কয়েকজন প্রথম শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। প্রথমদিকে একটি শাড়ি তৈরিতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগে যেতো। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। গ্রামীণ অবকাঠামো ভালো ছিল না। এখন কলোনির বিদ্যুৎ রয়েছে। রাস্ত-ঘাট আগের তুলনায় বেশ ভালো।  এখন দুই-তিন দিনেই তৈরি করা যাচ্ছে উন্নতমানের একেকটি বেনারসি শাড়ি।

তারা বলেন, শুরুর দিকে প্রতিটি মেশিন স্থাপনে ব্যয় হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ঢাকার মিরপুর থেকে শাড়ি তৈরির সুতা, জরি, কেলা, তানি, রংসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেন। এভাবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারখানা তৈরিতে তিনটি ধাপের প্রয়োজন হয়। তারা জানান, তাদের তৈরি শাড়িগুলো ঢাকার মিরপুর-১০, ১১, ১২ এর ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। মিরপুরের ব্যবসায়ীরা ঘোলাগাড়ী কলোনিতে তৈরি করা বেনারসি শাড়ির প্রধান ক্রেতা। এছাড়া উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলায় এসব শাড়ি বিক্রি করা হয়ে থাকে। তবে তা সংখ্যায় অনেক কম। সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে ব্যবসায় তেমন একটা সুবিধা করতে পারছেন না বলেও মন্তব্য করেন তারা।

ঘোলাগাড়ী কলোনির ‘বেনারসিপল্লিতে’ তৈরি বেনারসি পাইকারি বাজারে ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। পাকিস্তানি ও দেশীয় সুতার ব্যবহার হয়ে থাকে এ শাড়িগুলোতে। এ এলাকার বেনারসি শাড়িগুলো ঢাকার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।