ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

চলনবিলের গ্রামে গ্রামে হাঁস পালন  

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২০
চলনবিলের গ্রামে গ্রামে হাঁস পালন   হাঁস পালন। ছবি: বাংলানিউজ

নাটোর: নাটোরের চলনবিল ও হালতিবিল এলাকার প্রতিটি গ্রামে হাঁস পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন গৃহীণিসহ খামারিরা। বর্ষাকালে প্রকৃতিগতভাবে সহজেই খাবার পাওয়া যায় বলে হাঁস পালনে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না।

শামুক, ঝিনুক, মাছ ও পোকামাকড় খেয়ে খুব সহজেই বেড়ে ওঠে এসব হাঁস। তাই এসময় হাঁস পালনে খাবারের জন্য খুব একটা বাড়তি খরচ গুণতে হয় না।  

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁসগুলোকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। সারাদিন তারা ঘুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে সন্ধ্যার দিকে আবার ঘরে ফিরে আসে। হাঁস হারিয়ে যাওয়ারও তেমন কোনো সুযোগ নেই। তাই বিলাঞ্চলে বাড়ি বাড়ি হাঁস পালনে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠছেন নারীরাও। বর্ষাকালে চারিদিকে থৈ থৈ করে বন্যার পানি। এসময় তেমন কোনো কাজও থাকে না তাদের। এই সুযোগে গৃহস্থালীর কাজ কর্মের পাশাপাশি হাঁস পালন শুরু করছেন এসব গ্রামের নারীরা।  

বর্ষায় খোঁজ নিলেই দেখা মিলবে দেশের বৃহত্তম চলনবিল ও হালতিবিলের প্রতিটি বাড়িতে নিজ উদ্যোগে পারিবারিকভাবেই গড়ে ২০ থেকে ২৫টি করে হাঁস পালন করছেন নারীরা। কেউ কেউ বাড়িতেই বাণিজ্যিকভাবে ছোট ছোট খামার করে হাঁস পালন শুরু করেছেন। তারা অল্প দিনেই বেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন এমন নজিরও রয়েছে।

বর্ষা মৌসুমে হাঁস পালনে একদিকে ডিম উৎপাদন বেশি হয়, নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজারজাত করা যায়। অপরদিকে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁসগুলো বিক্রি করে বাড়তি টাকাও পাওয়া যায়। এই দুইয়ে মিলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীর পথে বিলাঞ্চলের নারী পুরুষরা। বর্ষার শুরুতেই এই সুযোগকে কাজে লাগান তারা।  

এদিকে নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের এক পরিসংখ্যান মতে জানা যায়, জেলায় অন্তত ১ হাজার ৩৮৯টি গ্রাম রয়েছে। বর্ষার পানি এলেই এসব গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গড়ে ২০/২৫টি করে হাঁস পালন শুরু করেন। এ হিসেবে প্রতিটি গ্রামে অন্তত ১০০টি পরিবারে হাঁস পালন করা হয়। যার মধ্যে বেশির ভাগই পাতিহাঁস বা দেশীয় জাতের হাঁস রয়েছে। তবে এর মধ্যে অনেকে রাজহাঁস, চিলহাঁসও পালন করে থাকেন।  

বর্ষাকালে খুব সহজেই এবং সহজলভ্য উপায়ে হাঁসের খাবার পাওয়া যায়। ওই সময়গুলোতে কাউকে বাড়তি খরচ গুণতে হয় না। বর্ষার থৈ থৈ পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁসগুলো সারাদিন ঘুরে বেড়ায় আর শামুক, ঝিনুক, মাছ, পোকামাকড় এবং লতাপাতা খেয়ে সন্ধ্যার দিকে আপন ঘরে ফিরে আসে।  

সূত্র আরও জানায়, চলনবিল ও হালতিবিলের ৬৭ হাজার ৫০০ পরিবারে গড়ে ২০টি করে হাঁস পালন হিসাব করলে গড়ে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ হাঁস উৎপান হয় শুধুমাত্র বর্ষাকালেই। এ সময়ে প্রতিটি বাড়িতে গড়ে ১০টি করে ডিম উৎপাদন হলে মোট ডিম উৎপাদন দাঁড়ায় সাড়ে ৬৭ হাজার ডিম। যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় কমপক্ষে ৪৭ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে নাটোর জেলাকে।  

জেলা প্রাণিসম্পদ সূত্র জানায়, নাটোর জেলায় বাণিজ্যিক ও পারিবারিক এই দুই পদ্ধতিতে হাঁস পালন করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত জেলায় ১৫৯টি খামার নিবন্ধন করা হয়েছে। এ মধ্যে চলতি বছরে নিবন্ধন করা হয়েছে সাতটি। এসব খামারের মধ্যে শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। পাঁচ হাজারের বেশি হাঁস থাকলে সেই খামার ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত, তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার হাঁস থাকলে সেটা ‘বি’ শ্রেণির এবং এক হাজার থেকে তিন হাজার হাঁস থাকলে ‘সি’ শ্রেণির খামার। জেলায় ‘এ’ শ্রেণির খামার রয়েছে একটি, ‘বি’ শ্রেণির ২১টি ও ‘সি’ শ্রেণির ২২টি খামার রয়েছে।  

হালতির বিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামের গৃহিণী হেলেনা বেগম জানান, বর্ষাকাল এলে তিনি নিজ উদ্যোগে ৫০ থেকে ৬০টি করে দেশি হাঁস পালন করেন। এ সময় হাঁস পালনে তার কোনো বাড়তি খরচ হয় না। বরং লাভজনক বলে জানান তিনি।  

একই গ্রামের আফরোজা বেগম ও খোদেজা বেগম জানান, বর্ষার সময় হাঁস পালন সহজ ও লাভজনক। এসময়ে হাঁস পালনে তেমন কোনো খরচ হয় না। শুধুমাত্র দেখাশোনা আর পরিচর্যা করলেই হাঁস পালন করা যায়। সকালের দিকে হাঁসগুলো পানিতে ছেড়ে দিলে সারাদিন ঘুরে ফিরে খেয়ে সন্ধ্যা হলে দলবদ্ধ হয়ে ঘরে ফিরে আসে। এ জন্য বাড়তি কোনো সময় ব্যয় করতে হয় না এবং টেনশন করতে হয় না। তবে দু একটি হাঁস দলছুট হয়ে মাঝেমধ্যে হারিয়ে যায়।

তারা জানান, বর্ষাকালে হাঁস পালন খুব লাভজনক। কারণ এ সময়ে ডিমের ভাল দাম পাওয়া যায় এবং বর্ষা শেষ হলেই হাঁসগুলো বিক্রি করে বাড়তি টাকা আয় করা যায়। বর্ষাকালে হাঁসের চাহিদা অনেক বেশি থাকে, কারণ প্রকৃতিগতভাবে খেয়ে লালন-পালন হওয়া এসব হাঁসের মাংস খেতেও অনেক স্বাদ। তাই বিল এলাকায় হাঁস কিনতে আসেন অনেকেই।

চলনবিল এলাকার  চকসিংড়া গ্রামের মরিয়ম বেগম, বানিছা ও রাহিমা বেগম জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বন্যা বেশি ও দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় হাঁস পালনে একটু সমস্যা হয়েছে। কারণ অধিকাংশ বাড়ি ঘর ডুবে যাওয়ায় নিজেদের বসবাসের জায়গা ছিল না। ফলে অনেকের হাঁস হারিয়ে গেছে বা ভেসে গেছে। আর বন্যা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে অনেকেই হাঁস আগেভাগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। এবারের বর্ষায় তারা আশানুরূপ সফল না হলেও বিগত বছরগুলোতে তারা হাঁস পালন করে লাভবান হয়েছেন। বর্ষাকালে বিলে পানি আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি পরিবারের নারীরা হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করতে শুরু করেন। কেউবা ডিম থেকে বাড়িতেই বাচ্চা উৎপাদন করে হাঁস পালন করেন।  

সিংড়ার চকসিংড়া মহল্লার মোস্তাক আলী জানান, এবারের বর্ষায় প্রায় ছয়শ হাঁস দিয়ে খামার করেছিলেন তিনি। কিন্তু তিন দফার অধিক বন্যার কারণে এবং পানির তোড়ে সিংড়ার শোলাকুড়া বাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যায় প্রায় ১৫টি বাড়ি। এসময় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো ৫টি বাড়ি। সেই একই রাতে মোস্তাক আলীর ছয়শ হাঁসও ভেসে যায়।  

পরের দিন তিনি শহরবাড়ী, কয়ড়াবাড়ী, হিজলী, ডাহিয়া গ্রামে ঘুরে ঘুরে তিনশ হাঁস খুঁজে পান। বাকি তিনশ হাঁস হারিয়ে যায়। এতে তার লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয় বলে জানান তিনি। একই অবস্থা হয়েছে আরও অনেকেরই। তবে অধিকাংশরাই হাঁস পালনে লাভবান হয়েছেন দাবি।  

তারা জানান, চলনবিল ও হালতিবিলের পানি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে তাই হাঁসগুলিও তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন।  

নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. গোলাম মোস্তফা বাংলানিউজকে জানান, বর্ষাকালে হাওর ও বিলাঞ্চলে হাঁস পালনের মোক্ষম সময়। এসময়ে হাঁসের খাদ্য সংকট হয় না। শামুক, ঝিনুক, ছোট ছোট মাছ, পোকামাকড়সহ ন্যাচারাল বিভিন্ন খাবার খেয়ে হাঁসগুলো বড় হয় এবং ডিম দেয়। ন্যাচারাল খাবার খাওয়ায় ডিমের প্রোটিনের আধিক্য বেশি থাকে। আর বিল অঞ্চলের হাঁস পালন সহজলভ্য হওয়ায় দিন দিন খামারিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।  

তিনি বলেন, জেলায় হাঁস পালনের সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দেশীয় প্রজাতির চেয়ে উন্নত খাকি ক্যাম্বেল জাতের হাঁস পালনে খামারিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কারণ এই জাতের হাঁস দেশীয় জাতের চেয়ে বছরে ১০০টি ডিম বেশি দেয়। এছাড়া এ জাতের হাঁসের রোগ বালাই কম হয়।  
    
তিনি আরো বলেন, বিগত বছরের তুলনায় এ বছর হাঁসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং হাঁসের মৃত্যুর হার অনেকাংশে কমেছে। প্রতিবছর ডাকপ্লে ও কলেরা রোগে হাঁস মারা যায়। এবার তেমনটি হয়নি। কারণ প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে কারিগরি সহায়তা দেওয়াসহ প্রতিষেধক টিকা দেওয়া হয়েছে। খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এবার যে পরিমাণ হাঁস উৎপাদন হয়েছে তাতে জেলায় ডিমের ও প্রোটিনের চাহিদা মিটচ্ছে। এছাড়া জেলার বাইরেও ডিম রপ্তানি করা হচ্ছে।    

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।