ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

ফেলনা মাছের আঁশেই স্বপ্নের গাঁথুনি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২০
ফেলনা মাছের আঁশেই স্বপ্নের গাঁথুনি মাছের আঁশ

রাজশাহী: বাজারে যেকোনো মাছ কেনার সময় কেটে নিয়ে আসেন অনেকেই। বিশেষ করে বড় মাছ হলে তো অবশ্যই কেটে আনতে হয়।

আর মাছ কেনা বা কাটার সময় তার আঁশ ফেলে দেওয়া হয়। তবে মাছের সেই আঁশকে ফেলনা ভাবা হলেও আসলে তো ফেলনা নয়। রাজশাহীতে মাছের আঁশের কদর এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। শহর ছাড়াও জেলার বিভিন্ন বাজার থেকে গড়ে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই মণ মাছের আঁশ কেনাবেচা হচ্ছে।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজশাহী থেকে সরাসরি আঁশ রপ্তানির কোনো সুযোগ নেই। যদি সুযোগ থাকতো তাহলে ভালো দাম পাওয়া যেতো। তাই সম্ভাবনাময় এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন বিকল্প পেশার মানুষ। আর আঁশের ব্যবসার প্রসারের জন্য সবার আগে সরকারি সহায়তা এবং পৃষ্ঠপোষকতাও প্রয়োজন বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

মাছের আঁশের ব্যবসা রাজশাহীতে অনেকটাই নতুন। আগে এখানকার হাট-বাজারে মাছের আঁশের কদরই ছিল না। বাজারের মাছপট্টিতে জমা হওয়া আঁশগুলো ময়লা নর্দমায় ফেলে দেওয়া হতো। সময়ের বিবর্তনে এখন সেই আঁশেরই কদর তুঙ্গে। রাজশাহীর বাজারগুলোতে এখন ৪০ থেকে ৫০ জন ব্যবসায়ী মাছের আঁশ সংগ্রহ করছেন। সাধারণত একটি মাছ কাটার জন্য পাঁচ থেকে দশ টাকা করে মজুরি নেওয়া হয়।

এর পাশাপাশি তারা আলাদা করে মাছের আঁশ সংগ্রহ ও বিক্রির ব্যবসা করছেন। ফলে সরাসরি মাছ বিক্রি না করলেও বাজারে মাছ কেটে ও মাছের আঁশ কেনাবেচা করে এখন অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। মাছ বিক্রির পাশাপাশি এটি বিকল্প পেশা হিসেবেও এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছে রাজশাহীতে। মাছের সঙ্গে আঁশ বিক্রি করে খুলেছে অতিরিক্ত আয়ের পথ। এই ফেলনা জিনিসটিও তাই সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

মহানগরের শালবাগান বাজার এলাকার ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শুরুর দিকে তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন যেন মাছের আঁশগুলো ফেলে দেওয়া না হয়। এজন্য নিজেই বাজারে বাজারে নিজে ঘুরে বেড়াতেন। মাছ কাটা ও আঁশ ছাড়ানোর পর যেন সেগুলো যত্ন করে জমিয়ে রাখেন। বিনিময়ে মাসে একটা নির্ধারিত  টাকা দিতেন। এখন অবশ্য কেজি দরে কিনতে হয়। প্রতি কেজি মাছের আঁশের দাম পড়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। আর মণ হিসেবে ১ হাজর ৬শ টাকা থেকে ২ হাজার ৫শ টাকা পড়ে।

শফিকুল ইসলাম জানালেন, কেবলে রাজশাহীই নয়, এখন দেশজুড়েই তাদের একটি নেটওয়ার্ক  গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাজশাহী ছাড়াও, ঢাকা ও চট্টগ্রামে মাছের আঁশ কেনাবেচার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। অন্তত শতাধিক লোক আঁশ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত। বাজারে যারা মাছ কাটেন এবং আঁশ ছাড়ান, প্রথম কাজটা তারাই করেন।

মাছ ব্যবসায়ী শহিদুল আলম শহিদ বাংলানিউজকে বলেন, মাছের আঁশ সংগ্রহের পর তা ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে বাজারজাতের উপযোগী করে তুলছেন ব্যবসায়ীরা।

প্রথম পর্যায়ে এভাবে একসাথে ৩/৪ মণ মাছের আঁশ বস্তায় পুরে জমানো হয়। এরপর রাজধানী ঢাকা থেকে পাইকারী ক্রেতারা আঁশ কিনতে রাজশাহী আসেন। দরদাম করে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা লাভে তাদের কাছে মাছের শুকনো ঝরঝরা আঁশগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়। তবে বাজারে চাহিদা থাকলেও রাজশাহী থেকে মাছের আঁশ সরাসরি রপ্তানির সুযোগ নেই। তাই ব্যবসায়ীরা বিক্রিত মাছের আঁশের কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

রাজশাহীর পাইকারি আঁশ বিক্রেতা সালেক হোসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মাছের আঁশের বড় রপ্তানির গন্তব্য হচ্ছে জাপান। কিন্তু সরাসরি জাপানে পাঠানো যায় না। জাপানি একটি বড় কোম্পানি চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় দুটি আলাদা কোম্পানি খুলেছে। ওখানে আগে পাঠানো হয়। মূল কোম্পানি পরে নিয়ে যায়। দক্ষিণ কোরিয়াতেও এখন কারখানা গড়ে উঠেছে। রপ্তানির জন্য তৈরি করার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে। তাদের সনদ পাওয়ার পরই রপ্তানির অনুমতি মেলে।

বছরে দেশ থেকে ৮শ থেকে ১ হাজার টন আঁশ রপ্তানি হয় বলেও জানান সালেক হোসেন।

বর্তমানে দেশে তিনটি কারখানা আছে। মোট রপ্তানি হয় আনুমানিক দেড় লাখ ডলারের পণ্য। তবে সুযোগ না থাকায় রাজশাহী থেকে সরাসরি মাছের আঁশ রপ্তানি করা যায় না। মূলত ঢাকা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তাদের মাছের আঁশ জাপানসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। জাপান ছাড়াও থাইল্যান্ড এবং ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে মাছের আঁশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। উন্নতমানের প্রসাধনসামগ্রী ফুড সাপ্লিমেন্ট, ক্যাপসুলের ক্যাপ ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার হয় ফেলে দেওয়া এই মাছের আঁশ।

এদিকে বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে মাছের আঁশের এ ব্যবসা একেবারে নতুন হলেও শিগগিরই এর ব্যাপক প্রসার ঘটবে বলে মনে করছে মৎস্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীর বাজারে এখন মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হয় এই কথা তারাও জানেন। তবে ব্যবসাটি একেবারেই নতুন। তাই বিষয়টি এখন পর্যন্ত সরকারের নীতিনির্ধারনী মহলের কাছে পৌঁছয়নি। ব্যবসাটি আরো লাভজনক হলে সরকার এই খাতে নজর দেবে। তখন মাছের আঁশ রপ্তানি উপযোগী করতে ব্যবস্থা গ্রহণসহ তাদের সার্বিক সহযোগিতা সহযোগিতায় সরকার এগিয়ে আসবে। যেকোনো পণ্য রপ্তানিযোগ্য করতে আগে প্রশিক্ষণ দরকার। সরকার সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেবে।

কারণ যেকোনো পণ্যের বিক্রির আগে তার গুণগতমাণ অটুট রাখাটাও জরুরি। এতে ব্যবসার উত্তরোত্তর প্রসার ঘটে আর ব্যবসায়ীরাও অধিক মুনাফা পান। তাই ব্যবসাটি অধিক লাভজনক ও রপ্তানিযোগ্য হয়ে উঠলে সরকার তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে বলেও জানান রাজশাহী জেলা মৎস্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২০
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad