ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

কৃষি

যতক্ষণ ক্যামেরা ততক্ষণ মাঠে, পরে খোঁজও মেলেনি চেয়ারম্যানের

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৪ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০২০
যতক্ষণ ক্যামেরা ততক্ষণ মাঠে, পরে খোঁজও মেলেনি চেয়ারম্যানের

কুষ্টিয়া: করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে দেশের কয়েকটি জেলার কৃষকরা ধান কাটার শ্রমিক সংকটে রয়েছে। তবে সারাদেশে যে শ্রমিক সংকট তা কিন্তু নয়। কুষ্টিয়ায় এখন পর্যন্ত ধান কাটার শ্রমিকের সংকট নেই। 

দক্ষিণাঞ্চলের এই জেলায় বন্যার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। এছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এ জেলায় বেশ জোরদার।

কৃষি শ্রমিকের পাশাপাশি ধান কাটতে প্রস্তুত রয়েছে ধান কাটার আধুনিক যন্ত্রপাতি।  

সম্প্রতি দেশের হাওড় অঞ্চলে ধান কাটার শ্রমিক সংকটের কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা কৃষকদের পাশে এগিয়ে এসেছেন। সেদিক থেকেও পিছিয়ে নেই কুষ্টিয়া।

কৃষকের ধান কেটে বাড়িতে পৌঁছে মাড়াই করে দিয়েছেন কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার দোস্তপাড়া মাঠে হাজির বটতৈল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ মোমিন মন্ডল। জেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক তিনি।

জানা যায়, গত সোমবার (০৩ মে) দোস্তপাড়া এলাকার নান্টু মণ্ডলের জমির ধান কাটার প্রস্তুতি একদিন আগেই নিয়ে রাখেন। এজন্য জেলার কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকে ডাকা হয় সেখানে। টিভি ক্যামেরায় পুরো দৃশ্য ভিডিও ধারণ করার নিশ্চয়তাও চান তিনি। সোমবার সকাল ৮টার মধ্যে নেতাকর্মীদের সঠিকসময়ে ক্ষেতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।  

পূর্ব পরিকল্পনা মাফিকই নেতাকর্মীরা সময় মতো হাজির হলেও যথা সময়ে নেই নেতার দেখা। এরই মধ্যেই মাথায় মাথাল, গেঞ্জি আর প্যান্ট পরে কাস্তে হাতে ধান কাটতে প্রস্তুত চেয়ারম্যান।

তার নেতৃত্বে প্রস্তুত কৃষক বেশে অন্যসব নেতাকর্মীরাও, সঙ্গে এক নারী সদস্যও ছিলেন। রীতিমতো ধান কাটার জন্য একেবারে প্রস্তুত ওইসব হালের কথিত কৃষি শ্রমিকরা। কোথা থেকে ধান কাটা হবে তাও জানেন না তারা।

শুরু হলো ধান কাটা পর্ব, তবে এবার কাঁচা ধান নয়, পাকা ধানেই ধরা হলো কাস্তে। মাঝে মধ্যে ক্যামেরা আড়াল হলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় ক্যামেরাম্যানদের, বলা হয় ছবি উঠছে তো?

ক্ষেত মালিক নান্টু মণ্ডলের হিসেব মতে ২০/২৫ জন মিলিয়ে এক পাই ধান কেটেছেন তারা। ধান কাটা শেষ এবার আঁটি মাথায় নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দৃশ্য ধারনের পালা। সেটিও টিভি ক্যামেরাম্যানদের ইচ্ছেতেই হতে হবে। সারিবদ্ধভাবে ক্ষেতের আইল দিয়ে হেঁটে আসার ইশারা ক্যামেরাম্যানদের। তা বুঝে হালের ওই কৃষি শ্রমিক ছোট্ট ছোট্ট আটি মাথায় নিয়ে ছুটে আসেন গন্তব্যের দিকে। অর্থাৎ ক্ষেতমালিকের বাড়ির খোলায়। সেখানে প্রস্তুত রাখা হয় মাড়াইয়ের যন্ত্র। মোমিন মণ্ডল নিজেই মাড়াই করলেন ধান। আর তা ক্যামেরায় ধারনও করা হলো।

শুটিং শেষ, সব মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক চিত্রায়িত হয়। আর এই সময়ের মধ্যে ধান কাটা, তা মাথায় করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে আসা এবং মাড়াই সব কিছুই হয়ে গেল। এ যেন অসাধ্য সাধনের গল্প। হ্যাঁ, হয়েছেও তাই। সারাদেশে অসহায় কৃষকের পাশে দাঁড়াতে যেভাবে এমপি, নেতাকর্মীরা। তাদের অনুসরণ করলেন হালের কৃষি শ্রমিক মোমিন মণ্ডল ও তার অনুসারিরা।

এলাকার কৃষকদের মধ্যে মোটামুটি স্বচ্ছল নান্টু। বিঘা দেড়েক জমিতে তিনি ধান আবাদ করেছেন এবার। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় মোমিন মণ্ডলসহ দলীয় নেতাকর্মীরা কেন ধান কাটল?

এ প্রসঙ্গে নান্টু মণ্ডল বলেন, ‘আমি তাদের জানাইনি। আমাকে চেয়ারম্যান মোমিন মণ্ডল জানালেন তোদের ধান কাটা হবে। আমাদের নেতাকর্মীসহ ক্ষেতে হাজির হবো। ’

অভাবের তাড়নায় কি ধান কাটতে পারছেন না বা শ্রমিক পাচ্ছেন না- এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই কৃষক বলেন, আমাদের এমন কোন অভাব নেই। আমরা ক্ষেতের ধানের ভাত খাই। যা উপার্জন করি তা দিয়ে সংসার চলে যায়।

দোস্তপাড়া এলাকার কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধে জানিয়ে বলেন, ক্যামেরা যতক্ষণ ছিল ততক্ষণই তারা মাঠে ছিলেন। তারপর আর তাদের দেখা যায়নি। মূলত সাংবাদিকদের মাধ্যমে মানুষকে জানানোর জন্যই ধান কাটার নাটক সাজিয়েছেন তারা। কৃষক সমাজের সঙ্গে তামাশা ছাড়া কিছুই না।

তবে এ বিষয়ে বটতৈল ইউপি চেয়ারম্যান এমএ মোমিন মণ্ডল জানান, এ এলাকায় কৃষকদের কোনো শ্রমিক সংকট নেই। আমি শুধু কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য ধান কেটেছি।

তিনি আরো বলেন, আমি জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলীয় নির্দেশনায় ধান কাটতে গিয়েছিলাম। ধান কাটছি তাই সাংবাদিকরা ছিলো।  

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিষ্ণুপদ সাহা বাংলানিউজকে জানান, সদর উপজেলায় বটতৈল এলাকায় সরোজমিনে দেখা যায় যে ওই এলাকার এক শতাংশ ধানও পাকেনি। শ্রমিকের কোনো সংকট নেই। ধান কাটা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে এটা সামগ্রিক কোনো বিষয় না। আগামী ১৫-২০ দিন পরে ওই এলাকায় ধান কাটা শুরু হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শ্যামল কুমার জানান, কুষ্টিয়া জেলায় বন্যা-খরায় শস্যহানীর কোনো সম্ভাবনা নেই।  এখনো ধান কাটা তেমন শুরু হয়নি। আমাদের জেলায় ধান কাটার শ্রমিকের কোনো সংকট নেই। সেই সঙ্গে জেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান কাটার মেশিন দেওয়া রয়েছে।

তিনি আরও জানান, কুষ্টিয়ায় মাত্র দুই শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। জেলায় কোনো শ্রমিক সংকট হবে না।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন জানান, জেলায় কৃষি শ্রমিকের কোনো সংকট নেই। কুষ্টিয়া থেকে ধান কাটার জন্য বিভিন্ন উপজেলার ৫ হাজার ৮৩৬ জন শ্রমিককে অন্য জেলায় যাওয়ার জন্য সরকারিভাবেই অনুমতি দেওয়া হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৯ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।