ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

পোস্তায় ঢাকার বাইরের চামড়া, বিপাকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৯
পোস্তায় ঢাকার বাইরের চামড়া, বিপাকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

পোস্তা (লালবাগ) থেকে: ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চামড়া নিয়ে আসছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু দাম ও ক্রেতা না থাকায় রাস্তার পাশে বা ট্রাকেই স্তূপ হয়ে আছে চামড়া। নেই কাঁচা চামড়া বেচাকেনা, আড়তদার ও কর্মচারীদের কর্মচাঞ্চল্য।

কয়েকজন মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া নিয়ে এলেও শত চেষ্টা করেও বিক্রি করতে পারছেন না। এ পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি ও আড়তদাররা একে অপরকে দোষারোপ করছেন।

একইসঙ্গে রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনাসহ সিন্ডিকেটের অভিযোগ। এতে করে বিপাকে পড়ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) রাজধানীর লালবাগের পোস্তা এলাকায় ঈদের দ্বিতীয় দিন এ চিত্র দেখা যায়।

এদিকে, চামড়ার আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে চামড়ার দাম কমে যাচ্ছে। ফলে চামড়ার বাজার সংকটে পড়ছে বলে মনে করছেন ট্যানারি মালিকরা। কিন্তু এ অভিযোগ মানতে রাজি নন আড়তদাররা। তারা মনে করেন, চামড়ার বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। ট্যানারি মালিকরা বাজারে এ সংকট তৈরি করছেন। তারা বকেয়া পরিশোধ করে দিলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তাদের হাতে টাকা না থাকায় চামড়া কিনতে পারছেন না। ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধ করলেই সমস্যা থাকবে না। বাজারও আগের মতোই চাঙা হয়ে যাবে।

তবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলছেন, আড়তদারদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের জন্য পোস্তার চামড়া ব্যবসার আজ এ অবস্থা। তারা পানির দামে চামড়া কেনার আশায় এ সিন্ডিকেটে করে রেখেছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কোনো কোনো আড়তে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে লবণ দেওয়ার কাজ চলছে। আড়তে চামড়া লবণজাত অবস্থায় থাকবে ২০ থেকে ২৫ দিন। এরপর এখান থেকে চামড়া নেবেন ট্যানারি মালিকরা। .পুঁজি না থাকায় পোস্তা এলাকার অধিকাংশ আড়তদার চামড়া কেনা বাদ দিয়ে অবসর সময় পার করছেন। তাদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্যতা নেই। চামড়া কেনায় কোনো আগ্রহ নেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাক ও পিকাপে করে চামড়া এলেও সেগুলো সেখানে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ফলে কোরবানির ঈদের পর অন্যান্য বছর যে কর্মব্যস্ততা দেখা যায়, এ বছর সে রকম কোনো চিত্র দেখা যায়নি।  

চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আড়তদাররা সরাসরি চামড়া না কেনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দিয়ে চামড়া কিনছেন। তারা কম দামে চামড়া কেনার কারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা চামড়া নিয়ে রাস্তায় বসে থাকতে বাধ্য করে। পরে চামড়া নষ্ট হওয়ার আতঙ্কে নাম মাত্র দামে লোকসান দিয়ে চামড়া বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।  

সরকার নির্ধারণ করে দেওয়া দর অনুযায়ী, লবণ মিশ্রিত চামড়া ২০ থেকে ২৪ বর্গফুটের একটি চামড়ার দাম হওয়ার কথা ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। সেখানে লাভের আশায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বাসা-বাড়ি থেকে চামড়া কিনেছেন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে। কিন্তু মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েন তারা। আড়তদাররা চামড়া কেনার টাকার অভাব আর সংরক্ষণের কথা বলে বেকাদায় ফেলে দিচ্ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। আর কম দামে কিনে মধ্যসত্ত্বভোগীরা মুনাফা রেখেই সেই চামড়া বিক্রি করেন আড়তদারদের কাছে। যা পরে আড়তদাররা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে ট্যানারি মালিকদের কাছে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করবেন। এভাবেই চামড়ার বাজারে দরপতন হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে পোস্তা এলাকার চামড়ার আড়তদার সমির আলী বাংলানিউজকে বলেন, গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কোরবানির ঈদের পর গত দুই তিন বছর ধরে পোস্তা এলাকার যে চিত্র তা আগে কখনও দেখিনি। কোনো ব্যবসায়ীর হাতে টাকা নেই। ট্যানারির মালিকরা বেকেয়া ও চামড়া কেনার জন্য অগ্রিম ১০ শতাংশ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দিচ্ছেন না। পাশাপাশি ব্যাংক থেকেও ঋণ পাওয়া যায়নি। ফলে আড়তদারদের হাতে নগদ টাকা না থাকায় তারা চামড়া কিনতে পারছে না।

হবিগঞ্জ থেকে পোস্তায় চামড়া নিয়ে এসেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, লবণযুক্ত ১৭০টি গরুর চামড়া নিয়ে এসেছি। কিন্তু আড়তদাররা চামড়ার দাম বলছে না। যারা দাম বলছে, সে দামে বিক্রি করলে পুঁজি থাকবে না। আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে চামড়া কিনছে না বলে মনে করেন তিনি।  

কুমিল্লা থেকে পিকাপে করে ১৫০টি চামড়া নিয়ে এসেছেন বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, গত ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া কিনে পোস্তায় নিয়ে আসি। কিন্তু এ বছরের মতো দরপতন কোনো দিন দেখতে পাইনি। ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা মিলে এ ব্যবসায় একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেট তৈরি করে নষ্ট করে দিয়েছে।  

এ বিষয়ে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, চামড়ার বাজার অস্থিতিশীল করছে পোস্তার ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আমাদের কাছে ২৫০ কোটি টাকা পায়, এটি একদমই সত্য নয়। তারা আমাদের কাছে ১৫০ কোটি টাকার মতো পাওনা আছেন। অধিকাংশ ট্যানারি মালিকই তাদের টাকা পরিশোধ করেছেন।  

তিনি বলেন, কাঁচা চামড়ার বাজারটা তারাই নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে আমাদের কোনো হাত নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যখন পোস্তায় চামড়া বিক্রি করতে যান, তখন তারা সেটি ৩০০ কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশি টাকা দিয়ে চামড়া কেনেন। কিন্তু আমাদের কাছে বিক্রির সময় তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করেন। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পোস্তার ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার বিষয়টি সঠিক নয়। এখানে সিন্ডিকেটও কাজ করে।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, চামড়ার বাজারে কোনও সিন্ডিকেট হয় না। প্রতিবছর ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেটের কথা বলেন। কিন্তু এটি সঠিক নয়। সমস্যা হয় তাদের কাছে পাওনা টাকা যখন আমরা পাই না তখনই। তারা প্রচুর টাকা বকেয়া রেখেছেন। তাদের কাছে ৩৫০ কোটি টাকার মতো আমরা পাওনা রয়েছেন আমাদের আড়তদাররা। কিন্তু আমরা একেবারেই চামড়া কিনছি না বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু আমরা যে পরিমাণ কিনতে চাচ্ছি তা পুঁজির অভাবে কিন্তু পারছি না। সবার কাছে টাকা থাকলে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকতো, ফলে চামড়ার দামও বাড়তো।

সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া দাম অনুযায়ী, ঢাকায় কোরবানির গরুর প্রতিটি ২০ থেকে ৩৫ বর্গফুটের চামড়া লবণ দেওয়ার পরে ৯০০ থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকায় কেনার কথা ট্যানারি মালিকদের। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় চামড়া কিনেছেন। আর রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে আরও কম দামে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৯
জিসিজি/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।