ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

সিলগালা করে ঋণখেলাপিদের তালিকা দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৬ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৯
সিলগালা করে ঋণখেলাপিদের তালিকা দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক

ঢাকা: সিলগালা করে ঋণখেলাপিদের নাম-ঠিকানা সম্বলিত একটি তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সোমবার (২৪ জুন) বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ তালিকা দাখিল করে।

১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণসহ মোট ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণের হিসাব উল্লেখ করে ব্যাংকের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, দেশে ১০ হাজার ৪’শ ৭৬টি হিসাবের বিপরীতে নেওয়া খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।

এর মধ্যে আদালতের আদেশে স্থগিত আছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর অবলোপন ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা ফেরত পাওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ টাকা ফেরত পাওয়া যেতেও পারে, নাও পারে।

আদালতে রিট আবেদনকারী পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান।

মাহবুবে আলম বলেন, আমি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নয়, ব্যক্তি আইনজীবী হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে এসেছি। আইন অনুযায়ী এ তালিকা গোপনীয়। এটা প্রকাশ করা যাবে না।

তবে রিট আবেদনকারীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, তিনিতো রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে থাকতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে নয়।

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ব্যক্তি আইনজীবী হিসেবে দাঁড়াতেতো আইনগত বাধা নেই।  

এরপর তালিকা দাখিল করে মাহবুবে আলম বলেন, এ তালিকা প্রকাশ করা যাবে না। একারণেই তা সিলগালা করে দাখিল করা হয়েছে।

এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে মনজিল মোরসেদ বলেন, সুইস ব্যাংক অনেক শক্তিশালী। তারপরও আদালতের নির্দেশে তারা তালিকা প্রকাশ করেছে। তাই এখানেও তালিকা প্রকাশে সমস্যা থাকার কথা নয়। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনেও এ তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য।

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আইন অনুযায়ী জাতীয় সংসদে ছাড়া অন্য কোথাও এ তালিকা প্রকাশ করা যাবে না।

শুনানিতে আদালত বলেন, একটি স্বাধীন কমিশন করা নিয়ে রুল জারির পর ২ শতাংশ সুদ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সার্কুলার জারির পর ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ সার্কুলারের পর ইচ্ছা করে খেলাপি হবে। এ সার্কুলারের ফলে ভালো গ্রহীতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আদালত এসময় ওই সার্কুলারকে ‘দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

আদালত ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশ্যে বলেন,  প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারা ওয়াদা করে আসলো যে, সুদের হার ওয়ান ডিজিট কার্যকর করবেন। কিন্তু ওই ওয়াদা রক্ষা করলেন না। প্রায় বছর পার হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকও কোনো ব্যবস্থা নিলো না।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কেউ কেউ ঋণ নিয়ে বিপদে পড়েছে। বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান করেও সমস্যা হয়েছে। এসব কারণে ঋণ খেলাপি হয়েছে। তাই এসব বিষয়ও বিবেচনা করতে হবে।

এ সময় আদালত বলেন, কেউ কেউ শিল্পপ্রতিষ্ঠান করার কথা বলে ঋণ নিয়ে নামে মাত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান করে বাকি টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বিদেশে সেকেন্ড হোম বানিয়েছে। এসব কারণেই ব্যাংকিং কমিশন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এরপর আদালত ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারের ওপর স্থিতাবস্থার মেয়াদ আরও দুই মাস বাড়িয়েছেন। এছাড়া এ মামলায় পক্ষভুক্ত হতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আবেদনের ওপর আগামী রোববার (৩০ জুন) শুনানির দিন ঠিক করেছেন।

আদেশের পরে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে গত ২০ বছরের ঋণখেলাপিদের যে তালিকা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটি তারা দাখিল করেছে। যদিও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।  সেখানে তারা একটি বাস্তবায়ন প্রতিবেদনও দাখিল করেছে। সে প্রতিবেদনে তারা বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকের আইনে যদিও ঋণখেলাপিদের সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করার কোনো বিধান নেই। কিন্তু আদালতের নির্দেশের কারণে এটা আদালতে দাখিল করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলের শুনানির বিষয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করতে চাইলে আমরা সেটাতে আপত্তি জানিয়েছি। যেহেতু এখানে অর্থ মন্ত্রণালয় পক্ষ আছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। ফলে মামলায় কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হলে অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন না। আদালত তখন আমাদের শুনানি গ্রহণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তার বক্তব্য শুনেছেন। ’

রুল শুনানির বিষয়ে তিনি বলেন, আদালত দুই সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের হলফনামা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে দুই সপ্তাহ পরে রুল শুনানির জন্য বলেছেন। ’

আইনজীবী মনিরুজ্জামান বলেন, আজকে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেখানে ১০ হাজার ৪৭৬টি খেলাপি ঋণের অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয়েছে, যা এক কোটি টাকার ওপরে। এ অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট আছে ১ হাজার ১০৬টি, বাকি ৯ হাজার ৩৭০টি অ্যাকাউন্ট ব্যাংকের। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের মোট অ্যাকাউন্ট হচ্ছে ১০ হাজার ৪৭৬টি।

খেলাপি ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, মোট কত টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে সে তথ্য দেওয়া হয়নি। কারণ ঋণখেলাপিদের নাম-ঠিকানা দেওয়ার জন্য কোর্টের আদেশ ছিলো। আদালতের আদেশ অনুযায়ী খেলাপি ঋণ বা ঋণখেলাপিদের নিয়ে এটাই বাংলাদেশ ব্যাংকের লেটেস্ট প্রতিবেদন। নাম-ঠিকানার ভিত্তিতে ঋণখেলাপিদের বিষয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে কোনো ক্রমিক তৈরি করা হয়নি যে, কতজন ঋণখেলাপি। এছাড়া কোনো টাকার অঙ্ক তৈরি করা হয়নি যে, খেলাপি ঋণের টাকা কত।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে ঋণখেলাপির তালিকা দাখিলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে রুল জারি করেন। রুলে আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বন্ধে কমিশন গঠনের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

এ আদেশের পরও ঋণখেলাপির তালিকা দাখিল না করায় গত ৩০ এপ্রিল হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ১৫ দিনের মধ্যে তালিকা দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।  

এ অবস্থায় ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিরুজ্জামান আদালতকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী আইনগতভাবে তাদের এ তালিকা দাখিল করার এখতিয়ার নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান রিট আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

এরপর আদালত আগামী ২৪ জুনের মধ্যে দাখিল করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৩ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৯
ইএস/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।