ঢাকা, সোমবার, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ মে ২০২৪, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

তদন্তে দুদক

আল আমিন গ্রুপের সরকারি ভূমি জালিয়াতি!

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫
আল আমিন গ্রুপের সরকারি ভূমি জালিয়াতি!

ঢাকা: দুটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারের ৩০ একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে আল আমিন গ্রুপ। সেই সরকারি জমি বন্ধক রেখে আবার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৮৬ কোটি ঋণ নিয়েছে এ শিল্প প্রতিষ্ঠানটি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে গ্রুপটির বিরুদ্ধে এমন জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গুরুতর এমন অভিযোগ রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণিত হওয়ায় গত ৩০ ডিসেম্বর নোয়াখালীর সুধারাম মডেল থানায় আল-আমিন গ্রুপের এমডি আনোয়ার মির্জার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদি এবং দুদকের নোয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নিরাপদ স্বর্ণকার বাংলানিউজকে মামলার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব জালিয়াতির সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় মামলা দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। পরবর্তী তদন্তে আরও বিশদভাবে খতিয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি জানান।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রুপটির এমডি নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ৬০ কোটি ৯২ লাখ টাকার ৩০ দশমিক ৪৬ একর ভূমি বন্দোবস্ত নিয়ে তা আত্মসাতের চেষ্টা করেন। বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গ করে এসব সম্পত্তি বিভিন্ন ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ  নিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, সরকারি সম্পদের বিপরীতে বেআইনিভাবে ঋণ নিয়ে সেই ঋণও তিনি পরিশোধ করেন নি। দুদকের মামলার পাশাপাশি বর্তমানে গ্রুপটির বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের মামলা চলছে। ১৯৬৮ সালে নোয়াখালীর চৌমোহনীতে মোস্তফা বেকারির মাধ্যমে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে আল-আমিন গ্রুপ। ১৯৭৩ সালের দিকে নোয়াখালী সরকারি কলেজ সড়কে গড়ে ওঠে আল-আমিন ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি। আল-আমিন সুপার বিস্কুট, রেইচি, কসমস, টুনি, পাইনাপেল, গ্লুকোজসহ ২১-২২ ধরনের বিস্কুট উৎপাদন করা হতে থাকে এখানে। পরে ভোজ্যতেল, বেভারেজ, ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে গ্রুপটি। প্রতিষ্ঠানটির এ উন্নতির সময় ব্যাংকগুলোও উদার হস্তে অর্থায়ন করে। ২০১০ সাল থেকে গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন একে একে বন্ধ হতে থাকে। ২০১৩ সালে এসে তাদের তাদের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যায়।
সরকারি জমির বিপরীতে ঋণ

আল-আমিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আল-আমিন সুইট অ্যান্ড ক্র্যাকার্স ও নোয়াখালী বেভারেজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকালে সরকারি বন্দোবস্ত জমির বিপরীতে বিভিন্ন সময় ঋণ নিয়েছেন । ব্যাংকঋণ নেয়ার জন্য নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের একটি ভুয়া অনাপত্তিপত্রও তৈরি করেন তিনি।

১৯৯২ সালের দিকে আনোয়ার মির্জা ফারহানা টেক্সটাইল মিলস ও নোয়াখালী অয়েল রিফাইনারি মিলস লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য নোয়াখালীর বিনোদপুর, কাশিরামপুর, পশ্চিম কৃষ্ণপুর ও পূর্ব রামচন্দ্রপুর মৌজার বিভিন্ন দাগে ৩০ দশমিক ৪৬ একর ভূমি বন্দোবস্তের আবেদন করেন আনোয়ার মির্জা। পরবর্তী সময়ে তত্কালীন নোয়াখালী জেলা প্রশাসক তাকে জমির বন্দোবস্ত নথি প্রদান করেন। ওই বন্দোবস্ত নথি দুটোর আলোকে ১৯৯৪ সালের ৯ মে ৮৩২১ ও ৮৩২২ যুক্তে দুটি কবুলিয়ত সম্পাদন করেন।

অঙ্গীকারপত্রের সব শর্তই ভঙ্গ

কবুলিয়ত দুটি সম্পাদনের সময় সরকার কর্তৃক ১৭টি শর্ত আরোপ করা হয়। এর মধ্যে ৫ নম্বর শর্তে উল্লেখ করা হয়, ‘জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ব্যতীত আবেদিত শিল্প ছাড়া অন্য কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়া এবং ভূমির আকার পরিবর্তন করা যাবে না। ’

১১ নম্বর শর্তে রয়েছে, ‘কোনো প্রকার বিল্ডিং করা যাবে না’। ১৩ নম্বর শর্তে উল্লেখ রয়েছে, ‘লিজ জমিতে কবুলিয়ত রেজিস্ট্রারের তারিখ হতে এক বত্সরের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের লক্ষ্যে সন্তোষজনক পদক্ষেপ জেলা প্রশাসককে দেখাতে হবে এবং উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু করিতে ব্যর্থ হইলে বন্দোবস্ত সরাসরি বাতিল বলে গণ্য হবে। তখন কবুলিয়তের শর্ত মেনে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একটি অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষরও করেন। ’

অঙ্গীকারপত্রের ১ নম্বর শর্তে বলা হয়, ‘বন্দোবস্ত প্রাপ্ত ভূমিতে কবুলিয়ত রেজিস্ট্রারির তারিখ হতে এক বত্সরের মধ্যে ফারহানা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ও নোয়াখালী ওয়েল রিফাইনারি মিলস লিমিটেডের নামে শিল্প কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে নির্মাণকাজ শুরু করিব এবং উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু করিতে ব্যর্থ হলে বন্দোবস্ত সরাসরি বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে। এ ব্যাপারে কোনো রূপ ওজর আপত্তি করিব না, করিলেও উহা সর্ব আদালতে অগ্রাহ্য হবে। ’ ৬ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, ‘বন্দোবস্তকৃত ভূমি প্রস্তাবিত কাজ ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করিব না। ’

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— বন্দোবস্ত নথি ও তত্সংক্রান্ত অঙ্গীকারপত্রের সব শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। বন্দোবস্তকৃত স্থানে উল্লিখিত দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। এছাড়া উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান দুটির জন্য সরকারের বিনিয়োগ বোর্ডের আইন লঙ্গন করা হয়েছে।

শিল্পনীতি ১৯৯১ অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের জন্য বেসরকারি শিল্পকে বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হতে হবে। কিন্তু আল-আমিন গ্রুপের এমডি আনোয়ার মির্জা উল্লিখিত দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেলায় বিনিয়োগ বোর্ডে কোনো প্রকার আবেদন করেননি এবং কোনো নিবন্ধনও নেননি। ফলে সরকারের ৩০ দশমিক ৪৬ একর ভূমি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে দুটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে প্রতারণা করেন। বন্দোবস্ত ভূমিতে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে কবুলিয়তের শর্ত ও অঙ্গীকারপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে তিনি ওই স্থানে আল-আমিন সুইট অ্যান্ড ক্রেকার্স ও নোয়াখালী বেভারেজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এগুলোর অস্তিত্ব বর্তমানে নেই।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আল-আমিন গ্রুপের এমডি নোয়াখালীর বিনোদপুর, কাশিরামপুর, পশ্চিম কৃষ্ণপুরের পূর্ব রামচন্দ্রপুর মৌজায় বিভিন্ন দাগে যে ভূমি ফারহানা টেক্সটাইল মিলস এবং নোয়াখালী অয়েল রিফাইনারি মিলস লিমিটেড স্থাপনের উদ্দেশ্যে সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়েছেন তা বেআইনি। কারণ সরকারের ভূমি হুকুম দখল ৩২/১৯৬২-৬৩, ৩২/১৯৬৩-৬৪ নম্বর  নথি যুক্তে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (নোয়াখালী) নামে রয়েছে। এখনও তাদের নামেই রয়েছে। ভূমির মালিক ছাড়া অন্য কেউ উল্লেখিত ভূমি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে না বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

দুদকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে ইসলামী ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল)সহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটি এ সরকারি জায়গার বিপরীতে ঋণ নিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।