ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

বগুড়ার ‘চাদর-কম্বল গ্রামের হাট’

সুতোর শিল্পে ঐতিহ্য বুনে চলছে পাঁচ হাজার পরিবার

টি এম মামুন, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১১
সুতোর শিল্পে ঐতিহ্য বুনে চলছে পাঁচ হাজার পরিবার

বগুড়া: তাদের বুননে আধুনিকতার আছে ছোঁয়ায় ঐতিহ্যের মিশ্রণ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনও তারা পাননি।

নিজেদের চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারাবহিকতায় বংশপরম্পরায় তারা বুনে চলেছে তাঁতের লুঙ্গি, গামছা, শতরঞ্জি।

তাদের কুশলি হাতে স্বপ্নমাখা রং-ডিজাইনে হাতে বোনা দেশীয় এসব পোশাক ক্রমশ বদলে যাওয়া বাঙালির ফ্যাশন চেতনায় এখনও সগর্বে দেশীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে রেখেছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ তাঁতীদের বোনা এসব কাপড় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সামিল হচ্ছে দেশীয় ঐতিহ্যের চমক নিয়ে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে এরকম অনেক গ্রাম আছে যার বাসিন্দারা বাঙালির ঐতিহ্যের এ শিল্পকে এখনও অবলম্বন করে টিকে আছে। এমনি ছোট্ট একটি গ্রামের নাম শাঁওইল। বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের এরকম কয়েকটি গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় কেবলমাত্র তাঁত শিল্পকে নির্ভর করেই টিকে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার। অনটনের অকুল পাথার পেড়িয়ে গ্রামীণ এই তাঁতশিল্প তাদের পরিবারে এনেছে স্বচ্ছলতা।

উত্তরবঙ্গের এই তাঁতি গোষ্ঠী তৈরি প্রতিদিন করছে শত শত চাদর, কম্বল, লুঙ্গি, গামছা ও তোয়ালাসহ অন্যান্য বস্ত্র। উপজেলার শাওইল ও এর আশপাশের গ্রামের শ্রমিকরা দেশের বস্ত্র শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। সাধারন মানুষের মোট বস্ত্র চাহিদার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যোগান দিচ্ছেন তারা।    

স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ রহমান মিয়া জানান, গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মূল পেশা তাঁত শিল্পকে ঘিরে। বগুড়ার আদমদিঘী, দুপচাঁচিয়া ও পাশ্ববর্তী জয়পুরহাটের আক্কেলপুরসহ ৭৫ গ্রামের প্রায় সাত হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবার আছে। এছাড়া এ শিল্পকে ঘিরে বেঁচে পরোভাবে বেঁচে রুটি-রুজি আসছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষের। এদের কেউ বংশ পরম্পরায়, কেউবা আবার নতুন করে এ পেশায় এসেছেন।

রহমান মিয়া বলেন, ‘এখানকার চাঁদরের মান উন্নত হওয়ায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ’

তার কাছেই জানা গেল এই গ্রামে অনেক আগে থেকেই তাঁতিদের বসবাস। শাঁওইল গ্রামে প্রাচীন আমল থেকেই গড়ে উঠেছে ভিন্নধর্মী একটি হাট। যেখানে চাদর ও কম্বলের উলের সুতা কেনাবেচা হয়। পরবর্তীতে মানুষের মুখে-মুখেই এই হাটের নাম হয়ে যায় ‘চাঁদর কম্বল গ্রামের হাট। ’

শাঁওইল গ্রামের বাসিন্দা বাবু জানান, সপ্তাহের রবি ও বুধবার দুই দিন ভোর ৪টা থেকে শুরু হয়ে এই হাট চলে একটানা সকাল ১০টা পর্যন্ত। এছাড়া এই হাটে প্রতিদিনই চলে ছোট-খাটো বেচাকেনা। শুরুতে হাটে পাঁচটি দোকান থাকলেও বর্তমানে ছোট বড় মিলে এখানে দোকান রয়েছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার।    

একদার চাদর ও কম্বল কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র এই হাটকে কেন্দ্র করে এই কুটির শিল্প জাগিয়ে তুলেছে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার। রবি ও বুধবারের হাট দেখে মনে হয় যেন বড় আকারে বিশেষ কোন মেলা বসেছে। সে সময় দূর দুরান্ত থেকে আসা পাইকারী ব্যবসায়ীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে গ্রামের বিভিন্ন পথঘাট।

শীত শুরুর আগেই শাওইল সহ আশেপাশের তাঁতিরা শুরু করে কম্বল তৈরির কাজ। এছাড়া বছর জুড়েই চলে তাঁতে বোনা সুতার হয় পুরুষ ও মহিলাদের ছোট ও বড় বিছানার চাদর, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালা সহ বিভিন্ন ধরনের পোষাক তৈরির কাজ।

এদিকে, গ্রাম্য এই হাটকে ঘিরে রাজশাহীসহ সারাদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের মধ্যে চলে চাদর ও কম্বল এর সুতা কেনার প্রতিযোগিতা। হাটের সময়ে এর চারপাশকে ঘিরে থাকে শত শত রিক্সা-ভ্যান, ইঞ্জিন চালিত থ্রী হুইলারসহ বিভিন্ন রমক যানবহনের।

তাঁতের খটখট শব্দ আর সুতার বুননের ছন্দের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে শাঁওইলসহ আশে পাশের গ্রামের মানুষের স্বপ্ন। এদের কারও রয়েছে নিজের তাঁত আবার কেউবা শ্রম দিচ্ছে অন্যের তাঁতে।

শাওইল গ্রামের মানুষের ভালবাসা প্রযুক্তির দাপটকেও যেন হার মানিয়েছে। যার বড় প্রমান এখানকার শিল্পের ক্রমাগত বিস্তার লাভ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমস্ত গ্রাম জুড়ে চলে নারী-পুরুষের ভিন্ন রকম কর্ম ব্যবস্ততা। কেউ ছাড়াচ্ছে সুতা, আবার কেউবা চড়কা নিয়ে বসে সেই সুতা নলি বা সূচিতে ওঠাচ্ছে।

গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ির ঘর থেকে শুরু করে উঠানের ভিতর পর্যন্ত রয়েছে তাঁত যন্ত্র। এসব বাড়িতে দু’টি থেকে শুরু করে ১০টি পর্যন্ত তাঁত রয়েছে। কোনটি চাকাওয়ালা আবার কোনটি তৈরি করা হয়েছে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে।

এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা মন্ডল বাংলানিউজকে জানান, কোন ধরনের সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই গড়ে উঠেছে এখানকার এই বিশাল কর্মত্রে। শুধু তাই নয়, চাদর ও শীতবস্ত্র তৈরিকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে শীতবস্ত্র তৈরির মেশিন, সুতা, রঙ, তাঁতের চরকা, তাঁত মেশিনের সরঞ্জাম ও নাটাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

তিনি বলেন, এখানের অধিকাংশই মহিলা শ্রমিক। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তারা লট থেকে সুতা বাছাই ও ফেটি তৈরি করে সুতা সাজিয়ে রাখে। আর প্রতিদিন পারিশ্রমিক হিসেবে পায় ৭০ থেকে ৯০ টাকা।  

ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য উজ্জল বাংলানিউজকে জানান, শাওইল হাট এর মত বানিজ্য এলাকায় কোন ধরণের ব্যাংক না থাকাটা সত্যিই দুঃখজনক। আদমদীঘি থেকে এই বাজারের দুরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার হওয়ায় আর্থিক লেনদেনের জন্য যেতে হয় নওগাঁ জেলা সংলগ্ন সান্তাহার পৌর এলাকায়।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।