ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

অতিথি কলাম

পুঁজিবাজার: কেনো এমন হলো, দায় কার?

রাজু আহমেদ, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১১
পুঁজিবাজার: কেনো এমন হলো, দায় কার?

পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন স্বাভাবিক হলেও গত দেড় মাস ধরে দেশের শেয়ারবাজারের সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ শুধু অস্বাভাবিকই নয়, যে কোনো বিচারেই তা নজিরবিহীন ও অনভিপ্রেত। একের পর এক বিপর্যয়ের কারণে বাজারে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যে এখন শেষ আশাটুকুও বিলীন হতে বসেছে।

এখনই সরকারের দিক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই বিনিয়োগকারীদের পথে বসার জোগাড় হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শুধু পুঁজিবাজারের এই বিপর্যয়ই বর্তমান সরকারের সব অর্জনকে ম্লান করে দিতে যথেষ্ট।
 
কথা উঠেছে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই পুঁজিবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ ১৪ বছর পার হলেও শেয়ারবাজারে ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির বিষয়টি ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসছে। বাজারে আবারো সেই ’৯৬-এর পুনরাবৃত্তি হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন বার বার সামনে চলে আসছে। অনেকে বলছেন, বাজারের শক্তি-সামর্থ্য, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি-বিধান কার্যকর থাকায় শেয়ারবাজার আর ওই মাত্রার কেলেঙ্কারির সুযোগ নেই। আবার আরেক দল বলছেন, বাজারকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে শেয়ারের দর বাড়িয়ে যে মুনাফা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা ‘৯৬-এর চেয়েও অনেক বেশি।

প্রকৃতপক্ষেই ’৯৬-এর পুনরাবৃত্তি হয়েছে কিনা- তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদন্ত হয়তো বা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত পুঁজিবাজারে যা কিছু ঘটলো- তা মোটেই শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক প্রবণতা নয়। ফলে কী কারণে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো তা খতিয়ে দেখা জরুরি।

১৯৯৬ সালের বড় ধসের পর শেয়ারবাজার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল। ওই সময়ে পুঁজি হারানো হাজার হাজার মানুষের মধ্যে শেয়ারবাজার ছিল বড় আতঙ্কের নাম।

’৯৬-এ পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা তো বটেই সাধারণ মানুষের মধ্যেও নতুন করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের চিন্তা আসেনি। ফলে হাতেগোণা কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে শেয়ারবাজারের লেনদেন। ২০০৪ সালের পর থেকে বাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়তে থাকে। মূলত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ দেওয়ার কারণেই সেই সময় বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
 
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এসে পুঁজিবাজার আরো চাঙ্গা হতে শুরু করে। মূলত ওই সরকারের নানামুখী অভিযানের কারণে দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগের সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও সংকোচিত হয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে লাভজনক মনে করতে শুরু করেন। তাছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কালো টাকার প্রশ্নহীন বিনিয়োগের সুযোগ শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর শেয়ারবাজারে লেনদেন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। বিপুল পরিমান নতুন বিনিয়োগ যুক্ত হওয়ায় বেড়ে যায় অধিকাংশ শেয়ারের দর।

প্রথমেই দেখতে হবে কী কারণে গত দু’ বছরে দেশের পুঁজিবাজার এতোটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। জাতীয় অর্থনীতির সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সরকার পুঁজিবাজারকে কোন অবস্থানে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা শোনা যায়নি। কিন্তু সরকারের আর্থিক নীতি যেভাবে সাজানো হয়েছে তাতে পুঁজিবাজারের উত্থান ছিল অবধারিত। জমে উঠা পুঁজি স্থানান্তর করে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি না করেই পুঁজিবাজারকে নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকে অর্জিত মুনাফাকে করমুক্ত রাখা হয়েছে। কালো টাকার শর্তহীন বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে। এসব কিছুই সাধারণ মানুষকে লাভজনক বিনিয়োগের একমাত্র ক্ষেত্রে হিসেবে পুঁজিবাজারের দিকে তাকানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাওয়ায় শিল্প উদ্যোক্তারাও ঝুঁকেছেন পুঁজিবাজারের দিকে। একই কারণে ব্যাংকিং খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে।

এভাবে গত দেড় বছরে সব দিক থেকে স্রোতের মতো টাকা ঢুকলেও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন শেয়ারের যোগান বাড়াতে না পারার কারণেই পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়। অধিকাংশ তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দর কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এরপরও নানা ধরনের গুজব ও প্রলোভনের কারণে শেয়ার ধরে রাখেন অধিকাংশ বিনিয়োগকারী। একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েও বাজারের রাশ টানতে ব্যর্থ হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি। এ অবস্থায় শেয়ারবাজারে জমে উঠা পুঁজি উৎপাদনমুখী খাতে স্থানান্তর করে শেয়ারের যোগান বাড়ানো ছিল সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু চাহিদা ও যোগানের অসামঞ্জস্যতা কমাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে না পারায় এক সময় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে পুঁজিবাজার।

২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে পুঁজিবাজারের ঊর্ধ্বগতি যখন অনেকটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠছিল, তখন থেকেই নানাভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে এসইসি। বেশ কয়েক দফা মার্জিন ঋণ কমিয়ে, আর্থিক সমন্বয় সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করে, অনেক কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত ও লেনদেন স্থগিত করে বাজারের রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করেছে এসইসি। কিন্তু নানামুখী চাপ এবং স্টক এক্সচেঞ্জের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আপত্তির কারণে অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এক্ষেত্রে সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু সদস্য এবং ব্যবসায়ীর অতি মুনাফার লোভে শেয়ারবাজারকে অস্বাভাবিক ফুলিয়ে-ফাপিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখে।

বিভিন্ন মহলের মুনাফালোভী তৎপরতায় সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে তিন মাসের ব্যবধানে ডিএসই সাধারণ সূচক প্রায় আড়াই হাজার পয়েন্ট বেড়ে প্রায় ৯ হাজার পয়েন্টে উঠে যায়। ডিসেম্বরে মূল্য সংশোধনের পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যায় এসব প্রতিষ্ঠান। এর ফলে ডিসেম্বরে কয়েক দফা রেকর্ড দরপতনের পর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয় নেমে আসে।

শেয়ারবাজার যখন অস্বাভাবিক অবস্থানের দিকে ধাবিত হয় তখন এসইসিসহ বিভিন্ন মহল থেকে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। বাজারের লাগাম টেনে ধরতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণেরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার অতিক্রম করার পর থেকেই অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুলধনী মুনাফার উপর আয়কর আরোপের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ডিএসই’র একজন সাবেক সভাপতির তৎপরতায় শেষ মুহূর্তে ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। ওই সাবেক সভাপতিসহ কয়েক জন ব্যক্তি বার বার সরকারকে ভুল বুঝিয়ে শেয়ারবাজারকে অস্বাভাবিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী এসইসির পক্ষ থেকে সকল শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০০ টাকা করার ঘোষণা দেয়া হলেও এদের তৎপরতার কারণে শেষ পর্যন্ত অভিহিত মূল্য ১০ টাকা করার এখতিয়ার কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। এসব কারণে একদিকে এসইসির কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, অন্যদিকে বাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। বাজারকে টেনে উঠানোর জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করলেও বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারের ঘনিষ্ঠ ওই ব্যক্তিরা তেমন কোনও ভূমিকাই নেননি।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশের পুঁজিবাজারে চরম মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর আগে গত এক বছরে বেশ কয়েক বার লেনদেন কমলেও তা ছিল একেবারেই সাময়িক। দু’-চারদিনের জন্য মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তা স্থায়ী হয়নি। কিন্তু ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে লেনদেনে নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকায় বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

অধিকাংশ শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে কোনও কোনও মহল বিপুল পরিমান টাকা সরিয়ে নিয়েছেন বলেও অনেকে আশঙ্কা করছেন।

তবে এ ধরনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট সৃষ্টির পেছনে বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে। সাধারণভাবে প্রতি বছরই ডিসেম্বর মাসে এসে পুঁজিবাজারে মূল্য সংশোধনের প্রবণতা তৈরি হয়। এর মূল কারণ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বার্ষিক হিসাব সমাপণী। বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব পোর্টফলিওর শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নেয়। জানুয়ারিতে তারা আবার বিনিয়োগ শুরু করলে বাজার ঊর্ধমুখী হয়ে উঠে।

কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু নির্দেশনার প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তার মোট দায়ের ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাওয়ায় গত দু’ বছরে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকেছে। ২০০৯ সালে শেয়ারবাজার থেকে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করায় ব্যাংকগুলো ২০১০ সালে এসে এখানে বিনিয়োগের হার অনেক বাড়িয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে গত ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের পরিমান আইনি সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে হয়েছে। এ কারণে এবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বিক্রির প্রবণতা অন্যান্য বছরের তুলনায় ছিল বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত বিনিয়োগ সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকের ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সিআরআর ০.৫ শতাংশ হার বাড়িয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ২ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে।

অন্যান্য বছর হিসাব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর সরিয়ে নেয়া টাকার বড় অংশ পুঁজিবাজারে ফিরলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি নির্দেশনার কারণে শেয়ারবাজার থেকে তুলে নেয়া টাকা এখানে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত ১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের মাস্টার সার্কুলারে ব্যাংকগুলোকে তাদের সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউসকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে একক গ্রাহক ঋণসীমা মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়। একক গ্রাহক সীমা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে তার মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দু’-তিন বছরে শেয়ারবাজার উর্ধ্বমুখী করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা ছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। এ সময় এসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজার থেকে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করেছে। গত বছরে ব্যাংকগুলো মুনাফার সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে। তার পেছনেও রয়েছে শেয়ারবাজার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নতুন নির্দেশনা ও পদক্ষেপের কারণে ওই টাকা আর বাজারে আনতে পারছে না। তারা যে টাকা লাভ করেছে সাবসিডিয়ারী হওয়ায় তার সিংহভাগ রেখে আসতে হয়েছে মূল কোম্পানিতে। শেয়ারবাজারের সেই টাকা বাজারে ফেরাতে পারলে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে।

শোনা যাচ্ছে, মন্দা পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে পুঁজিবাজারে আরও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। বাজারে পরিকল্পিত ধস নামিয়ে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলার জন্য নানামুখী তৎপরতা চলছে। অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ওই রাজনৈতিক গোষ্ঠীটি শেয়ারবাজারে ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে। গত সেপ্টেম্বরে ডিএসই সাধারণ সূচক সাড়ে ৬ হাজারের কাছাকাছি থাকা অবস্থায় ওই গোষ্ঠীটি কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে ওই অর্থ বিনিয়োগ শুরু করে। এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানে নামে-বেনামে বিপুলসংখ্যক বিও হিসাব খোলা হয়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। এসব হিসাব থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিদিনই তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ানো হয়। এর প্রভাবে তিন মাসের ব্যবধানে ডিএসই সাধারণ সূচক প্রায় আড়াই হাজার পয়েন্ট বেড়ে প্রায় ৯ হাজার পয়েন্টে উঠে যায়। পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক চক্রটি একযোগে শেয়ার বিক্রি শুরু করে। এর ফলে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়।

বাজারে অস্থিরতার পেছনে বেশ কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসেরও ভূমিকা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে। ধারাবাহিক দরপতনের সময় ৫-৬টি বড় মার্চেন্ট ব্যাংক শেয়ার কেনা থেকে বিরত ছিল। এরমধ্যে যে ক’দিন রেকর্ড দরপতন হয়েছেÑ বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হলেও নিজেদের পোর্টফোলিও তো বটেই এসব হাউসে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী শেয়ার কেনাও বন্ধ রাখা হয়। অনেক গ্রাহক শেয়ার কিনতে আগ্রহী হলেও তাদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিবৃত করা হয়। গত এক মাসের লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দরপতনের সময় পুঁজিবাজারের লেনদেনে শীর্ষ অবস্থানে থাকা একাধিক ব্রোকারেজ হাউস শেয়ার কেনা বন্ধ রাখায় বাজারে বিক্রির চাপ বাড়লেও এর বিপরীতে ক্রয়াদেশ ছিল একেবারেই কম। মূলত এ কারণেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই সূচকে বড় রকমের ধস নামে। আবার শেয়ারের দর ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার পর এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের পোর্টফোলিও এবং নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের হিসাবে বিপুলসংখ্যক শেয়ার কিনেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বাজার দরের চেয়েও কম মূল্যে শেয়ার বিক্রির দায়ে ৬টি ব্রোকারেজ হাউসের কার্যক্রম একমাসের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে এসইসি।

সব মিলিয়ে একের পর এক বিপর্যয়ের কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) পক্ষ থেকে গত এক মাসে একের পর এক পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও ইতিবাচক কোন ফল না আসায় বিনিয়োগকারীদের বাজারের উপর আস্থা হারাতে বসেছেন। তবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলে এখনও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সময় ১৪৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।