পুঁজি বাজারে দরপতনের রেকর্ড হলো রোববার। এরপর সোমবার সেই রেকর্ড ভেঙ্গে আরও দরপতন হলো।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা নতুন তারা অবাক হলেন। কিন্ত যারা পুরোনো তারা হয়তো ভেতরে ভেতরে এই অংকই কষলেন ‘দরপতনের পর বিক্ষোভ হয়, আর বিক্ষোভের পর হয় উত্থান’।
তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য এখন একটাই শিক্ষাÑ ‘পড়তি মার্কেটে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিক্রি আর উঠতি মার্কেটে অত্যুৎসাহী হয়ে কেনাÑ দুটোই বর্জনীয়। ’
চলতি সপ্তাহের প্রথম দু’দিনের অস্বাভাবিক পতনকেও হার মানিয়েছে তৃতীয় দিনের উত্থান। শুধু ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জই (ডিএসই) নয়, এমন অস্থির উঠানামার বাইরে ছিল না চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জও (সিএসই)। অবশ্য বছরের প্রথম কার্যদিবস থেকেই পুঁজিবাজারে ছিল অস্থিরতা।
মঙ্গলবারের উত্থানেও দু’টি কারণে বিনিয়োগকারীদের আনন্দে উদ্ভাসিত হওয়ার সুযোগ নেই। এক. টানা ছয় কার্যদিবসে যেটুকু কমেছে শেষ কার্যদিবসে এসে তার অর্ধেকের বেশি বেড়ে যাওয়া কিছুটা স্বস্তি দিলেও আগের জায়গায় যেতে এখনও ৮০০ পয়েন্ট বাকি। একদিনে যা বেড়েছে পরদিন বা এ সপ্তাহেও এটুকু বাড়ার সম্ভবনা কম। আর বাড়লেও তা অস্বাভাবিক বলেই ধরে নিতে হবে। দুই. এ সময়ের মধ্যে সূচক আগের জায়গায় উঠলে ঝুঁকির মাত্রা আবারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শেয়ার মার্কেটের লাগাম টেনে ধরতে তখন আবার সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নানা পদক্ষেপ নেবে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য নেতিবাচক বৈ ইতিবাচক হবে না।
আট হাজার ২৯০ পয়েন্টে শেষ হয়েছিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ২০১০ সালের সাধারণ সূচক। এরপর নতুন বছরে ২ জানুয়ারি প্রথম কার্যদিবসে এ সূচক ১৪ পয়েন্ট বাড়লেও পরের ছয় কার্যদিবসে কমেছে প্রায় এক হাজার ৮০৫ পয়েন্ট। আর অষ্টম কার্যদিবেস এসে মঙ্গলবার একদিনেই বাড়লো প্রায় এক হাজার ১৩ পয়েন্ট। এতে সাধারণ সূচকের সর্বশেষ অবস্থান দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৫১২ পয়েন্টে। আর এ সূচক ইতিহাসের সর্বোচ্চ আট হাজার ৯১৮ পয়েন্টে ছিল গত ৫ ডিসেম্বর।
সূচক পতনের ধারায় বছরের দ্বিতীয় কার্যদিবস ৩ জানুয়ারি ১২০ পয়েন্ট, ৪ জানুয়ারি ২০৪ পয়েন্ট, ৫ জানুয়ারি ৩৩ পয়েন্ট, ৬ জানুয়ারি ২১৩ পয়েন্ট, ৯ জানুয়ারি রেকর্ড পরিমাণ ৬০০ পয়েন্ট এবং ১০ জানুয়ারি আগের দিন রেকর্ড ভেঙ্গে ৬৩৬ পয়েন্ট কমে।
এদিকে, সিএসইতেও মঙ্গলবার এ যাবত সর্বোচ্চ দুই হাজার ১৮৯ পয়েন্ট বেড়ে সার্বিক সূচক দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৮৯৫ পয়েন্টে।
দু’দিনে রেকর্ডসহ টানা ছয় কার্যদিবসের পতন ক্ষুব্ধ করে তুলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরও। এর জের ধরে শেষ তিন কার্যদিবসেই ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা। এর মধ্যে শেষ দিন অর্থাৎ গত সোমবারের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
এমনকি বিভিন্ন স্থানে অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।
এ অবস্থায় সোমবার রাতে জরুরি বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর থেকে বিনিয়োগের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার পরদিনই ডিএসইর সাধারণ সূচকের এক হাজার ১৩ পয়েন্ট বৃদ্ধি, সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক পতনগুলোর চেয়েও অস্বাভাবিক।
সূচকের এমন ঊর্ধ্বমুখিতা দেখে বিনিয়োগাকারীদের আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। দীর্ঘদিনের ঊর্ধ্বমুখিতায় অধিকাংশ শেয়ারই অতিমূল্যায়িত হয়ে ঝুঁকিমাত্রায় পৌঁছে গেছে। সূচক চলে গেছে অনেক উপরে। তাই বাজারের সংশোধন হয়ে পড়েছিল খুবই জরুরি। আর এ সূচকের এ লাগাম টেনে ধরতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একের পর আদেশ জারি করে। তবে এ কাজটি তারা ধীরে ধীরে করতে পারতো। তাদের অদূরদর্শিতার কারণেই আজ অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে আহাজারি করছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ তাদের সংসার চালায় এখান থেকে।
রোববারের পতনের পর অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, দরপতন হলে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙচুর করে। কিন্তু বাড়লে তো রাস্তায় নেমে মিষ্টি বিতরণ করে না। তার এ বক্তব্য যে বিনিয়োগকারীদের জন্য সুখকর নয়, কারোরই তা অনুধাবন করতে না পারার কথা নয়।
ব্যাপক দরপতনের পেছনে যে শুধু সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক বা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনই দায়ী, তা কিন্তু নয়। বিনিয়োগকারীরাও কিছুটা দায়ী। গুজবে আতঙ্কিত হয়ে তারা শেয়ার ছেড়ে না দিলে হয়তো এতোটা খারাপ অবস্থা হতো না। তাই সামনের দিনগুলোতে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে বা ক্ষোভে দিশেহারা না হয়ে ধৈর্য ধরে বিনিয়োগকারীরা সচেতনতার পরিচয় না দিলে বাজার আরও ভয়ঙ্কর হয়ে পড়ার শঙ্কা থেকে যাবে।
সবকিছুর পরও ভয় নেই তাদের, যারা কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মৌলভিত্তি, বিগত বছরগুলোর আর্থিক অবস্থা ও লভ্যাংশ দেওয়ার হার, মূল্য-আয় অনুপাত (পি/ই রেশিও), শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), ক্যাটাগরি দেখে বিনিয়োগ করেছেন। ভালো মৌলভিত্তি, ৩০-এর মধ্যে পি/ই রেশিও ও ভালো ইপিএস থাকা শেয়ার ও ইউনিটের দর শিগগরিই ভালো অবস্থানে চলে আসবে, এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। এছাড়া সামনেই আসছে লভ্যাংশ ঘোষণার সময়। অন্তত এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে কিছুদিন অপেক্ষা করাই হবে বিনিয়োগকারীদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ।
তবে বাজার খেলোয়াড়দের (গেম্বলার) সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা কিছুটা কঠিন। তাই তাদেরও ধৈর্য ধরা বা অন্য কোম্পানি বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ার বা ইউনিটের সঙ্গে নেটিং করা ছাড়া কিছুই করার নেই।
বিনিয়োগকারীদের সবসময় মনে রাখতে হবে, এটা কোনও ব্যবসার জায়গা নয়। এটা বিনিয়োগের জায়গা। বিনিয়োগ করা কোম্পানি বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের উন্নতিতেই তার লাভ ও আয় অন্তর্নিহিত। তাই এখানে তাড়াহুড়ো করা বা জুয়াড়িদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা ছাড়া ঝুঁকিমুক্ত থাকার কোনও উপায় নেই।
বাংলাদেশ সময় ১০০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১১