ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

বাংলাদেশ-ভারত অসম বাণিজ্য দূর করার অন্তরায় ‘রাজনীতি’!

সোহেল রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১০ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১০

ঢাকা : অশুল্ক বাধা, শুল্ক স্টেশন ও ওয়্যার হাউজের অভাব, পণ্যমান রিপোর্ট প্রদানে বিলম্ব ইত্যাদি কারণে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এসবের পাশাপাশি নেপথ্যের সবচে বড় বাধাটি আসলে ‘রাজনৈতিক’ বা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নেতিবাচক মানসিকতা---এমন যুক্তিকেও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।

কারণ যা-ই হোক, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বি-পাকি বাণিজ্যে বিপুল ঘাটতির আশু সুরাহা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সব মহলই একমত যে, বিপুল বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনতে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর বিকল্প নেই।

সোমবার ঢাকায় এফবিসিসিআই’র সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ভারতের সাবেক তেল ও গ্যাসমন্ত্রী এবং রাজ্যসভার বর্তমান সদস্য মনিশঙ্কর আয়ার ‘শুল্ক ও অশুল্ক বাধা সেদেশে বাংলাদেশি পণ্য রফতানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন বড় কোনো বিষয় নয়’ বলে দাবি করেছেন।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের ‘মানসিকতার পরিবর্তন’ ঘটানো এবং একই সঙ্গে রফতানি বাড়াতে যথাযথ বাণিজ্য কৌশল গ্রহণ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

সাবেক ভারতীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তাই তার এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বি-মত পোষণ করেছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই।   ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বাড়াতে তারা সেদেশের সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ।  

বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে ভারতের পক্ষে থেকে গত কয়েক বছর ধরেই ‘মুক্তবাণিজ্য চুক্তি’ (এফটিএ) সম্পাদনের কথা বেশ জোরেসোরেই বলা হচ্ছে। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-ও ‘এফটিএ’র ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত। কিন্তু ভারতের সঙ্গে ‘এফটিএ’ সম্পাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে কতটুকু লাভবান হবে বা আদৌ হবে কি নাÑ এ বিষয়ে কোনো সরকারের আমলেই নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সরকারি নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য না পাওয়া গেলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রফতানি ভিত্তি সম্প্রসারণ, পণ্য বহুমুখীকরণ ও পণ্যের গুণগত মান উন্নত না হলে ভারতের সঙ্গে এফটিএ করে তেমন লাভবান হবে না বাংলাদেশ।  

কারো কারো মতে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যত সমস্যাই থাক, এর নেপথ্যের বড় সমস্যা ‘রাজনৈতিক’। বর্তমান সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানও বেশ কিছুদিন আগে এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘অশুল্ক ও অবকাঠামোগত বাধা ক্ষুদ্র বিষয়। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই মুখ্য’। তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক নানা বিরোধের কারণে বাণিজ্যের বিষয়টি উন্নয়নের হাতিয়ার না হয়ে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে’।
 
উল্লেখ্য, সরকারি হিসাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গড় বাণিজ্য ঘাটতি বছরে ৩ শ’ কোটি ডলার। আর অবৈধ বাণিজ্য হিসাবে আনলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে দ্বি-গুণ। ভারত তার মোট আমদানির মাত্র ২ শতাংশ আমদানি করে বাংলাদেশ থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৬ শতাংশ আসে ভারত থেকে।

দ্বি-পাকি বাণিজ্যে ঘাটতি কমিয়ে আনতে প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের প থেকে ভারতের শীর্ষ পর্যায়ে দেন-দরবার চালানো হলেও ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছেই। পর্যবেক মহলের মতে, এক্ষেত্রে ভারতের আন্তরিকতার বিষয়টিও প্রশ্নাতীত নয়।
 
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল ২৭ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। এর বিপরীতে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে ২৮৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য। অর্থাৎ গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৫৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এর আগের অর্থ বছরে (২০০৭-০৮) বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩০১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। সদ্য সমাপ্ত ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই ’০৯Ñএপ্রিল ’১০) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলার।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি ও ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে গত ২০০৭ সালের ২৩ জুলাই বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের তৎকালীন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জয়রাম রমেশ পাঁচ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেন। এগুলো হচ্ছে- টাটাসহ ভারতের বিভিন্ন কোম্পানিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা ও চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া, সীমান্তে আরও শুল্ক স্টেশন স্থাপন ও মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম চালু করা, মিজোরামে বাঁশ দিয়ে কাগজ উৎপাদন, বাংলাদেশে মেঘালয়ের চুনাপাথর দিয়ে সিমেন্ট তৈরি ও আগরতলা থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে বিদ্যুৎ সরবরাহে যৌথ প্রকল্প গ্রহণ।
 
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা যায়, ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে এবং রফতানি বাড়ানোরও সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ভারতের প থেকে নানা ধরনের অশুল্ক বাধা আরোপ করায় তা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশি পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের ল্যাবরেটরি রিপোর্ট প্রয়োজন হলেও প্রায় ত্রই রিপোর্ট দেওয়া হয় দেরিতে। আর সব ধরনের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারত ৪ শতাংশ বিশেষ শুল্ক আরোপ করে থাকে। এছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক শুল্ক স্টেশন ও কর্মকর্তা না থাকায় উত্তর-পূর্ব ভারতে রফতানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় : ১৮৩৯ ঘন্টা, ১২ জুলাই, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।