ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

শত শত বিঘা কৃষিজমিতে কী করতে চায় করিম গ্রুপ

আশরাফুল আলম লিটন, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১১
শত শত বিঘা কৃষিজমিতে কী করতে চায় করিম গ্রুপ

মানিকগঞ্জ: ‘সরষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হাওয়ার সুখে/ মটর বোনের ঘোমটা খুলে চুম দিয়ে যায় মুখে’ কিংবা ‘চলতে পথে মটরশুটি জড়িয়ে দু’খান পা/ বলছে ডেকে গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা!’ পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের কবিতার এই ক’টি লাইন শুনে সঙ্গে সঙ্গে মানসপটে আবহমান বাংলার সজিব শ্যামল যে রূপ ফুটে ওঠে, ওপরের ছবিতে তার অনেকটাই যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে।

ছবিটি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার সাড়াশিন এলাকার।

কিন্তু ঋতুচক্রের ধারাবাহিকতায় গ্রামবাংলার এই যে অসামান্য ঐশ্বর্যময় রূপ, সামনের দিনগুলোতে তা আর হয়তো দেখা যাবে না। কারণ এই জমিসহ আশপাশের প্রায় ৪শ’ বিঘা জমি কিনে নিয়েছে করিম গ্রুপ নামে এক প্রতিষ্ঠান।

শত শত বিঘা ফসলি জমির মধ্যে কী করতে চায় এই করিম গ্রুপ! এই প্রশ্নে এখন চরম অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন সাড়াশিন গ্রামসহ আশপাশের এলাকার জনসাধারণ। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বরংগাইল স্টেশন পার হলেই হাতের ডান পাশে চোখে পড়ে দিগন্তজোড়া ফসলি জমির মধ্যে অসংখ্য সাইনবোর্ড। বোর্ডে শুধু লেখা ‘করিম গ্রুপ’। দু’একটি সাইনবোর্ডে করিম গ্রপের সঙ্গে

লেখা রয়েছে একটি মোবাইল ফোন নাম্বার। এলাকায় খোঁজ-খবর করে জানা গেল, জমিগুলো স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে করিম গ্রুপ। কিন্তু কেউ জানে না কে এই করিম গ্রুপের মালিক? জিজ্ঞেস করলে সাইনবোর্ড দেখিয়ে দেয় সবাই।

জানা গেল, জমি বেচা-কেনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখছেন স্থানীয় আফজাল মোল্লা, নূরু মিয়াসহ কয়েকজন।
গ্রামবাসী বাংলানিউজকে জানান, প্রথমে কিছু লোভী লোক বেশি টাকার আশায় করিম গ্রুপের কাছে জমি বিক্রি করে। তারপর করিম গ্রুপ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং একসময় জোর করেই নিরীহ কৃষকদের কাছ থেকে জমি ‘কিনে নেওয়া’ শুরু করে।
এখন অবস্থা এমন হয়েছে, যারা কোনওমতেই জমি বিক্রি করতে চায় না, তাদেরকেও ছলে-বলে কৌশলে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

আর এতে অনেক নিরীহ কৃষক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন কয়েকজন কৃষক।

সাড়াশিন গ্রামের বয়োবৃদ্ধ কৃষক জুরান আলী (৭০) বললেন, ‘শুনেছি করিম গ্রুপের মালিকের বাড়ি ফরিদপুর। তারা সাড়াশিন চকে প্রায় চার’শ বিঘার মত জমি কিনেছে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে নাকি তারা মিল-ফ্যাক্টরি বানাবে। প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি যে তারা রাসের মত জমি গিলবে। তাহলে আমরা জমি বিক্রি করতাম না। ’

জুরান আলীর পুত্র মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার কামাল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, করিম গ্রুপ মিল-ফ্যাক্টরি, গার্মেন্ট কারখানা বানানোর নাম করে গ্রামের নিরীহ লোকদের কাছ থেকে জমি কিনে নেয়। মিল-কারখানা হলে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এখানে কাজ পাবে, চাকরির জন্য আর বাইরে যেতে হবে না আশা করে অনেকে জমি বিক্রি করেছে।

তিনি বলেন, ‘কিন্তু তিন বছর হয়ে গেল তারা এখনও কিছু করছে না এই জমিতে। তারা শুধু জমিই কিনছে। তারা এই জমিতে আসলে কী করবে আমরা কেউ জানি না। ’

কৃষক ইছাক আলী (৪২) বলেন, ‘এই এলাকার জমি তিন ফসলী। এই জমির ওপরই আমাদের সংসার চলে। এই মৌজায় আমার ২৮ শতাংশ জমি আছে। আমার জমির আশেপাশে করিম গ্রুপের জমি আছে। তারা দালাল মারফত আমার জমি কিনতে চায় । কিন্তু আমি জমি বিক্রি করতে চাই না। এটা আমার বাপ-দাদার সম্পত্তি। কিন্তু তারা হুমকি দিয়েছে, জমি বিক্রি না করলে মাটি ভরাট করে এমনিতেই নিয়ে নিবে। ’

বর্গা চাষী বেলাল শিকদার (৬৫) বলেন, ‘আমি বর্গা চাষে সংসার চালাই। এই জমিতে যদি মিল কারখানা হয় তাহলে আমি তো আর কাজ করতে পারবো না। আমাকে তো আর ফ্যাক্টরির কাজে নিয়োগ করবে না। ’

এ ব্যাপারে ওই সাইনবোর্ডে দেওয়া মোবাইল ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করলে করিম গ্রুপের সহকারী ব্যবস্থাপক হাসিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানে মিল ফ্যাক্টরি করার কথা। তবে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপরে সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে কোনও কাজ করা হবে। ’
‘শিবালয় উপজেলায় কত বিঘা জমি কিনেছে করিম গ্রুপ’ প্রশ্ন করলে তিনি সঠিক কোনও তথ্য জানাতে পারেননি।

পরে বুধবার দুপুরে করিম গ্রুপের সহকারী ব্যবস্থাপক হাসিবুর রহমানের ওই সেল নাম্বারে যোগাযোগ করলে বলা হয়, হাসিব সাহেব নেই।

ফোনটি কে ধরেছেন প্রশ্ন করলে বলা হয়, ‘আমি সামান্য চাপরাশী। আমাকে কোনও প্রশ্ন করবেন না। আমি কিছু বলতে পারবো না। ’
তবে ওই ব্যক্তি কোম্পানির চেয়ারম্যানের সেল নাম্বার দেন বাংলানিউজকে। বলা হয়, নাম্বারটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান ওয়াদুদ সাহেবের। তবে ওই নাম্বারে বারবার ফোন করেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। বারবার রিং হওয়ার পরেও কেউ তা রিসিভ করেননি।

ফসলি জমিতে মিলকারখানা তৈরির উদ্দেশ্যে এভাবে শত শত বিঘা জমি একক একটি প্রতিষ্ঠানের কিনে নেওয়া প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুস সাত্তার খানকে প্রশ্ন করলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, এ ব্যাপারে সরকার একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে। খসড়াটি চূড়ান্ত হয়েছে, তবে তা এখনও পাস হয়নি।

তিনি বলেন, ‘মিল কারখানা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য দিন দিন ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকায় দেশ চলে যাচ্ছে ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে। ’

খসরা চূড়ান্ত হওয়া ‘ভূমি ব্যবহার আইন ২০১০’ নামের নয়া ওই আইনে চাষাবাদ ছাড়া অন্য যে কোনও উদ্দেশ্যে কৃষিজমি ব্যবহারের আগে সরকারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ওই আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাড়ি-ঘর, আবাসিক এলাকা, হাট-বাজার, ইটভাটা, মিল-কারখানাসহ যে কোনও ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা কৃষিজমিতে নির্মাণ করা যাবে না।

ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নয়া আইন অনুযায়ী কৃষিজমি ধ্বংস করে মিল-কারখানা এমনকি রাস্তা-ঘাট বা শিক্ষা প্রতষ্ঠান নির্মাণের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়েছে।

ভূমি সচিব মোখলেসুর রহমান বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, খুব দ্রুতই এই আইনটি পাস হতে যাচ্ছে।        

এসব বিষয় উল্লেখ করে মানিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুন্সী শাহাবুদ্দিন আহম্মেদকে প্রশ্ন করলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘যে কেউ ইচ্ছা করলেই কৃষিজমির ওপর কোনও স্থাপনা বা মিল-কারখানা করতে পারবেন না। নয়া আইনটি পাস হওয়ার পর সেই আইনের বিধিমালা মোতাবেক এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল হককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘যদ্দুর সম্ভব ফসলি জমিতে মিল-কারখানা না করাই ভালো। নতুন আইন পাস হলে ফসলি জমিতে মিল কারখানা করা যাবে না। ’   

বাংলাদেশ সময়: ০০১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।