ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত

মান্নান মারুফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৪০ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১০
খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত

 

  • ৩১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে সাড়ে ২৩টি কোটি টাকা খেলাপি ঋণ
  • ক্কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অমান্য করে ঋণ বিতররণ
  • শিগগিরই আরলি ওয়ার্নিং-এ পড়ার আশঙ্কা


দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাহাড়সমান। দিন যতো যাচ্ছে পরিমাণ ততোই বাড়ছে।

বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা। ৩২টি ব্যাংকে এ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।

খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা অমান্য করে ইচ্ছেমতো ঋণ বিতরণ করছে একাধিক ব্যাংক, যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছু কিছু ব্যাংক খুব শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নজরদারিতে (আরলি ওয়র্নিং) চলে আসবে বলেও সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেন। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায়ের বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশের সুবাদে আদায়ের পরিমাণও বাড়লেও তা আশানুরূপ নয়। আদায়ের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে।

তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যাংক যদি খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।   এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নজর রয়েছে, যাতে খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায় করা সম্ভব হয়।

সূত্র জানায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরকারি-বেসরকারি, বিদেশি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর দেওয়া  ঋণ ক্রমেই খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। ঋণ বিতরণের সময় উপযুক্ত জামানত না রাখা, যোগ্য উদ্যোক্তাদের ঋণ না দেওয়া, সময়মতো ঋণ আদায় না করা এবং রাজনৈতিক প্রভাব বা ব্যাংকের পরিচালকদের চাপে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো ঝুঁিকর মধ্যে পড়ছে। বিতরণ করা ঋণ যথাসময়ে আদায় করা যায় না বলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তাগিদ ও নির্দেশনা থাকার পরও  বেশির ভাগ ব্যাংকই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে না। একইসঙ্গে তারা ব্যাংক কোম্পানি আইনও অমান্য করছে। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ব্যাংকগুলোর ‘পেরেকের ভারে জাহাজ ডোবার অবস্থা’ হয়েছে। ।

একাধিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, বেসরকারি এবং বিদেশি ব্যাংক সব ধরণের ব্যাংকেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। ব্যাংকিং খাতে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা খেলাপি রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকেগুলোতেই এ হার বেশি লক্ষ্য করা গেছে।

জানা গেছে, গত তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মোট ১৬৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেছে। ওই সময়ে মোট শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ১৬৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।   এর আগের তিন মাসে ছিল ১১ হাজার ৭৪৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। গত তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৪১৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এ সময়ে সুদ মওকুফ ও অবলোপনের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৬ কোটি ৪৭ ও ২৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ফলে মোট ঋণের বিপরীতে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১.৬৯ শতাংশ। এটা আগের তিন মাসের চেয়ে ০.৩৮ শতাংশ বেশি।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে নগদ আদায় করেছে ৩৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এসব ব্যাংকে গত তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর আগের তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১৭৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। গত তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৫৯৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।   এর মধ্যে  ৪.১৫ শতাংশ হচ্ছে শ্রেণীকৃত ঋণ।

বিদেশি ব্যাংকগুলোর শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে নগদ আদায় হয়েছে ৮ কোটি ৯ হাজার টাকা। শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এর আগের তিন মাসে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল  ৩৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমে এসেছে। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৪ কোটি। এ আগে একই সময়ে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১২০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এ তিন মাসে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ৯৬.৫৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৩২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর আগের তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, গত তিন মাসে ৩২টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট বা ব্যাংকিং খাতের জন্য অত্যন্ত র্ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য একাধিক মনিটরিং, নির্দেশ এবং শাস্তি দেওয়া হলেও এসব ব্যাংক তা মেনে চলছে না। ফলে খেলাপি ঋণ আদায়ের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছু কিছু ব্যাংক খুব শিগগিরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্লি ওয়ার্নিং বা বিশেষ আগাম নজরদারিতে আসতে পারে।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলো যাতে খেলাপি ঋণ যথাসময়ে আদায় করার মধ্য দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে সেজন্যই ব্যাংকগুলোকে তৎপর হতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং খাতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক লক্ষ্য। এছাড়া খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান খেলাপি ঋণ আদায়ের বিষয়ে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়ে একাধিক সভা-সেমিনার এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, ‘শ্রেণীবদ্ধ (কাসিফায়েড) খেলাপি ঋণের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালক ও ম্যানেজার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু  কর্মকর্তা দায়ী। এদের ম্যানেজ করেই  প্রভাবশালীরা বছরের পর বছর ঋণখেলাপি হয়ে থাকেন। কিন্তু দরিদ্র কৃষকসহ অনেক কম অংকের ঋণ গ্রহীতাদের বেশিরভাগই ঋণ পরিশোধ করেন।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার এই হীন প্রবণতা রোধে সবার আগে উচিত সংশ্লিষ্ট নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও জোরালো ভূমিকা নেওয়া দরকার। তা না হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়বে।

একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খেলাপি ঋণের মূল হোতা হচ্ছেন ব্যাংকের পরিচালকরা। তারা ব্যাংক ও কোম্পানি আইন অমান্য করে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিভিন্নভাবে অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এছাড়া কিছু কিছু পরিচালক অবৈধভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে থাকেন। উপযুক্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দিতে তারা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য পরিচালকদের বাধ্য করেন। ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করার কথা থাকলেও মূলত তাদের কারণেই সেটা থেকে যায় অনাদায়ী। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পাল্লা দিনকে দিন কেবলই ভারি হতে থাকে।
বর্তমান গভর্নর ড. আতিউর রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে গেছে। ব্যাংকগুলোকে এব্যাপারে  খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়টিও কঠোর নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে। এর ইতিবাচক পলও পাওয়া গেছে।   তাই ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ প্রায় ৫ শতাংশ বেশি আদায় হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত বা আশানুরূপ নয়।

জানা গেছে, বিভিন্ন মেয়াদে গ্রাহকরা ঋণ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করায় এটি খেলাপিতে পরিণত হয়। এসব খেলাপি ঋণকে ব্যাংকের ভাষায় তিন ক্যাটাগরিতে শনাক্ত করা হয়। প্রথমটি হলো মেয়াদের ক্ষেত্রে নিম্ন মান। ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে পরিশোধ করা না হলে গৃহীত ঋণকে ‘নিম্ন মান খেলাপি’ বলা হয়। ঋণ গ্রহণের পর দ্বিতীয় দফা হলো ‘সন্দেহ ঋণ’। ঋণ গ্রহণের পর থেকে পরিশোধের নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে ৯ মাস অতিবাহিত হলে এটিকে ‘সন্দেহ ঋণ’ বলা হয়। এছাড়া খেলাপি ঋণের শেষ পর্যায়কে ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের পর এক বছর অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও যদি গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করেন তখন এটিকে ‘ক্ষতিকর ঋণ’ হিসেবে চিহ্নত করা হয়।

 ঋণখেলাপি হওয়ার পর যে কোনো ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রথম গ্রাহককে মৌখিকভাবে ঋণ পরিশোধের জন্য জানানো হয়। এর পরও ঋণ পরিশোধ না করা হলে লিখিত নোটিশ দেওয়া হয়। তার পরও যদি গ্রাহক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হন তাহলে তৃতীয় পর্যায়ে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়। সর্বশেষ পর্যায়ে ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।