দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো বেসরকারি খাত। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ছাড়া শিল্প ও কর্মসংস্থান চাঙ্গা করা অসম্ভব।
কারণ এটি বিনিয়োগ, খরচ এবং উৎপাদনশীলতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। যদি সুদের হার খুব বেশি হয়, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যেতে পারে এবং মন্দার ঝুঁকি বাড়বে। এ অবস্থায় ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাংক সুদহার নির্ধারণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতের সুশাসন, ভারসাম্যপূর্ণ সুদহার, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ব্যবসায়ী- উদ্যোক্তা, ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিনিয়োগে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাংক সুদ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে সুদ কমালেই যে বিনিয়োগ বাড়বে এটা ঠিক নয়। আগে ৬/৯ হারে আমানত ও ঋণের সুদ নির্ধারণ করা হলেও তা আসলে কার্যকর হয়নি। এজন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফেরানোটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে। খেলাপি ঋণের আসল তথ্যটা এখন বেরিয়ে আসছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে ফিরিয়ে আনতে হলে আস্থাহীনতার সঙ্কট দূর করতে হবে। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি বেশি হলে ব্যাংক সুদ বেশি কমানোর সুযোগ নেই। এজন্য মূল্যস্ফীতি কমাতেও পদক্ষেপ নিতে হবে। অবকাঠামো খাত বিশেষ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ও রাস্তাঘাট উন্নয়ন করা গেলে বিনিয়োগ বাড়বে।
ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, আমাদের গ্রাহক কে হবেন, এ ব্যাপারে আমরা খুব সচেতন। আমি কখনো কাউকে ঋণ দেওয়ার জন্য কোনো নির্দেশনা বা পরামর্শ দিইনি। ঋণ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ আছে। তারাই এটা দেখে। শুধু তাই নয়, আমানত ও ঋণের বিপরীতে কত শতাংশ সুদ ধার্য্য করা হবে সেটিও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। শুরু থেকে আমরা ব্যক্তি নয়, প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করি। আগ্রাসী কোনো ঋণ ইস্টার্ন ব্যাংক দেয়নি। এটা সম্ভব হয়েছে পরিষ্কার নির্দেশনা, জবাবদিহি, সুশাসন নিশ্চিত করার কারণে।
তিনি বলেন, আমরা বাজারে এই ধারণা দিতে পেরেছি যে, যথাযথ যাচাই–বাছাই ছাড়া গ্রাহক করা হবে না। এ কারণে আমরা কখনো সমস্যায় পড়িনি। অনেকে আমাদের কাছে আসেনি, আবার অনেকে এসে ফিরে গেছে। আমরা জেনেশুনে এমন কোনো গ্রাহককে ঋণ দিইনি, যা ফেরত পেতে ভোগান্তি পোহাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে প্রগতিশীল ব্যবসায়ী পরিষদের সহ-সভাপতি প্রার্থী ও ল্যাবএইড গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম বলেন, একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাংক সুদহার অর্থনীতিতে বিনিয়োগ, ভোগ ও সঞ্চয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আশা করব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘সঠিক’ সুদের হার খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে, যা একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করবে এবং অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
তিনি বলেন, অগ্রাধিকার খাত, বিশেষ করে কৃষি, এসএমই (ছোট ও মাঝারি শিল্প), স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আবাসন, গার্মেন্টস এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেক ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে ৯ শতাংশের কম সুদ বিবেচনায় ঋণ নিয়ে এরই মধ্যে শিল্প স্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন সুদ গুনতে হচ্ছে ১৪-১৫ শতাংশ। নীতি সুদ হার এভাবে বাড়তে থাকলে আগামীতে ঋণের খরচ আরও বেড়ে সামগ্রিকভাবে সংকট তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ। যারা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ঋণের ভারে খেলাপি হয়ে পড়বেন।
বর্তমানে ব্যাংকগুলো কর্তৃক নির্ধারিত সুদের হার অনেক বেশি, যা এই খাতগুলোর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদহার কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কৃষি, এসএমই (ছোট ও মাঝারি শিল্প), জ্বালানি এবং স্বাস্থ্যের মতো খাতগুলোতে ঋণের সুদ কমানো এবং সহনীয় পর্যায়ে রাখা জরুরি। সরকারের উচিত, এ খাতগুলোতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এতে ঋণ গ্রহণকারীরা সহজে ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দিতে পারবেন এবং দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
সাকিফ শামীম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি ব্যবহারের মাধ্যমে সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করে। সুদের হার স্থিতিশীল থাকলে, ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যতের বিনিয়োগের জন্য পরিকল্পনা করতে পারে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। এ ছাড়া অনুকূল সুদের হার সঞ্চয়কারীদের ব্যাংকগুলোতে আমানত রাখতে উৎসাহিত করে, যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে সহজ সুদের ঋণ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি, বিদেশি উদ্যোক্তাদের মুনাফা নিজ দেশে প্রেরণের সুযোগ এবং সঠিক তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা এবং যারা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে যেতে চায় তাদের এক্সিট দিতে হবে। এজন্য অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
জিসিজি/এমজেএফ