ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

ডলার সংকট-সরকারি প্রকল্পে ধীর গতি

রাজনীতি-অর্থনীতির প্রভাবে চাহিদা কমায় সংকটে সিমেন্ট শিল্প

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৩
রাজনীতি-অর্থনীতির প্রভাবে চাহিদা কমায় সংকটে সিমেন্ট শিল্প

ঢাকা: গত এক যুগে সিমেন্ট খাতের আকার বেড়েছে তিন গুণের মতো। আর ভবিষ্যতের বাজার সম্ভাবনা ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছেন উদ্যোক্তারা।

কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক মন্দা, স্থানীয় অবকাঠামো খাতে চাহিদা কমে যাওয়া ও ডলার সংকট ও সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের ধীর গতির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সিমেন্ট খাত৷ তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসলে এ খাতে আবার সুদিন আসবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের কারণে বর্তমানে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। স্থানীয় বাজারে চাহিদা কমায় কোম্পানিগুলোর উৎপাদনও কমেছে। পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা ভোক্তারাও নির্মাণকাজ পিছিয়ে দিচ্ছেন। আবাসন খাতে ফ্ল্যাটের বিক্রিও কমেছে।

এ অবস্থায় সামনের বছরগুলোয় ডলারের দাম, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না হলে এ লোকসান কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। একই সঙ্গে সিমেন্টের ব্যবহার বাড়াতে সরকারকে পরিকল্পনা নিতে হবে। তাহলে সিমেন্ট খাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সিমেন্ট কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭টিতে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮ কোটি ৪৩ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। আর প্রতিদিন দুই লাখ ৩৪ হাজার ২০০ মেট্রিক টন৷ বর্তমানে ক্রাউন, আকিজ, ট্রাইগার, বাংলা, মীর, কনফিডেন্স সিমেন্ট তাদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এতে সিমেন্ট খাতে উৎপাদন আরও ৩৭ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন বাড়বে৷ এতে সামনের বছর দেশের সিমেন্ট খাতের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১০ কোটি টনে উন্নীত হবে।

আর বর্তমানে দেশের সিমেন্ট খাতের অর্ধেক সক্ষমতাই অব্যবহৃত রয়েছে। এ খাতে উদ্যোক্তারা ৫৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন, যার ৭০ শতাংশেরই উৎস হলো ব্যাংক ঋণ। তিন বছর আগেও এ খাতের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ সক্ষমতা বাড়ানোর কারণে এ সময়ে আরও ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ বেড়েছে।

দেশের সিমেন্টের বাজারে শীর্ষস্থানীয় উৎপাদকদের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের বসুন্ধরা সিমেন্ট, আবুল খায়ের গ্রুপের শাহ সিমেন্ট। এছাড়া সেভেন রিংস সিমেন্ট, ফ্রেশ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, ক্রাউন সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, কনফিডেন্স সিমেন্ট, আমান ও আনোয়ার সিমেন্ট৷

কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট ও আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবুল খায়ের গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শাহ সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বর্তমান বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১ কোটি ৮ লাখ মেট্রিক টন। বসুন্ধরা গ্রুপের অধীনে দুটি সিমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা সিমেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ৯৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। সেভেন রিংস সিমেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮৬ লাখ ৪০ হাজার টন। ফ্রেস মিসেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮২ লাখ ৮০ হাজার টন। প্রিমিয়ার সিমেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮১ লাখ ১০ হাজার টন। হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড বছরে সিমেন্ট উৎপাদন করতে পারে ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টন। ক্রাউন সিমেন্ট পিএলসির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টন। কোম্পানিটির ষষ্ঠ ইউনিট উৎপাদনে এলে এর সক্ষমতা দাঁড়াবে বার্ষিক ৫৭ লাখ টনে। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ লাখ ৮০ হাজার টন। কনফিডেন্স সিমেন্ট পিএলসি বছরে সিমেন্ট উৎপাদন করতে পারে ১৫ লাখ ১০ হাজার টন। আর রেডি-মিক্স উৎপাদন সক্ষমতা বছরে ২৪ লাখ টন।

এ বিষয়ে বসুন্ধরা সিমেন্টের চিফ মার্কেটিং অফিসার খন্দকার কিংশুক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দেশের বেশিরভাগ সিমেন্ট প্রতিষ্ঠান তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে ব্যবহার বাড়েনি। এতে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া ডলারের উচ্চমূল্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বড় বড় প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ, অর্থনৈতিক মন্দার জন্য ব্যক্তিগত কাজও এখন কেউ করছে না। ফলে বাজারে টিকে থাকার লড়াইয়ে যে যার মতো করে পণ্যের দাম কমানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে আরও লোকসানে পড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আর সিমেন্ট খাতে প্রতিবছর যে প্রবৃদ্ধি ছিল সেটা হচ্ছে। এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে এ খাতে।

তিনি বলেন, আমাদের সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি করে আনতে হয়৷ সেখানে সরকারের বিভিন্ন ট্যারিফ সংক্রান্ত ইস্যু রয়েছে। যেটা সিমেন্ট শিল্পের জন্য সহায়ক নয়। এছাড়া ডলারের রেটের জন্য এলসি রেট অনেক বেশি। এদিকে সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বেশি হওয়ায় একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েছে। গত ১০ বছরে দেশে অবকাঠামোগত অনেক কাজ হয়েছে। এখন নির্বাচনের পরে যে নতুন সরকার আসবে তারা যদি নতুন করে প্রকল্প নেয়, ডলার সংকট, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমে যায়। তাহলে সিমেন্টের কনজামশন (ব্যবহার) বাড়বে। তখন আস্তে আস্তে এ খাতের মন্দা কাটিয়ে উঠা যাবে।

এ বিষয়ে ইউনিক সিমেন্টের নির্বাহী পরিচালক খোরশেদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, সিমেন্ট খাতে গত দুই বছর ধরে চাহিদা কমেছে৷ আর সিমেন্টের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশের মতো। কিন্তু গত দুই তিন বছরে এটা এক শতাংশ করে কমেছে। আমাদের সিমেন্ট খাতের সক্ষমতা বাড়লেও এর ব্যবহার কমেছে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সিমেন্ট উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ আমরা উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে না পারলে লোকসান হবেই।

তিনি বলেন, আমরা যে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি করি ডালার দিয়ে। সে ডলারের দাম নিয়মিত বাড়ছে। তার একটা প্রভাব পড়ছে। এছাড়া বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে একটি প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এখানেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, ডলারের দাম বৃদ্ধি, বিক্রির গ্রোথ না থাকায় লোকসান হচ্ছে। এছাড়া সরকারের যে বড় বড় প্রকল্প সেখানে টাকা পয়সা ছাড় করছে না নির্বাচনের জন্য৷ নির্বাচনের পর নতুন সরকার আসলে যদি আবার বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয় তখন হয়তো চাহিদা বাড়বে। তবে এটা হতে আরও এক বছর লেগে যেতে পারে। তবে ডলারের দাম, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না হলে এ লোকসান কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। একই সঙ্গে সিমেন্টের ব্যবহার বাড়াতে সরকারকে পরিকল্পনা নিতে হবে। তাহলে সিমেন্ট খাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

বিসিএমএর নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মেট্রোসেম সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের খেলাপি হওয়ার বদনাম নেই।  কোভিডের পর ২০২১ সালে সিমেন্ট খাত একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ২০২২ ও ২০২৩ সালে এ খাত সমস্যার মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে সিমেন্ট খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকসান গোনার পাশাপাশি চলতি মূলধন সংকোচন ও ব্যাংকের অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারার মতো সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে সিমেন্ট খাতে উদ্যোক্তারা তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। আমরা মনে করেছিলাম এসব প্রকল্প চালু হলে সিমেন্টের ভোগ বেড়ে যাবে। তবে সামনের দিনগুলোয় যদি সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প সেভাবে না হয় তাহলে সিমেন্ট খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক মন্দা, ডলার সংকট ও জাতীয় নির্বাচনের কারণে এবারের মৌসুমটি ব্যতিক্রম। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফেব্রুয়ারি থেকে চাহিদা বাড়বে বলে আশা করছি। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে আমাদের যে লোকসান হয়েছে সেটি চলতি মূলধন থেকে উধাও হয়ে গেছে। বিষয়টি আমরা এলসি খোলার সময় গিয়ে টের পাচ্ছি।

এদিকে সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার। এর পুরো চাহিদা পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী আমদানি পণ্যের অন্যতম ক্লিংকার। এর পাশাপাশি স্ল্যাগ, জিপসাম, লাইমস্টোন ও ফ্লাইঅ্যাশের মতো কাঁচামালও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে দেশে ক্লিংকারের আমদানি কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ লাখ ২৩ হাজার ৯৯২ টন বা ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশে ক্লিংকার আমদানি হয়েছে ৬৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯৩ টন, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৭৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৫ টন।  


বাংলাদেশ সময়: ১৮৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৩
জিসিজি/জেএইচ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।